পরাঞ্জয়ী...
গতকাল ঢাকায় ফিরেছে লীনা। আসার পথে বাসের জানলা দিয়ে তাকিয়ে ছিল একদৃষ্টে। সরিষার ক্ষেতে যেন আগুন লেগেছে! লীনার মন চলে গেল দু'বছর আগে। বিয়ের মাত্র ক'টা দিন বাকী। একদিন আসিফ ফোন করে লীনাকে বললো "আমি এখন কোথায় জানো? সরিষার ক্ষেতে! চারদিকে হলুদ আর হলুদ" লীনার আহ্লাদ বেড়ে উপচে পড়ে "ছবি তুলে রাখ, আমি দেখব!" আসিফ ছবি তুলে লীনা কে দেখায় বিয়ের পর।
সেই দিন গুলো আজ জিভ ভেংচে ওকে তিরস্কার করে! সামনের সীটে বসা একটা ছেলে আর একটা মেয়ে। স্বামী-স্ত্রীই হবে। মেয়েটি ঘুমিয়ে পড়েছে। বাতাস আসে জানলা দিয়ে। ছেলেটি জানলা টা বন্ধ করে দেয়।
ঘুম ভেঙ্গে যায় মেয়েটির, ঢুলু ঢুলু চোখে তাকায় সে! সে তার মাথা টা ছেলেটির কাঁধে রেখে ঘুমিয়ে যায় আবার। লীনার বুক টা খাঁ খাঁ করে। এমনি দূর পাল্লার ভ্রমণে সেও আসিফের কাঁধে মাথা রেখে থাকত। আসিফের বড্ড বিরক্ত লাগতো জানলা খোলা দেখে,আটকে দিত। একটু পর আবার খুলে দিত লীনা।
নিজের প্রতি আসিফের এই মমতা টুকু লীনা উপভোগ করতো! লীনার ঠান্ডা লাগবে এই ভেবে জানলা আটকে রাখার প্রচেষ্টা টুকু ছিল লীনার কাছে স্বর্গীয় সুখ ছিল, আসিফ তা বুঝত না! কাঁধে মাথা রাখলে আসিফ মাঝে মাঝে বলতো "কি করছো? সবাই দেখছেনা?" লীনা শুনতনা, আরও কাছে গিয়ে বলতো " দেখুক! কাউকে আমি ভয় পাই? আমি কি অন্যের জিনিসে মাথা রেখেছি? আমার টার উপরেই রেখেছি!" সেই "আমার" দাবীর মধ্যে কি যে অনন্ত সুখ তা কি আসিফ কোনদিন টের পেয়েছিল?! আজ কোথায় আসিফ? "ইস, একটাবার যদি পেতাম! বড্ড ক্লান্ত আমি! কোথায় রাখব মাথাটা?"!
লীনা চেয়ে থাকে বাইরে। গাছগুলোকে ছুটে চলা ট্রেনের বগির মত দেখায়। বাস থেমে যায়। সামনেই ব্রীজ একটা। নদীর মাঝখানে কিছু ছোট ছোট ডিঙ্গী।
একপাশে ঘাট বানানো। মাথার আঁচল ফেলে গোসল করছে এক গ্রাম্য বধূ। হাতের একপাশ খোলা। ফরসা শরীরের একাংশ বের হয়ে চকচক করছে! ব্লাউজের হাতা যে পর্যন্ত থাকে তার নীচ থেকে হাতটা ক্রমশঃ কালচে! সদ্য খোলা ব্লাউজে সাবান মেখে বারংবার সেই কালচে অংশে ঘষে যাচ্ছে সে। যদিবা আরেকটু চড়ে রংটা! তারই অনতিদূরে একটা লোক সিগারেটে সুখটান দিচ্ছে, মাঝে মাঝে চেয়ে দেখছে মহিলাটি কে! বেশ কিছুটা দূরে শেওলা গুলো ইতস্তত ভাসছে।
হাঁসগুলো সাঁতরে তারই মধ্যে মুখ গুঁজে কি যেন খুঁজেই চলেছে, পাওয়া আর কিছুতেই হয়ে উঠছে না তাদের! আরেক পাশে লাঠির মাথায় জাল বেঁধে দুই জন সেটা বারবার ডুবায় আবার উপরে তোলে। মাছ পড়ছে কিনা সেটা ঠিক বোঝা গেলনা! হর্ণ বাজে হঠাৎ। লীনার চমক ভাঙ্গে। এত নিমগ্ন হয়ে কি যে দেখছিল সে তাই ভাবে!
ঢাকায় এসে লীনার মনে হয়, বাতাসে কার্বণ-ডাই-অক্সাইডের পরিমান টা বোধ হয় বেশি হয়ে গেছে! নয়ত এমন শ্বাস নিতে কষ্ট হতনা ওর! ঘরে পা রেখেই মনে হয় সমস্ত দরজা জানলা গুলো ওকে বলছে "নেই নেই নেই"। কি নেই তা বুঝেও মানতে চায়না লীনার মনটা! দরজায় এসে কলিং বেল টা চেপেই মনে হয়েছিল "ইস যদি আসিফ দরজা টা খুলে দিত!" এই সেই বিছানা।
এখানেই কত খুনসুটি, কত বিবাদ, কত মীমাংসার স্মৃতি! কত ঝড় তোলা চূম্বনের বিষাক্ত মুহূর্ত! আয়নার সামনে দাঁড়ানো লীনাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরত আসিফ! আয়নাটা এখনই সেই দৃশ্য দেখাল লীনাকে! তারপর হিংসুটের মত হেসে বললো "সব কেড়ে নিয়েছি, কিছুই নেই তোর" এই তো সেই পুতুল টা। খুব আদর করে লীনা যার নাম রেখেছিল "তুলতুল"। আসিফ লীনাকে ক্ষেপাতে মাঝে মাঝে তুলতুল কে চুমু দিত। অবুঝ লীনা সেই চালাকি না বুঝে নিথর জড় পুতুলটাকেও ঈর্ষা করতো! সেই বালিশ দুটো সেভাবেই আছে। লীনার বালিশ লাগতোনা।
দুটো বালিশই মাথায় দিত আসিফ। লীনা মাথা দিত আসিফের ডান হাতে! আসিফ প্রায়ই বলতো "আমাদের ছোট্ট একটা বিছানাতেই চলে। খামাখা এত বড় খাটের ব্যবস্থা!"
ঐ তো আসিফের শার্ট, ফতূয়া গুলো। এগুলো নিয়ে যেতে ভুলে গেছে হয়ত। না কি লীনাকে শাস্তি দিতে রেখে গেছে।
লীনার একটা চাদর আসিফ গায়ে দিত মাঝে মাঝে। চাদরটা বিছানার উপর ফেলে রাখা। লীনা চাদরটা মুখে চেপে ধরে। আসিফের গন্ধ পায় সে! বারান্দার মানিপ্লান্ট গাছের গোড়ায় মাটি ভেঁজা। আসিফ রোজ পানি দিত ওতে।
পরশু নিজের সবকিছু নিয়ে যাবার সময় বোধ হয় শেষবার পানি দিয়ে গেছে। না' লীনা আর পানি দিবেনা ওতে! মরে যাক, শুকিয়ে যাক! লীনা এক ঘর থেকে আরেক ঘর যায়। ভুতূড়ে হাসি ছড়িয়ে আছে সমস্ত বাড়িটায়! চিৎকার করে ডাকতে চায় লীনা "আসিফ?! ফিরে এস! নয়ত নিয়ে যাও তোমার সব স্মৃতি। আমাকে দেয়া তোমার সমস্ত স্বার্থপর সুখগুলোকে নিয়ে যাও। " হু হু করে লীনার বুকটা! গোসলের নাম করে বাথরুমে ঢোকে সে! পানি ছেড়ে দিয়ে কাঁদতে থাকে! লোকালয়ে আসিফের জন্য কাঁদবারও অনুমতি নেই লীনার! ওর ছোট্ট মন থেকে বাইরে এসে আসিফ এখন অসীমে ঠাঁই নিয়েছে।
কি করে ভুলবে লীনা তাকে?!
গোসল থেকে বের হয়ে লীনা দেখে ভীষণ ঠান্ডা লাগছে! মা গায়ে হাত দিয়ে দেখেন জ্বর। ছোটবেলা থেকেই কারও জন্য মন পুড়লে জ্বর বাঁধায় লীনা। আর এখন তো রাশি রাশি ছাই এর ভীড়ে সে তার মন টাই খুঁজে পায়না! বাবা যখন লীনা কে মা বলে ডাকত সে জগতের সকল যন্ত্রনা ভুলে যেত। এখন তবে ভুলছে না কেন?! বাবার "মা" ডাক শুনেও যে তৃষ্ণা মেটেনা, সে কোন জ্বালা? বাবা মুখে তুলে খাইয়ে দেয়! কেমন করে বলবে মুখের সে খাবার গলার নীচে কিছুতেই যেতে চায়না ওর! উহ! সেই সোফাটা তেই বসে খাচ্ছে সে। এইখানে ওরা দু'জন জড়াজড়ি করে শুয়ে টেলিভিশন দেখেছে কতদিন! আজ আর কোন বিবাদের স্মৃতি মনে পড়ে না কেন লীনার? এত সুখস্মৃতি কেন সামনে আসছে? বাবার স্নেহ, মায়ের আদর কোনকিছুতেই মন ভরেনা! তবে কি স্বার্থপরের মত এতদিন লীনা সব ভুলে শুধু আসিফকেই ভালবেসেছে? আজ তারই শূন্যতায় চোখের সামনে দাঁত খিঁচিয়ে অনুভূতিগুলো বলে যাচ্ছে ওর সেই অন্ধ ভালবাসার কাহিনী? এ কোন মরণ জ্বালা যা বাবা মায়ের ভালবাসাকেও তুচ্ছ করে দেয়! এ কি সম্ভব? তাই বুঝি সম্পর্কের নামটি এমন হয়েছে।
জীবনের সাথে জড়িত অন্য যে কারও সন্তুষ্টির প্রয়োজনেও যাকে পরিত্যাগ করা যায়না, তার নামই "জীবনসঙ্গী"! তবে কি লীনা আসিফের জীবনসঙ্গী ছিলনা। না কি গোড়াতেই মস্ত গলদ করে বসে আছে সে?!
পায়চারী করতে থাকে লীনা। চোখ পুড়িয়ে জ্বর বাড়তে থাকে। কে যেন তাড়িয়ে বেড়ায় ওকে! ঝড় উঠছে আজ! সেই তান্ডবে বিধ্বস্ত লীনা শ্বাস নেবার জন্য খোঁজে এক চিলতে স্বস্তির বাতাস!
(চলবে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।