নিতান্তই আজাইড়া মানুষ আমি।
মহাখালী চলে এসেছে! এইতো! আর একটু পরই নামতে হবে। এই সময়ে উপমা অতিরিক্ত নার্ভাস হয়ে যায়। ঘামতে থাকে। একটু পর পর হেল্পারকে বলে দেয়, “ভাই, সামনে নামবো।
” হেল্পার জোড়ে বাসের গায়ে চাপড় দিয়ে বলে,
বেরেক! লেডিস নামবো।
নামতে নামতে উপমার কানে ভেসে এলো ড্রাইভারের কথা
: ব্যাটা, লেডিস না, ক’ লেংড়ি নামবো, হেঃ হেঃ
শিউড়ে ওঠে উপমা। হঠাত কোথা থেকে যেন অসম্ভব কষ্ট এসে বুকে চাপ চাপ ব্যাথার সৃষ্টি করে। সামান্য খুড়িয়ে হাঁটে উপমা। তাতে লোকের কি? কেন ও হেঁটে গেলে আশেপাশের লোকগুলো হা করে থাকবে? কেউ কেউ আবার চুকচুক করে দুঃখও করবে? অসহ্য লাগে এসব।
তবু কিছুই করার নেই উপমার। ওর বয়স যখন পাঁচ, একটা ছোট্ট রোড একসিডেন্ট কেড়ে নেয় উপমার মাকে, আর সেদিনের স্মৃতি কখনো না ভোলার মত ক্ষত রয়ে গেল উপমার পায়ে...
হলিক্রস কলেজে চান্স পেয়েছে উপমা। বাবা খুশিতে সবাইকে ফোন করে জানালো। কিন্তু ফোন রেখে উল্টো বাবার মন খারাপ হয়ে গেল। সবাই বলছে কিভাবে যাবে মেয়েটা? নিকঞ্জ থেকে ফার্মগেইট যাওয়ার ব্যাপারটা বাবার মাথায়ই ছিলো না।
উপমা অনেকদিন বাসে চড়তে ভয় পেত। কে জানে, হয়তো ছেলেবেলার স্মৃতি তাড়া করে বেড়াতো ওকে। কাউকে কিছু বলেনি অবশ্য। কিন্তু উপমার জেদের কাছে বাবার চিন্তা হার মানলো। শুরু হলো কলেজ জীবন, আর সেই সাথে আজকের মত পথে ঘাটে গা জ্বালানো মন্তব্য।
তবু স্বস্তি, এটা মেয়েদের কলেজ।
সুবর্ণা আর তুলির সাথেই ওর বেশি ভাব। বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত ওরা একসাথেই আসে। কলেজ ভালো লাগে উপমার, শুধু ভালো লাগেনা ক্যামিস্ট্রি। উফ! কিছুই ঢোকেনা মাথায়! তুলিদের সাথে শহীদ স্যার এর বাসায় প্রাইভেটে পড়া শুরু করে দিলো মেয়েটা।
স্যার অসাধারন পড়ায়। সমস্যা হল, নটরড্যাম এর কিছু ছেলেও একসাথে পড়ে। ব্যাপারটা অস্বস্তিকর। যখনই স্যার এর বাসায় আসে উপমার মনে হয় সবাই ওর দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। হয়তো পুরোটাই মনের ভুল, তবু অস্বস্তি যায়না ওর।
দেখতে দেখতে সবার সাথে কিছুটা ফ্রী হয়ে গেল মেয়েটা। উত্তরায় শ্যামল আর রাকিব থাকে বলে বাড়ি ফিরতেও সুবিধা। উপমা তার পরিচীত জগতে এলে ভুলে যায় তার দুর্বলতা। তবু আজ বুকে কষ্টটা নড়াচড়া করে উঠলো। তুলি তো বকবক করছেই তখন থেকে।
কিচ্ছু শুনতে ইচ্ছে করছে না আজ। তবু উপমা তুলির কথায় হু হা করে যাচ্ছে।
তুলি: এখন বলতো কি করি?
উপমা: ঠিক বুঝতে পারছিনা।
: আসিফকে ফোন নাম্বার দেয়া ঠিক হয়নি তাই না?
: কি জানি? আচ্ছা, আসিফ কে?
সুবর্ণা হি হি করে হেসে উঠলো।
সুবর্ণা: তার মানে এতক্ষন তুই কিছুই শুনিস নি! সুবর্ণার ঠোঁটে দুষ্টু হাসি খেলে গেল।
উপমা আঁড় চোখে তুলির দিকে তাকালো। তুলি রাগে এক দৃষ্টিতে উপমার দিকে তাকিয়ে থাকলো, তারপর ধুপ করে উঠে চলে গেলো। একটু পর এসে ব্যাগটাও নিয়ে গেলো। খুব খারাপ লাগলো উপমার। ধুর, বাসের ড্রাইভার সকালে কি না কি বললো-তাই নিয়ে এতো মন খারাপ থাকলে চলে? নিজের মনেই প্রবোধ দিলো উপমা।
তবু মন খারাপ ভাবটা মুখে লেগেই রইলো। ক্যামিস্ট্রি স্যারও কিনা আজই ঘোষনা দিলেন, সারপ্রাইজ টেস্ট নেবেন। কোন মানে হয়! সবাই আতঙ্কে বই নেড়েচেড়ে শেষ রিভিশন দিয়ে নিচ্ছে। উপমা ধীরে ধীরে সাদা কাগজ বের করলো, কিন্তু কলম খুঁজে পাচ্ছে না। নির্ঘাত কলেজে ফেলে এসেছে! হঠাত ওর সামনে একটা কলম এগিয়ে দিলো শ্যামল।
উপমা অবাক! কিভাবে বুঝলি? শ্যামল শুন্য দৃষ্টিতে বললো, রাকিব দিতে বললো। রাকিব তখনো বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছে। উপমা হেসে ওকে ধন্যবাদ দেয়ার আগেই রাকিব বলে উঠলো, দোস্ত, কিছু পারিনা, দেখাইস। উপমা বললো, আমিও কিছু পারি না। কিন্তু প্রশ্ন পাওয়ার পর দেখা গেলো প্রায় সবগুলোই উপমার জানা।
রাকিব জোঁকের মত উপমার খাতার দিকে তাকিয়ে লিখতে লাগলো।
স্যার এর বাসা থেকে বের হয়ে রাকিব বললো, উপমা, দোস্ত- থ্যাংক্যু। আজ তুই না থাকলে পুরাই ফেল।
শ্যামল হাঁটছে সাথে সাথে। শ্যামল আর রাকিব ভালো বন্ধু।
দুজনই উত্তরায় থাকে। শ্যামল রাকিবের মত বেশি কথা বলে না। কেমন উদাস উদাসভাবে ধীরে ধীরে হাঁটে। যেন বাড়ি ফেরার কোন তাড়া নেই। এজন্য উপমার ওদের সাথে পা মিলিয়ে হাঁটতে তেমন কষ্ট হয় না।
এ সময়ে বাসে প্রচন্ড ভীড় থাকে। আজও ভীড় ঠেলে বাসে উঠতে কষ্ট হলো। শ্যামল আর রাকিবকে দেখা যাচ্ছে না। উঠেছে নিশ্চই। উপমা শক্ত করে বাসের সীট ধরে দাঁড়ালো।
কিন্তু বাস যতবার ব্রেক করছিলো উপমা তাল সামলাতে পারছিলো না। হঠাত মনে হলো ওর ব্যাগে কেউ হাত দিয়েছে। পেছনে তাকিয়ে দেখলো শ্যামল। ব্যাগ ধরে আছে যেন উপমা পড়ে না যায়। বাসের মহিলাসীটগুলো দখল করে আছে পুরুষরা।
শ্যামল ওদের দিকে তাকিয়ে বললো, এইসব কি ভাই? মহিলাসীট ছেড়ে দেন।
এতে কারো কোন বিকার হলো বলে মনে হলো না।
শ্যামল আবার বললো, কি আশ্চর্য, দেখছেন না মেয়েটা অসুস্হ। দাঁড়াতে পারছে না।
তাতেও কোন লাভ হলো না।
কিন্তু কথাটা উপমার বুকে বিঁধলো। শ্যামলের ওপর ভীষন রাগ হলো।
বাসায় ফিরেই হু হু করে চোখে পানি চলে এলো ওর। কাঁদতে কাঁদতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলো মেয়েটা! ঘুম ভাঙলো ফোনের শব্দে।
ওপাশ থেকে শ্যামল বললো, কিরে? ঠিকমত পৌঁছেছিস তো?
উপমা ঝাঁঝালো কন্ঠে বললো, না ফিরলে কথা বলছি কিভাবে?
শ্যামল অবাক হয়ে বললো, এভাবে কথা বলছিস কেন?
উপমা বললো, আমি এভাবেই কথা বলি, আর কিছু বলবি?
শ্যামল ফোনটা রেখে দিলো।
খুব রাগ লাগার কথা। কিন্তু কেন যেন লাগছেনা। তার বদলে কষ্ট লাগছে। উপমা কখনো এভাবে কথা বলেনা। আজ রাকিবের সাথেও কথা কাটাকাটি হয়ে গেলো।
এখন উপমাও খারাপ ব্যাবহার করলো। রাকিব সকালের ব্যাচ এ পড়তে চায় আর শ্যামলের বিকেলের ব্যাচেই পড়া চাই। রাকিব আরো রেগে আছে কারণ, শ্যামলের জন্যই ওকে বাসে ঝুলে বাড়ি ফিরতে হচ্ছে। আগ শ্যামল রাকিবের গাড়িতে করেই বাড়ি ফিরতো। দুজন গল্প গুজব করে রাতে যে যার বাসায় যেত।
হঠাত কি হলো, শ্যামল বললো, ও এখন থেকে বাসে করেই বাড়ি ফিরবে।
ভাত খেতে ইচ্ছে করছিলো না দেখে মা জোড় করে খাইয়ে দিলো। শ্যামল গুটিগুটি পায়ে ছাদের কোনায় পাতা মাদুরটাতে শুয়ে পড়লো। ছাদে শুয়ে আকাশের তারা দেখতে ওর খুব ভালো লাগে। রাকিব ক’দিন যাবত নিজেকে একটা প্রশ্ন করছে, ও কি উপমাকে ভালোবাসে?
প্রত্যেকবারই সে জোড়ের সাথে উত্তর পায়, না।
ও উপমাকে বন্ধু হিসেবে অনেক পছন্দ করে, ভালোবাসেনা। কিন্তু বারবার ঘুরেফিরে প্রশ্নটা আসে, কেউ যেন উত্তরটা ঠিক মেনে নিতে পারছে না।
আজ বৃহস্পতিবার। স্যারের বাসায় ক্লাস নেই। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরা যাবে।
তুলির সাথে ভাব হয়ে গেছে উপমার। গতকালের রাগ ধুয়ে গেছে। তবে তুলির এই আসিফের গল্প শুনতে ওর মোটেও ভাল্লাগছেনা। তবু আগ্রহ নিয়ে শোনার ভান করতে হচ্ছে। উপমা কাল শ্যামলের সাথেও বাজে ব্যাবহার করেছে।
ওকেও সরি বলতে হবে।
বাসায় এসে শ্যামলকে ফোন করলো উপমা। ফোন ধরলো শ্যামলের আম্মু।
: আন্টি, কেমন আছেন?
: ভালো মা। শ্যামলকে চাচ্ছো? ও তো মামাবাড়ি গেছে।
: ও... কবে ফিরবে?
: সোমবার। কিছু কি বলতে হবে?
: না আন্টি। রাখি।
শ্যামলের আম্মু ফোন রেখে রাগী চোখে তাকালো শ্যামলের দিকে।
: ছিঃ ছিঃ, তোর জন্য মেয়েটাকে মিথ্যে বললাম।
শ্যামল খাটে শুয়ে শুয়ে পড়ছিলো, বললো,
বেশ তো, তাহলে সত্যি সত্যি চলে যাই। তাইলে তো আর তোমার মিথ্যে বলা লাগেনা।
মা রেগে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।
শ্যামল ভালো গীটার বাজায়। হাসলে ওর গালে টোল পড়ে।
ও যখন স্কুলে পড়তো, বড় আপুরা গাল টিপে দিতো। এখনো মেয়েরা ভাব জমাতে চায়। কিন্তু ওর এসবে পাত্তা নেই। শ্যামল ভাবছে ক্যামিস্ট্রি স্যারের ক্লাসটা সকালেই নিয়ে নেবে। উপমার সাথে তাহলে আর দেখা হবে না।
ক’দিন খুব কষ্ট হচ্ছে ওর। উপমার জন্য অদ্ভুত একটা টান অনুভব করছে। ওর কথা ভাবতে, ওর সাথে অভিমান করতে খুব ইচ্ছে হয়। রাতে রাকিবকে ফোন করলো শ্যামল। অনেকদিন পর আবার দুজন একসাথে হাঁটতে বের হলো।
ওরা যে রাস্তায় হাঁটছে সেখানে জায়গায় জায়গায় ভেঙে পানি জমে আছে। ওরা দুজন পার্কে ঢুকে পড়লো। রাতের পার্ক খুবই জঘন্য। মানুষের ভেতরের নোংড়া দিকগুলো হা করে থাকে এখানে। তবু ওরা দুজন একটা বেঞ্চে বসে পড়লো।
রাকিব: জী স্যার বলেন, কি বলবেন?
শ্যামল: এতো রাগ করছিস কেন?
: রাগ! কোথায় রাগ করলাম? এতো ঢং না করে বল কেন ডেকেছিস।
: তোকে একটা গুড নিউজ দেওয়ার জন্য ডেকেছি। আমরা আগামী মাস থেকে সকালের ব্যাচে ক্যামিস্ট্রি পড়বো।
রাকিব কিছুক্ষন শ্যামলের দিকে তাকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো, তুই কি জানস যে তুই একটা পাগল?আজকে এতো রাতে ডাকছিস এই কথা বলবার জন্য! কালকে বললে কি হইয়া যাইতো?
: দোস্ত, আমি নিজেও জানিনা কেন এমন করি। আমার নিজের উপর কোন কন্ট্রোল নাই।
:আচ্ছা, ঐ দিন আমি এতো কইরা কইলাম, তুই কথা শুনলি না, আজকে কি মনে কইরা?
হুট করে শ্যামলের মুখ ফসকে কথাটা বেড়িয়ে এলো, উপমার জন্য।
: আবার কি হইছে? ঝগড়া করছিস?
: নাহ, ওরে বিরক্ত লাগে।
হা হা করে হেসে উঠলো রাকিব,
: শোন শ্যামল, আজাইরা কথা বলিস না। তোর হাবভাব দেখলে তো মনে হয় না যে বিরক্ত লাগে। ওর হাঁটতে কষ্ট হয় বইলা তুই ঘুমাইয়া ঘুমাইয়া হাঁটস, বাসের লোকদের সাথে ঝগড়া করস, নিকুঞ্জে নাইমা ওরে রিকশায় তুইলা আবার আরেকটা বাসে উত্তরা আসিস,
: তুই কি থামবি?
শ্যামলের আর সকালের ব্যাচে যাওয়া হলো না।
সোমবারের আগে স্যারের বাসায় যাবেনা ঠিক করেছিলো, তাও হলো না। রবিবারেই গেলো। উপমা আজ অনেক কথা বললো শ্যামলের সাথে। কিন্তু শ্যামলের বলা হলো না, যে ও অনেক কনফিউশনে আছে। ও বুঝতে পারছে না, এর নাম কি ভালোবাসা হতে পারে! নাকি এর নাম সহানুভুতি! খুব বেশি এলোমেলো লাগে নিজেকে।
নাহ, আর বলা হয়ে ওঠেনি কথাটা। এখন শ্যামল জাহাঙ্গীর নগরে পড়ে। ও জানে উপমা ইস্ট ওয়েষ্টে পড়ে। উপমার ফোন নাম্বারটাও ও জানে। এখনো মাঝে মাঝে ওকে ফোন করে শ্যামল।
কিন্তু কথা বলে না। কন্ঠ শুনে কিছু জানার চেষ্টা করে ও। অন্য ধরনের এই কষ্টটা শ্যামল আনন্দের সাথেই উপভোগ করে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।