পুরোপুরি সামরিক কায়দায় সংগঠিত হচ্ছেন নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা। সামরিক বাহিনীর আদলে নিচ্ছেন প্রশিক্ষণ। যথাযথ প্রশিক্ষণের জন্য তৈরি করা হয়েছে বিশেষ প্রশিক্ষণ মডিউল, সিলেবাস। পরিবেশ নিশ্চিতের জন্য তৈরি করা হচ্ছে 'ট্রেনিং ইনস্টিটিউট'। আবার ব্যবহারিক প্রশিক্ষণের জন্য এসব ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে বিস্ফোরকসহ অন্যান্য যুদ্ধ উপকরণের
পাশাপাশি মজুদ করা হচ্ছে ভারী আগ্নেয়াস্ত্র।
তবে আপাতত সমতল ভূমিতে প্রশিক্ষণ নিলেও নিবিড় প্রশিক্ষণের জন্য রয়েছে পাহাড়ি অঞ্চল। সম্প্রতি বগুড়া এবং রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রেফতার বিইএম ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) সদস্যদের সঙ্গে উদ্ধারকৃত আলামত থেকে এমনই তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা। অন্যদিকে, এবিটির প্রধান মুফতি জসিমউদ্দিন রহমানীর সঙ্গে মেজর জিয়াউল হক (বরখাস্ত) নিয়মিতভাবে যোগাযোগ করতেন। তার পরামর্শেই সাজানো হয়েছিল এবিটির সামরিক কৌশল, সিলেবাস এবং প্রশিক্ষণ মডিউল। তবে টেকনো দক্ষ না হওয়ার কারণে মেজর জিয়াকে দেওয়া রহমানীর ই-মেইল পাঠানো এবং খোলার কাজ করতেন তারই একজন ঘনিষ্ঠ সহচর।
'স' আদ্যাক্ষরের একজন বই বিক্রেতা এরই সঙ্গে ফোরকান মিডিয়া এবং খুতবা ওয়েব পেইজের প্রশাসক হিসেবে কাজ করতেন বলে জানতে পেরেছেন গোয়েন্দারা। টাস্কফোর্স ইন্টারোগেশন সেলে গোয়েন্দাদের এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন জসিমউদ্দিন রহমানী। এর পর থেকে ওই ব্যক্তিসহ অন্তত পাঁচ জঙ্গিকে হন্যে হয়ে খুঁজছেন গোয়েন্দারা। একই সঙ্গে ব্লগার রাজীব হত্যা মামলায় রহমানীকে সাত দিনের রিমান্ডে নিয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ।
একটি সূত্রে জানা গেছে, মিয়ানমারের আরাকানের উদ্দেশ্যে এবিটি-র অন্তত: অর্ধশতাধিক জঙ্গী যুদ্ধে অংশগ্রহনের জণ্য রওনা দিয়েছিলেন।
তাদের উদ্দেশ্য ছিলো রোহিঙ্গা ও আরাকান মুসলমানদের তিনটি সংগঠনের (আরএসও, এআরএনও ও এআরইএফ) সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করা। এর আগে তারা পর্যাপ্ত সামরিক প্রশিক্ষন নিয়েছিলেন। রাজধানীর বছিলাস্থ রহমানীর আস্তানা থেকে উদ্ধারকৃত আলামতেও ছিলো অস্ত্র বিদ্যা এবং সামরিক প্রশিক্ষনের অনেক মডিউল। এই প্রশিক্ষণ মডিউলের একটি অংশে লক্ষ্যবস্তুর টার্গেট ঠিক রাখতে মাঝেমাঝে এয়ারগান দিয়ে পাখী শিকার করার কথা বলা হয়েছে শিক্ষানবীশ জঙ্গীদের। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার সাইফুল ইসলাম এ প্রতিবেদককে বলেন, তদন্তের স্বার্থে কিছুই বলা সম্ভব হচ্ছেনা।
তবে জসীম উদ্দীন রহমানীকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হলে হয়তো আরো অনেক কিছুই জানা সম্ভব হবে।
এদিকে, র্যাব-১২ এর স্কোয়াড্রন লিডার মোহম্মাদ মিরান হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, বগুড়া ঠনঠনিয়া থেকে উদ্ধার করা কাগজপত্র যাচাই করে দেখা যায়, জেএমবির আদলেই 'বিইএম'-এর কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। প্রতিদিন ভোর ৪টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত ১৯ ঘণ্টার প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো সেখানে। আর তাদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচিও কিছুটা সামরিক বাহিনীর আদলে তৈরি করা।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, বগুড়া থেকে উদ্ধার করা বিভিন্ন জেহাদি বই ও কাগজপত্র থেকে র্যাবের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা ধারণা করছেন, আফগান যুদ্ধ ফেরত এক মুজাহিদ এ প্রশিক্ষণের প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করছিলেন, যেমনটি হয়েছিল জেএমবি'র ক্ষেত্রেও।
গত বছরের শেষের দিকে বান্দরবনের গহীন অরণ্যের একটি ঘাঁটি থেকে 'জামাআতুল আরাকান' নামের একটি জঙ্গী সংগঠনের নয় সদস্যকে গ্রেফতার করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা। ওই সংগঠনটির বেশীরভাগই জেএমবি এবং হুজি'র সদস্য ছিলেন।
এদিকে, ব্লগার রাজীব হায়দার হত্যা মামলায় উগ্রপন্থি সংগঠন 'আনসারুল্লা বাংলা টিমের' প্রধান মুফতি জসীম উদ্দিন রাহমানীকে সাত দিন রিমান্ডে নেওয়ার অনুমতি দিয়েছেন আদালত।
গতকাল মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির পরিদর্শক মাইনুল ইসলাম আসামিকে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করে দশ দিন রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করেন। এ সময় আসামির আইনজীবী রিমান্ড বাতিল করে জামিনের আবেদন করেন।
শুনানি শেষে ঢাকা মহানগর হাকিম হারুন অর রশীদ রিমান্ডে নেওয়ার এই আদেশ দেন। রিমান্ড আবেদনে বলা হয়, 'ব্লগার রাজীব আহমেদ হত্যার ইন্ধনদাতা হলেন আনসারুল্লা বাংলা টিমের প্রধান মুফতি জসীম উদ্দিন। তার পরিকল্পনা ও সহযোগিতায় ব্লগার রাজীবকে হত্যা করা হয়েছে। আর মামলার রহস্য উন্মোচনের জন্য তাকে রিমান্ডে নেওয়া প্রয়োজন। ' শুনানিতে আসামি পক্ষের আইনজীবী সোহরাব হোসেন মোল্লা আদালতকে বলেন, আসামি জসীম উদ্দিনকে অন্যায়ভাবে এ মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করা হয়েছে।
তার রিমান্ড আবেদন বাতিল করে জামিন দেওয়া হোক।
গত ১৫ ফেব্রুয়ারি শাহবাগ তরুণ প্রজন্মের আন্দোলনের অন্যতম উদ্যোক্তা স্থপতি ব্লগার রাজীবকে রাজধানীর মিরপুরে তার নিজ বাসার সামনে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। গত ১২ আগস্ট বরগুনার দক্ষিণ খাজুরতলা এলাকায় গোপন বৈঠক করার সময় আনসারুল্লার প্রধান মুফতি জসীমসহ ৩১ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। আর জসীম উদ্দিনের কার্যালয় থেকে পুলিশ ১২ জনের ছবিসহ একটি তালিকা উদ্ধার করে। যাদের সবাইকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়েছিল বলে জানা গেছে।
আর এই ১২ জনের ছবিসহ যে তালিকা তাতে নিহত ব্লগার রাজীব হায়দার ও হত্যা চেষ্টার শিকার ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিনের ছবি রয়েছে। গত ১৪ জানুয়ারি উত্তরায় হামলার শিকার হন ব্লগার আসিফ মহীউদ্দিন। মাওলানা জসীম রাজীব হায়দার হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিলেন তা এ মামলার পাঁচ আসামি আদালতের কাছে স্বীকার করেছেন।
গোয়েন্দা নজরদারী এড়াতে তারা পাহাড়ী এলাকা বেছে নিয়েছিলো বলে গোয়েন্দাদের জানিয়ছিলো। তাদের কাছ থেকে তখন জামাআতুল আরাকানের সাংগঠনিক কাগজপত্র, পুস্তিকা, ব্যবহৃত ডায়েরি ও এবং তাদের প্রকাশিত আত-তাহ্রিদ নামের একটি পত্রিকা উদ্ধার করা হয়।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জঙ্গিরা জানিয়েছেন, তাঁরা 'ইসলামি রাষ্ট্র' প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে নতুন নামে সংগঠিত হচ্ছিলেন। জিহাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য তাঁরা ভারত-পাকিস্তান হয়ে আফগানিস্তানে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
এর কিছুদিন আগে সিরাজগঞ্জ থেকে র্যাবের হাতে গ্রেফতারকৃত জেএমবি'র অর্থ সম্পাদক ও আমীর মাওলানা সাইদুর রহমানের শ্যালক মোহতাসিম বিল্লাহ্-র কাছ থেকে চাঞ্চল্যকর তথ্য পায় গোয়েন্দারা। তখনই সে জানিয়েছিলো গোয়েন্দা চোখ ফাঁকি দিয়ে জেএমবি সদস্যরা এবার গহীণ অরন্যে বিদেশী এসকেএস (রুশিয় গান), এম-১৬, ক্লাশিনকোভ (একে-৪৭), নাইন এমএম, টিটি পিস্তল, ১২ বোর রাইফেলসহ সাত ধরণের হাল্কা, মাঝারী ও ভারী অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। এর পাশপাশি বিভিন্ন ধরণের বোমা তৈরী এবং নিক্ষেপের প্রশিক্ষণ কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
প্রশিক্ষনের জন তাদের প্রথম পছন্দের স্থান হচ্ছে খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, চট্টগ্রাম, ও কঙ্বাজারের কিছু এলাকা।
এদিকে, সিরাজগঞ্জ এবং সর্বশেষ বগুড়া বিইএম -এর আস্তানা থেকে উদ্ধারকৃত আলামত ঘেঁটে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন, প্রাপ্ত কাগজপত্র থেকে জানা যায়, জঙ্গীরা প্রতিটি অস্ত্র পেনসিল দিয়ে কাগজে এঁকে এর বর্ননা, বৈশিষ্ট্য, অস্ত্রের ধরণ, কোন অস্ত্রের কোন প্রকার ম্যাগজিন, গুলির সংখ্যা কত? এর কার্যকরী রেঞ্জ, গতিবেগ এর সাবধনতা সম্পর্কে ব্যাখা দেয়া রয়েছে। এ ছাড়াও কি ধরণের অস্ত্র কোন স্থানে ব্যবহার এর ও বর্ননা দেয়া হয়েছে। সাধারণ মানুষ ও গোয়েন্দাদের চোখ ফাঁকি দিতে সাংকেতিক ভাষা হিসেবে আগ্নেয়াস্ত্রকে 'ছামান' ও গুলিকে 'ক্যাপসুল' বলে জঙ্গীরা।
ট্রেনিং মডিউলে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের মতো জঙ্গীদের ম্যাপ রিডিং এর গুরুত্ব দেয়া হয়।
শেখানো হয় সাংকেতিক চিহ্ন এবং অবস্থানের দূরত্ব নির্ণয়ের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় জ্ঞান।
একটি ট্রেনিং মডিউলে ইন্টারোগেশনের কৌশল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, 'গ্রেফতার হলে তুমি সরাসরি না বলবা না। এতে জিজ্ঞাসাবাদকারী কর্মকর্তা রাগান্বিত হবেন। এজন্য বানিয়ে কিছু বলে দাও। ' জিজ্ঞাসাবাদকারী কর্মকর্তার আচার-আচরণ বুঝে উত্তর দেয়ার ব্যাপারে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
সংগঠন এবং কাজের প্রয়োজনে মিথ্যে বলাও কোন অন্যায় নয়।
স্কোয়াড্রন লিডার মীরন আরো জানান, গ্রেফতারকৃত রুবেলের বাড়ী ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ায়। শফিউল্লার নাম সানাউল্লাহ। তার বাড়ী দিনাজপুরের শাহ্জাহানপুর। বিইএম এর প্রশিক্ষন মডিউলে অনেকটাই জেএমবি'র আদলে তৈরী বলে তারা নিশ্চিত হয়েছেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।