আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ইশ্বর হত্যার কৌশল

অতি দক্ষ মিথ্যুক না হলে সত্যবাদিতা উৎকৃষ্ট পন্থা

আলোচনার শুরুটা মনির হাসানের একটা লেখায়, যার বিষয়বস্তু ছিলো ধর্মের সাম্ভাব্য ভবিষ্যত , আলোচনা অনেকটা পথ এগিয়ে গিয়েছে, অনেক রকম অনুমাণ এসেছে, বিতর্ক হয়েছে এবং সে বিতর্কে যারা অংশগ্রহন করেছে তাদের সবাই নিজের অবস্থান থেকেই সাম্ভাব্য ভবিষ্যতবানী করেছে। সেখানে আলোচনার একটা অংশ ছিলো ধর্মের উৎপত্তি এবং বিকাশ। ধর্ম সামাজিক সংস্কৃতির সুসংবদ্ধ রূপ অথবা ধর্ম অলৌকিক কোনো ঐশী অনুপ্রেরণা? ধর্ম কি সামাজিক প্রেক্ষাপট থেকে উদ্ভুত হয়, সেখানে অর্থনৈতিক সম্পর্কগুলো কেমন থাকে। নাস্তিকের ধর্মকথার অবস্থানটুকু আমার অবস্থানের অনেক কাছাকাছি। কিঞ্চিৎ দ্বিমত আছে হয়তো তবে সেগুলো বাদ দিলে নাস্তিকের ধর্মকথার যৌক্তিক অবস্থানটুকুকে মেনে নিতে হচ্ছে।

সত্য এক এবং অভিন্ন নয়, বরং সত্য সবসময়ই ব্যক্তিনির্ভর একটি প্রপঞ্চ। সত্যের সাথে ব্যক্তি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ব্যক্তি যতটুকু গ্রহন করতে পারে সেটুকুই সে ব্যক্তির জন্য সত্য। আমি গত কয়েকদিন ঠিক ঘুমাতে পারছি না, শরীর ঘুম চাইছে, কিন্তু নির্দিষ্ট একটা সময়েই আমাকে উঠতে হয়, সুতরাং আমি যখন ঘড়ির এলার্ম শুনে সচেতন হই তখনও আমার মস্তিস্ক ঘুমের প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারে না, খানিকটা সময় লাগে সচেতন হতে। তবে সেই আধোঘুম এবং আধোজাগরণের সময়টুকুতেও মস্তিস্ক সচল থাকে।

ঘুমের অবশিষ্ঠাংশ তখনও মস্তিস্কের নিউরণে লেগে থাকে বলেই গতকাল হঠাৎ করেই অদ্ভুত একটা দৃশ্যের মুখোমুখী হলাম। হঠাৎ করেই আমার ঘরের দেয়াল সরে গেলো অনেক দুরে, অসংখ্য মানুষের আনাগোনা দেখলাম সেখানে। আমি সচেতন এবং অসচেতন, একই সাথে আমি দেয়াল এবং সেই দেয়াল ভেদ করে চলাচল করা মানুষগুলোকে দেখছি, তাদের চেহারা স্পষ্ট হচ্ছে না আমার কাছে। কিছু সময় পর এই ঘোর কেটে গেলো, আমি পরিপূর্ণ সজাগ হয়ে উঠলাম এবং বিছানা না ছেড়েই ভাবতে বসলাম এটা কি অতিলৌকিক কোনো নিদর্শন, আমার কি এখন স্বপ্নে পাওয়া মহৌষধের বিপনন শুরু করা প্রয়োজন? কিংবা আমার কি এখনও কোনো দরগা শরীফ খুলে দেওয়ানবাগী হুজুরের ব্যবসায় হানা দেওয়া প্রয়োজন? সৌভাগ্যবশত আমি এমন অলৌকিকত্ব বিশ্বাস করি না এবং আমি এটার কার্যকরণ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবহিত না হলেও কিঞ্চিৎ পড়াশোনার সুবাদে জানি আমাদের দৃশ্যগুলো বাস্তব নয় মোটেও। আমাদের দৃশ্যমান জগত অনেকটা মস্তিস্কের প্রতিক্রিয়া, সেখানেই যাবতীয় তথ্যগুলো বিশ্লেষিত হয় এবং সেই বিশ্লেষিত তথ্যগুলো যখন আমাদের সচেতন মস্তিস্কে চলে আসে, এইসব ইলেক্ট্রোলাইটস আমাদের যে অনুরণন দেয় আমরা সেটাকেই বাস্তব দৃশ্য হিসেবে প্রত্যক্ষ করি।

মস্তিস্ক বেশ জটিল একটা প্রত্যঙ্গ এবং সেই প্রত্যঙ্গ এত দ্রুত এইসব অনুসিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে যে আমাদের কিঞ্চিৎ দৃষ্টিভ্রম হলেও সেটা আমাদের ইলেক্ট্রোলাইটস ইমব্যলেন্সের কারণে ঘটলো না কি আমাদের দর্শণের উদ্দীপনা তৈরি করে মস্তিস্কের যে অংশ সেখানের কোনো ত্রুটির জন্য ঘটলো এটা নির্ধারণ করা প্রায় দুসাধ্য কোনো রকম পরীক্ষানিরীক্ষা না করে। আমাদের যাবতীয় রুপ রস গন্ধ স্পর্শ্ব-স্বাদ এবং অন্য সব অনুভবও আসলে এমনই অভিজ্ঞতার আলোকেই নির্মিত হয়। আমাদের প্রতিটা ইন্দ্রিয়ই কিছুটা হলেও মস্তিস্কে তার ছাপ রাখে, আমাদের প্রতিটা গন্ধকে আলাদা করে চিহ্নিত করতে হয়, আমাদের যেকোনো অনুভব এবং অনুভুতি আসলে পূর্ববর্তি কোনো ক্রিয়ার পুনরূৎপাদন প্রকল্প, কোনো রকম পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকলে আমাদের নিজস্ব বিশ্লেষণী শক্তি পরাজিত হয়। সেটা সুর কিংবা রূপ কিংবা গন্ধ যাই হোক না কেনো, আমরা যদি সেটাকে কিংবা সেটার জন্য উদ্ভুত মস্তিস্কের সিগন্যালকে সংজ্ঞায়িত না করি তবে সেটা আমাদের অপরিচিত। আমরা গোলাপ আর হাস্নুহেনার গন্ধকে আলাদা করতে পারি, কাঁঠালচাপার গন্ধের সাথে কামিনী ফুলের গন্ধকরে গুলিয়ে ফেলি না, কাছাকাছি যেকোনো উদ্দীপনাই আমাদের এদের সংজ্ঞার সাথে পরিচিত করে দেয়, সুতরাং আমরা তুলনা করি, এবং যেটার তুলনা অধিকতর কাছাকাছি হয় আমরা সেটাকেই নির্দিষ্ট ধরে নেই।

স্বাদের ক্ষেত্রেও একই রকম বক্তব্য দেওয়া যাবে, এমন কি আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য যেকোনো অনুভবকেই আমরা এমন ভাবেই সংজ্ঞায়িত করেছি আশৈশব, সুতরাং আমাদের ভবিষ্যত অভিজ্ঞতা মূলত এইসব পূর্ব অভিজ্ঞতার সাথে নতুন সংবেদনকে আলাদা করতে শেখার কৌশল। আমরা যতদ্রুত এই কৌশল আয়ত্ব করতে পারি আমরা তত বেশী স্মার্ট। ধর্মালোচনায় এটার উপস্থিতি আদতে শুধুমাত্র সত্যের অনন্যতার বুঝানোর জন্য, প্রতিটা একক মানুষের মস্তিস্ক একই রকম ভাবে উদ্দীপ্ত হয় না। বরং একই গন্ধে প্রত্যেকের শরীর ভিন্ন ভাবে সাড়া দেয়, তারা প্রত্যেকেই একই উদ্দীপনার মুখোমুখী হচ্ছে এবং আলাদা আলাদা রাসায়নিক উদ্দীপনা পাচ্ছে, এভাবেই মানুষ এবং মানুষের ভেতরে তফাত তৈরি হয়ে যাচ্ছে। তাই শেষ পর্যন্ত বাস্তবতা এবং সত্য চুড়ান্ত বিবেচনায় ব্যক্তিনির্ভর হয়ে যাচ্ছে।

ব্যক্তির ধারণ ক্ষমতার উপরে নির্ভর করবে সত্যের স্বরূপ। সত্যের একটা মাত্র মুখোশ নেই বরং সত্য বহুরুপী, আমার কাছে যা সত্য সেটা অন্য সবার কাছে সত্য নয়, ব্যক্তিগত জীবনচর্চা, ব্যক্তিগত বিশ্লেষণ এবং ব্যক্তিগত অনুভবের জায়গা থেকে আমি যেসবকে অবশ্যপালনীয় ভাবি, যেসবকে বাস্তব মেনে নেই এবং যেসবকে আমার নিয়ন্ত্রনের বাইরের কিছু ধরে নেই সেটা অন্য একজনের সাথে আমার পার্থক্য নির্ধারণ করে এবং একই সাথে সেটাই তার সত্যের সাথে আমার সত্যের পার্থক্য নির্ধারণ করে দেয়। সুতরাং সত্য বিষয় অনপেক্ষ কিছু নয়, ব্যক্তিঅনপেক্ষ কিছু নয়, বরং এইসবের সাথে ব্যক্তি এবং ব্যক্তিগত জীবনচর্চা জড়িত। প্রযুক্তির ব্যবহার এবং প্রযুক্তির বিশ্লেষণের তথ্য দিয়ে হয়তো কিছুটা আন্দাজ করা যাবে আধুনিক সময়ের সাথে অতীতের পার্থক্য এবং সেই সাথে আমাদের অনুভবের বিবর্তনটুকুও ধারণ করা যাবে। নির্দিষ্ট এক শ্রেণীর মানুষ আছে যারা কম্পিউটারের হার্ডওয়ার সম্পর্কে অগাধ জ্ঞান রাখে, তাদের আমরা একটা নির্দিষ্ট শ্রেণীবদ্ধ করি, এর সাথে একদল মানুষ আছে যারা হার্ডওয়্যার এবং সফটওয়্যারের সম্পর্কগুলো সম্পর্কে অধিকতর জ্ঞানী, তাদের আমরা শ্রেণীবদ্ধ করে বলতে পারি এটা "খ" শ্রেণীর।

তৃতীয় একদল মানুষ আছে যাদের অভিজ্ঞতা সফটওয়্যার নির্মাণের, প্রতিটাই বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া, প্রাযুক্তিক প্রক্রিয়া এবং নিয়মিত যাচাই-বাছাই করে একটা সিদ্ধান্ত ও বিশ্লেষণের জায়গা এই তিন শ্রেণীর মানুষের আছে- এই তিন শ্রেণীর মানুষের বাইরে বিশাল এক ভোক্তা সমাজ রয়েছে, যাদের এতকিছু জানবার প্রয়োজন নেই, ছবি দেখে চিহ্ন দেখে যারা এইসব ব্যবহার করছে নিজের জীবনের প্রয়োজনে। এবং এটার জটিলতা সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণাই নেই। এই ব্যবহারজীবি মানুষের কাছে যদি এই তথ্যটুকু না থাকে যে পৃথিবীর কোনো কোনো মানুষ এগুলোর কার্যাবলী নিয়ন্ত্রনের ক্ষমতা রাখে তবে তার কাছে এটা অলৌকিক একটা যন্ত্র- কিন্তু এটা নির্ধারিত কিছু নিয়মাবলী দিয়েই নিয়ন্ত্রিত হয়। টেলিভিশনের মতো প্রযুক্তিও কোনো কোনো মানুষের কাছে অলৌকিক মনে হতে পারে, রেডিও কিংবা মোবাইল ফোনও অনেকের কাছে অলৌকিক কিছু, কারণ এইসবের কার্যকরণ আমরা নিজস্ব বিশ্লেষণী ক্ষমতা প্রয়োগ করে নির্ধারণ করতে পারছি না। একই ভাবে একজন সফটওয়্যার নির্মাতা শুধুমাত্র তার ক্ষেত্রে অত্যাধিক অভিজ্ঞ হলেও ম্যাশিন ল্যাঙ্গুয়েজের সহায়তা ছাড়া তার এতসব কার্যক্রম কোনো অর্থই বহন করবে না।

কারণ ম্যাশিন শব্দ বুঝে না, শব্দের আড়ালে থাকা নির্দেশনাগুলো যেভাবে কাজ করতে বলবে তারা সেভাবেই কাজ করবে। শিক্ষাও এমনই একটা ব্যবহার্য বিষয়, সে ব্যবহার্য বিষয় কিভাবে আত্মস্ত করবে সেটা ব্যক্তির নিজের ধারণ ক্ষমতার উপরে নির্ভর করে। একজন নিউরোবিজ্ঞানী জানেন আমাদের চারপাশের জগত আমাদের মস্তিস্কে সে রাসায়নিক উদ্দীপনা নির্মাণ করে আমাদের বিশ্ব সেটুকুই, সেই রাসায়নিক উদ্দীপনার বাইরে বিশ্বের কোনো অস্তিত্ব নেই, আমাদের কোনো অস্তিত্ব নেই, আমি স্বপ্নে যেসব অনুভব পাই, সেসব স্বাদ কিংবা স্পর্শ্বে আল্পুত হই সেসব যদি সে বস্তুর উপস্থিতিব্যতিরকেই আমার মস্তিস্ক উৎপাদন করতে পারে তবে আমরা সেই অনুভবটুকু পাবো, সেই দৃশ্যের উপস্থিতি সম্পর্কে আমরা অবগত হবো। আমি স্বপ্নে যে নারীকে দেখে প্রবল আশ্লেষে আলিঙ্গন করে তৃপ্ত হচ্ছি সে নারির কোনো শরীরি অস্তিত্ব নেই, সে বসবাস করছে আমার মস্তিস্কের রাসায়নিক কার্যকলাপে, সুতরাং আমার কাছে স্বপ্ন, মস্তিস্ক, জাগরণ এবং অসচেতনতাগুলো মূলত এভাবেই নির্ধারিত হয়ে যায়- আমি সচেতন অবস্থায়, জাগ্রত অবস্থায় এইসব রাসায়নিক কার্যকলাপগুলোকে পরিচিত দৃশ্যের সাথে একিভূত করে নিজের পরিপাশ্বিকের সাথে মিলিয়ে একটা আকার দিতে পারি- হয়তো চাইলে সেসবকে পরিবর্তিত করতে পারি, কিন্তু সেটা কোনোভাবেই এটা নিশ্চিত করে না আমি জাগ্রত- বরং আমাদের অন্যসবাই একই রকম অবাস্তব হলেও রাসায়নিক প্রতিক্রিয়াগুলোর বিন্দুমাত্র অদল-বদল হবে না। এরপরও আমি নিজেকে সজাগ এবং অসচেতন পর্যায়ে বিভক্ত করবার মতো একটা পরিস্থিতি নির্ধারণ করেছি, কারণ আমি নিজের অবস্থান থেকে নিজের সুপ্তি এবং জাগ্রত অবস্থাকে আলাদা করবার নির্দিষ্ট কিছু প্যারামিটার ধরে নিয়ে আলোচনা শুরু করেছি।

১০০০০ বছর আগের একজন মানুষের কাছে এই তথ্যগুলো অবান্তর, আমাদের প্রাযুক্তিক উন্নতি তখনও সে পর্যায়ে পৌঁছায় নি যে সে নিজের সুপ্তি এবং জাগ্রত অবস্থা, নিজের মস্তিস্কের রাসায়নিক উদ্দীপনার সাথে দৃশ্য এবং অদৃশ্যকে আলাদা করতে পারবে। সুতরাং তাদের কাছে সকল দৃশ্যই বাস্তব, সকল রাসায়নিক উদ্দীপনাই একই রকম বাস্তব তাদের কাছে, তারা নিজের অভিজ্ঞতার বাইরে যেতে পারে নি, এবং নিজের বিশ্লেষণী ক্ষমতার চুড়ান্ত ব্যবহার করেও তাদের সে পর্যায়ে যাওয়ার ক্ষমতা নেই কারণ এইসব তথ্য না থাকলে তারা সে পর্যায়ে পৌঁছাতে পারবে না। কিন্তু ঠিক এই সময়ে যখন কোনো অলৌকিক দৃশ্য দেখে কোনো নিউরোবিজ্ঞানী পূজা অর্চনা শুরু করেন তখন তাকে কোন শ্রেণীতে শ্রেণীবদ্ধ করা যায়, তিনি নিজের অভিজ্ঞতায় জানেন এইসব বাস্তবতা এবং অবাস্তবতার জগতটুকুর তফাত, কিন্তু তিনি এটা স্বীকার করতে চাইছেন না। তার শিক্ষা তাকে প্রতারিত করছে কিংবা তিনি তার অভিজ্ঞতাকে অস্বীকার করে অন্য একটা সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছেন। সেখানেই ব্যবহারউপযোগী শিক্ষা চলে আসছে, শিক্ষার ব্যবহার কে কিভাবে করছে তার উপরে নির্ভর করে , এবং সেটা আমি তুমি সে কিংবা সমাজ নিয়ন্ত্রন করতে পারে না।

সুতরাং সমাজে সবাই শিক্ষিত ও প্রযুক্তি নির্ভার হয়ে উঠলেই ধর্মের অস্তিত্ব শেষ হয়ে যাবে না। ধর্ম মানুষকে একটা আশ্রয় দেয়, একটা নিরাপত্তার আশ্বাস দেয় এবং একই সাথে জীবনের দুর্বলতা এবং দুঃসহ মুহূর্তগুলোর মুখোমুখি হওয়ার সাহস জোগায়- এই অলৌকিক বিশ্বাসটুকুর যথার্থতা কিংবা অযথার্ততা আমাদের যৌক্তিক আলোচনায় নির্ধারণ করা যাবে না। বরং এটা মানসিক অনুভবের জায়গা। আমাদের মানসিক অনুভব অনেক সময়ই আমাদের মস্তিস্কের রাসায়নিক নিঃসরণকে নিয়ন্ত্রন করে, এবং সে অনুযায়ী শরীরকে চালিত করে। যে মানুষটি সন্তান হারিয়ে ধর্মের কাছে আশ্রয় খুঁজছে সে তার নিজের দুঃসহ অভিজ্ঞতাকে ভুলতে এমন একটা প্রক্রিয়াকে বেছে নিয়েছে, সেটার হয়তো কোনো যৌক্তিকতা নেই, তার সন্তান বেহেশতে কোনো কোনো নারীর আশ্রয়ে অতি নিরাপদে বেঁচে আছে এবং ভবিষ্যতে মৃত্যুর পরে তার সাথে সে সন্তানের মিলন হবে এই অবান্তর ভাবনাটুকু আমার অবস্থান থেকে যতটা অযৌক্তিক মনে হোক না কেনো, সেটাই তার বাণনচার অবলম্বন এবং কোনো যৌক্তিক আলোচনায় তার এই অনুভুতিকে আহত করা মূলত তাকে হত্যা করববার একটা অপচেষ্টা।

আমাদের সংস্কৃতি আমাদের বেড়ে উঠবার ধরণের উপরে নির্ভরশীল এবং আমাদের শব্দচয়ন এবং আমাদের নির্ধারিত সংজ্ঞাগুলোও আমরা আমাদের প্রচলিত ভাষা ব্যবহারের সক্ষমতা দিয়েই নির্দিষ্ট করি, অপ্রকাশিতব্য যে কোনো অনুভবই আমাদের অলৌকিকত্বের আস্বাদ দেয়- কারণ আমরা আমাদের নির্ধারিত শিক্ষায় সেগুলোকে যথাযথ উপস্থাপন করতে পারি না। একই রকম সংস্কৃতি চর্চার অতীত রয়েছে ১০০০০ বছর আগের মানুষেরও। তারাও তার পরিপার্শ্বকে বিশ্লেষণ করতে চেয়েছে, প্রাকৃতিক ঘটনাগুলোকে নিজের মতো ব্যখ্যা করতে চেয়েছে, সে কাজে তারা কতটুকু সফল হয়েছে সেটা নিয়ে বিতর্ক না করে বরং সেটার প্রভাব নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। নিজের অভিজ্ঞতায় তারা যা কিছু জেনেছে তার কিছু অংশ তারা নিয়ন্ত্রন করতে পারতো এবং অধিকারংশই তার নিয়ন্ত্রনের বাইরের জগত, সুতরাং তার নিজের নিয়ন্ত্রন অযোগ্য যেকোনো কিছুই সে আদতে অলৌকিক কোনো সত্ত্বার কাছে সচেতন ভাবেই দায়িত্ব নিয়ে ছেড়ে দিতো এবং নিজের সংক্ষিপ্ত আচরণে সেটাকে নিয়ন্ত্রনের প্রচেষ্টা করতো। এভাবেই একটা সমাজবদ্ধ ব্যবস্থা তৈরি হয়েছিলো অতীতে।

যেকোনো গোষ্ঠীবদ্ধতা একটা নির্দিষ্ট অবস্থানের মানুষের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করে, সমাজের কাঠামো ঠিক করে দেয় ঠিক কোন মানুষগুলো অন্য সব মানুষের চেয়ে বেশী পক্ষপাতিত্ব পাবে এবং সামাজিক সিদ্ধান্ত গ্রহনের সময় কারা প্রাধান্য পাবে। এই সামাজিক সিদ্ধান্ত গ্রহনের সময় যাদের মতামতের গ্রহনযোগ্যতা বেশী তারাই সমাজে সুবিধাভোগী হয়ে যায় এবং এর বাইরের সবাই পক্ষাপাতিত্ববিহীন সামাজিক জীব হয়ে বেঁচে থাকে, একই সাথে একটা সংকীর্ণ অংশ থাকে যাবতীয় সুবিধাবঞ্চিত, তাদের সিদ্ধান্ত চাওয়া পাওয়া কোনো ভাবেই সমাজকে বদলায় না। সুবিধাভোগী এবং সুবিধাবঞ্চিতদের ভেতরে শ্রেণীঘৃণা বাড়তে থাকে , বাড়তে থাকে প্রতিযোগিতা এবং অর্থনীতি ক্রমশ প্রসারিত হয়। কোন সমাজের মানুষ কতটুকু ধারণ করতে পারবে তা ঠিক করে মূলত সেই সমাজের সাথে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে অন্য সকল সমাজের সম্পর্ক। তারা যতবেশী সমাজের সংস্পর্শে আসব তাদের সিদ্ধান্ত ও সমাজব্যবস্থা তত বিবর্তিত এবং ততই উন্নত হয়ে উঠবে।

তাদের বিশ্লেষণীক্ষমতা বাড়বে, তাদের সিদ্ধান্তগ্রহন এবং তাদের আচরণে এটার প্রভাব পড়বে। এভাবে একটা সমাগ্রীক নৈতিকতাবোধও জন্ম নিবে কোনো এক পর্যায়ে, এবং সেই নৈতিকতাবোধটুকু চর্চিত হবে, ক্ষমতাচর্চার জন্য ক্ষমতাচর্চার প্রতিরোধ করতে পারে এমন যেকোনো আচরণই নৈতিকতাবিবর্জিত গণ্য হবে, একই সাথে নৈতিকতাবোধটুকু সামাজিক স্থিরতার একটা শর্তও ধারণ করবে কারণ সমাজ স্থির না হলে ক্ষমতার চর্চা এবং অর্থনৈতিক বিকাশ সম্ভব হবে না। বিকাশের একটা পর্যায়ে সম্ভবত ধর্মের উৎপত্তি এবং সেটা মূলত ক্ষমতাচর্চাকারীদের হাতেই সম্পন্ন হয়েছে, একই সাথে সুবিধাবঞ্চিতের পরিমাণ বাড়লে তারাও নিজেদের মতো বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে এবং সেই বিদ্রোহকে কার্যকর করবার জন্য তাদেরও প্রচলিত সামাজিক নৈতিকতার বাইরে গিয়ে, সামাজিক গ্রহনযোগ্যতার বাইরে গিয়ে বিকল্প অনুসন্ধান করতে হয়েছে। এই ভাবেই ধর্ম বিবর্তিত হয়েছে, এবং ধারাবাহিক বিবর্তনে সেটা বর্তমানের অবস্থায় পৌঁছেছে। ক্ষমতার চর্চা এবং সামাজিক পক্ষপাতিত্ববিহীন কোনো একটা আদর্শ সমাজ কল্পনা করা যায়, তেমন কোনো আদর্শ সমাজে হয়তো সামাজিক নৈতিকতাবোধগুলো ভিন্ন ভাবে চর্চিত হবে।

সেখানের নতুন বাগবিধিতে হয়তো এইসব অবোধ্য অনুভবের পরিচায়ক কোনো শব্দ থাকবে না। এবং শব্দ না থাকলে এই জাতীয় ভাবনাও থাকবে না। ইশ্বরকে হত্যা করবার সবচেয়ে সহজ এবং সরল প্রকল্প হতে পারে অভিধান থেকে ইশ্বর এবং ইশ্বরের সমার্থক সকল শব্দ মুছে ফেলে একটা বিশাল অঞ্চলের মানুষকে সেই অভিধানের শব্দে দীক্ষিত করা।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।