পরাঞ্জয়ী...
আজ হঠাৎ অনেক পুরোনো সেই ছন্নছাড়া অনুভূতিটা পিছু নিল লীনার। ক্লাস করে বের হয়ে কলাভবনের নীচে কিছুক্ষন বসে থাকলো। কতজন ওকে দেখছে। ওর কোন খেয়াল নেই সেদিকে। অফিস ৬ টা থেকে।
লীনা ঘড়ি দেখে। এখন মাত্র ২ টা বাজে। দুপূরে খাওয়া হয়নি। খাওয়ার কথা মনে পড়তেই ডান হাতটা পেটে চলে গেল। "আচ্ছা পেটে হাত দিয়ে কি বোঝা যায় ক্ষুধা পেয়েছে কিনা? মনেরও তো ক্ষুধা লাগে, কিন্তু মনকে হাত দিয়ে ছোঁয়া যায়না যে!" ভাবে সে।
মানুষ এত অদ্ভূত চিন্তাও করে! ব্যাগ হাতড়ে সেল ফোনটা বের করলো। তৌফিক কে একটা ফোন করবে। মিনিটে ২১ টাকা খরচ। "তাতে কি!" ভাবে লীনা। নাম্বারটা মূখস্থই ছিল ০০৪৭****৭৬।
ওপাশে রিং হওয়ার শব্দ পাচ্ছে সে। ফোনটা ধরলো না কেউ। আরেকবার দিতে গিয়ে দিলনা সে। হঠাৎ ছোট একটা বাচ্চা ঝুড়ি তে কয়েকটা চকলেট নিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল। "আপা ২ ডা চকলেট ন্যান, ভাত খামু" বলে যায় বাচ্চা মেয়েটা।
লীনা ওর দিকে তাকায়। লাল রঙের একটা পাজামা পরা। ওপরে একটা গেঞ্জি জাতীয় কিছু, তার উপর লাল আর সাদা ডোরা একটা সোয়েটার। লীনার হঠাৎ মনে পরলো প্রায় ২০ বছর আগে লীনার এমন একটা সোয়েটার ছিল। ঠিক এরকম।
আজ ২০ বছর পর এসে সেই একই বয়সে এই মেয়েটিও সেই গরম কাপড় টা গায়ে তুলেছে যা অন্যদের কাছে ভীষণ সেকেলে আর ক্ষ্যাত বিশেষণে খুব সহজেই সংজ্ঞায়িত হবে! তবে কি এদের জীবন লীনাদের থেকে ২০ বছর পিছিয়ে থাকে সব সময়?! লীনা ভাবতে থাকে। মেয়েটি আবার বলে "আপা ২ ডা চকলেট ন্যান না, ভাত খামু" । লীনা বলে "২ টাকায় তোর ভাত খাওয়া হবে?" "হইব আপা" উত্তর দেয় তড়িৎ। লীনা বলে "চল তোকে ভাতই খাওয়াই"। বাচ্চা টিকে সাথে নিয়ে লীনা হাকিম চত্ত্বরে চলে যায়।
এক প্লেট খীঁচূড়ি আর সাথে একটা চপ নিয়ে মেয়েটিকে দেয়। দেখাদেখি আরও ২ টা বাচ্চা দৌঁড়ে এল। লীনা ওদেরও ২ প্লেট দিল। ১০৫ টাকা বিল দিয়ে লীনা ওদের পাশেই বসে পড়লো। কি তৃপ্তি নিয়ে যে খাচ্ছে ওরা।
লীনা বাঁ হাতের উপর গাল ঠেকিয়ে বসে বসে ওদের রাক্ষুসে খিদের রসনা মেটানোর দৃশ্য দেখছিল! লীনা নিজের মনটা ছুঁয়ে দেখলো। হ্যা পেট ভরছে মনের,খীদে মিটছে তার!
ওদের খাওয়া শেষ হলে লীনা উঠে রিকশা নেয়। রিকশাওয়ালা জিজ্ঞেস করে "কই যাবেন আপা?" লীনা জবাব দেয় "জানি না"। সে আবার জিজ্ঞেস করে "কই যাবেন"। লীনা এবার জবাব দেয় "আজিমপুরের দিকে যান"।
রিকশা ওয়ালা রিকশা টানে। স্বাধীনতা সংগ্রামের সামনে গিয়ে লীনা হঠাৎ বলে "শহীদ মিনারে যান" রিকশা ভাড়া মিটিয়ে লীনা একপাশে গিয়ে বসে। হেডফোন লাগিয়ে গান শুনতে শুরু করলো। শ্রীকান্তের "আমার সারাটা দিন মেঘলা আকাশ, বৃষ্টি তোমাকে দিলাম.......................। " লীনার হাসি পায়।
নিজের বুকে খরার আগুন জ্বালিয়ে আর কাউকে বৃষ্টি দান করবার বোকামিটা কি খুব প্রয়োজন?! অনেকক্ষন বসে থাকলো সে। আবার বিরক্তি এসে গেল। আবার রিকশা নিল। শাহবাগ মোড় পর্যন্ত রিকশা ঠিক করলো। কেন যে এখানে এল তা বোধ হয় লীনা নিজেও জানেনা।
খামাখা ২০ টা গোলাপ ফুল কিনলো। কি করবে এখন ফুল গুলো নিয়ে? ছোট ছোট মেয়েগুলো যে হাতে করে ফুল বিক্রি করে রাস্তায় তাদেরই একজন কে ডেকে ফুল গুলো দিয়ে দিল সে। কেন জানি এই ভীষণ পাগলামিটা লীনার খুব ভাল লাগছে! রমনা পার্কে ঢুকলো সে। ঘুরতে ঘুরতে রমনা রেস্টুরেন্টে ঢোকে লীনা। ঐ তো সেই টেবিলটা।
ডান দিক থেকে দ্বিতীয় সারির তৃতীয় টেবিলটা! এখানে বসেই ২ বছর আগে প্রথম দেখা হয়েছিল আসিফের সাথে। সেই সন্ধ্যা যে লীনার জীবনের কাল সন্ধ্যা হবে তা কি ভেবেছিল সে? লীনাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওয়েটার এসে বলে " বসুন ম্যাম"। লীনা দিব্যি মুখের ওপর বলে ওঠে " ঐ টেবিলটা খালি করে দেন তারপর বসবো" লীনা যে মোটেও মজা করছেনা তা তার চেহারাই বলে দেয়। ঐ টেবিলে বসা ২ টি ছেলে আর একটি মেয়ে। ওরা শুনতে পায় লীনার কথা।
লীনা এগিয়ে গিয়ে বলে "আপনারা কষ্ট করে অন্যটাতে যাবেন? এই টেবিলটার সাথে আমার অনেক বোঝাপোড়া আছে!" ওরা অবাক হয়। এমনকি লীনার মানসিক স্বাস্থ্য নিয়েও ওদের সন্দেহ হয়! ওরা উঠে পাশের টা তে যায়। লীনা ঠিক সেই অর্ডার গুলো দেয় যা সেই অভিশপ্ত সন্ধ্যা তে দিয়েছিল। যথা সময়ে খাবার আসে। লীনা ছুঁয়েও দেখেনা।
সেই তিনজন আড়চোখে দেখে লীনাকে! লীনা লক্ষ্য করেনা! সব পড়ে থাকে টেবিলে। বিল দেয়ার সময় ওয়েটার বলে "পার্সেল করে দেব ম্যাম?" লীনা মাথা নেড়ে সায় দেয়।
পার্সেল টা নিয়ে বের হয় যখন তখন ঘড়িতে ৫ টা বাজে। একটা সি এন জি নিয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় লীনা। রেঁস্তোরার পার্সেল দেখে সহকর্মীরা মজা করে।
লীনা ওদের দিকে বাড়িয়ে দেয় খাবার গুলো। তারপর নিজের কাজে মন দেয়। কাজের ফাঁকে ফাঁকে লীনা মাথা উঁচু করে কি যেন ভাবছিল। পরশু দিন আসিফকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল লীনার। চুপ করে একটা বোরখা জোগাড় করে আসিফের অফিসে গিয়েছিল সে।
আসিফের সেই ব্লেজারটা পরা ছিল, লীনার খুব পছন্দের! আসিফ জানতেও পারেনি কেউ একজন তারই দৃষ্টির আড়ালে দাঁড়িয়ে তাকেই দৃষ্টিবন্দী করছে। সেই কথা ভেবে এখন ভীষণ অপ্রস্তুত লাগে লীনার। হঠাৎ করেই আসিফকে খুব ঘৃনা করতে ইচ্ছে করে লীনার। ভীষণ ভালবাসার উল্টোপিঠে থাকা প্রচন্ড ঘৃনা আজ প্রথম বারের মত নিজের অস্তিত্বকে জানান দেয়! লীনার বুকের মধ্যে এক অভাবনীয় আনন্দ উথলে ওঠে। ভেঙে যাবেনা লীনা।
ভালবাসা সে অনুকূল হোক কিংবা প্রতিকূল, সে কখনও ভাঙতে পারেনা! সে শুধু গড়ে, শুধু গড়ে তোলে!
সেল ফোন টা বেজে ওঠে। নাম্বার টা দেখে বোঝে এটা তৌফিকেরই ফোন। কথা বলার সুযোগ হওয়ায় খুশিই হয় লীনা।
(চলবে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।