আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নেমে যাও শোকপাথর



নেমে যাও শোকপাথর ফকির ইলিয়াস ===================================== জাতির জনক বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আপিল শুনানির রায় হয়েছে। ১৯ নভেম্বর ২০০৯ বাঙালি জাতির ইতিহাসে আরেকটি স্মরণীয় দিন। মাননীয় আদালত পাঁচজন দণ্ডপ্রাপ্ত খুনি আসামির আাপিল খারিজ করে দিয়েছেন। এর মাধ্যমে বারোজন ঘাতকের ফাঁসির পূর্ববর্তী রায় কার্যকর থেকেছে। বাংলাদেশ আবারো বিজয়ী হয়েছে।

আবারো গণমানুষের স্বপ্ন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলার মাটিতে। সুবিচার পেয়েছে এই সবুজ শ্যামল প্রকৃতি। ১৯ নভেম্বর ২০০৯ সকাল, যখন ঢাকায় রায়টি প্রকাশিত হওয়ার ক্ষণ, নিউইয়র্কে তখন ১৮ নভেম্বর বুধবার মধ্যরাত। রাত ১০টা থেকেই বিভিন্ন স্যাটেলাইট চ্যানেলের বিশেষ বুলেটিনগুলো দেখছিলাম। শুনছিলাম সেই দেশাত্মবোধক গানগুলো যেগুলো এখনো মনের কোণে ডাক দিয়ে যায়- ‘একবার যেতে দে'না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়’।

এই সময়টুকু ছিল প্রতিটি দেশপ্রেমিক বাঙালির জন্যই একটি গভীর অপেক্ষার প্রহর। আমি যখন জেগে আছি তখন অনলাইনে দেখলাম আরো অনেকেই জেগে পাহারা দিচ্ছেন সেই সময়বিন্দুকে। লন্ডনে কবি আহমদ ময়েজ, কানাডায় কবির আসলাম, সিডনিতে তৌফিক মুরাদ, ক্যালিফোর্নিয়ায় সুমন্ত তাপস- নবীন-প্রবীণ অনেক মানুষের এই জেগে থাকা। ভাবি, কেন জেগে আছেন তারা? উত্তর পেয়ে যাই সাথে সাথেই। এরা সবাই একটি সুবিচারের প্রত্যাশা করছেন।

এরা একটি জাতির কলঙ্ক মোচনের ক্ষণটুকুকে বুকে টানতে চাইছেন। হাঁ, এই জাতি এটাই প্রমাণ করবে- এই মাটিতে খুনি দুর্বৃত্তদের ঠাঁই নেই। এই ভূমি লক্ষ শহীদের পবিত্র রক্তে শানিত। আমি যখন অনলাইনে বন্ধু-বেষ্টিত হয়ে এসব ভাবছি, তখনই আমার মনে পড়ে যায়, ১৫ আগস্ট ’৭৫- এর সেই নৃশংস সকালটির কথা। প্রতিদিনের মতো সকালের সংবাদ শোনার জন্য আমাদের ফিলিপস রেডিওটি অন করেছি মাত্র।

না, প্রতিদিনের মতো ঘোষক-ঘোষিকার সুললিত কণ্ঠ নেই আজ। প্রায় চেঁচিয়ে একটি কর্কশ কণ্ঠের আওয়াজ- “আমি মেজর ডালিম বলছি। জাতির বৃহত্তর স্বার্থে শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে। ” কথাগুলো শুনেই চমকে উঠি। কী বলছে এসব? আমি তখন একজন উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র।

‘ছোটদের রাজনীতি’, ‘ছোটদের অর্থনীতি’র পাঠ নিয়েছি ক’বছর আগেই। শুনে খুবই মর্মাহত হই। কী করবো ভেবে পাই না। ‘জাতির বৃহত্তর স্বার্থ’ ‘শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা’ কথা দুটো বুকে বিদ্ধ হতে থাকে বারবার। এরপর থেকেই সবকটি ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী হতে থাকি আমি।

মাত্র কয়েক মাসের মাঝেই কোটি বাঙালির মতো আমিও জেনে যাই- ঘাতকদের ভাষায় ‘জাতির বৃহত্তর স্বার্থ’ মানে কাদের কী স্বার্থ ছিল। আমরা দেখতে থাকি, কীভাব কুখ্যাত রাজাকার শাহ আজিজ, মশিউর রহমান যাদু মিয়ারা কার হাত ধরে রাষ্ট্রক্ষমতায় গেলো। কীভাবে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা পেতে থাকলো কুখ্যাত রাজাকার, আলবদর, আল-শামস বাহিনীর নেপথ্য ও প্রকাশ্য নায়করা। বাড়তে থাকলো তাদের দাপট। দুই. বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্য, বর্বরোচিত, অমানবিক অধ্যাদেশটি ছিল ‘ইনডেমনিটি বিল’।

পনেরোই আগস্টের হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচার করা যাবে না- এ মর্মে যে আইনটি জারি করা হয় তা রহিত করতে লেগে যায় বাঙালির একুশটি বছর। এখানে সবিনয়ে একটি প্রশ্ন উত্থাপন করতে চাই, তা হচ্ছে- এই হত্যাকাণ্ডটি যদি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডই ছিল তাহলে শেখ রাসেল, সুকান্ত বাবুর মতো অবোধ শিশু এবং মিসেস শেখ জামালের মতো অন্তঃসত্ত্বা নারীকে কেন প্রাণ দিতে হয়েছিল? কেন খুনিরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের ওপর। যিনি একটি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা শেখ মুজিবের ছায়া হয়েছিলেন জাতির প্রতিটি দুঃসময়ে। সয়েছিলেন সব কষ্টের বোঝা। কী অপরাধ ছিল তাদের? আসলে একটি জাতি, একটি রাষ্ট্রসত্তাকে পঙ্গু করার জন্যই এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছিল।

এর হোতা ছিল তারাই, যারা প্রকৃতপক্ষে একটি স্বাধীন বাংলাদেশ চায়নি। তারা চেয়েছিল, পাকিস্তানি খানে-দাজ্জালদের দোসর -তাঁবেদার হয়েই থাকতে। আজকের এই সুবিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষণে আমার বারবার চরম ঘৃণায় মনে আসছে খুনিদের পৃষ্ঠপোষক সেই খন্দকার মোশতাকের কথা। জাতির জনকের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে যে খুনি পাপীষ্ঠদেরকে মদদ জুগিয়েছিল। এ প্রজন্ম যদি আজ তার মরণোত্তর বিচারও দাবি করে তবুও হয়তো তাদের ক্ষোভ প্রশমিত হবে না।

বারবার যে প্রশ্নটি আমার মনে আসছে তা হচ্ছে- ১৯৭৫ সালের পনেরই আগস্ট হত্যাকাণ্ডের সময় দেশে সুসংহত সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী থাকার পরও তারা কেন কতিপয় বিপথগামী সেনা সদস্যকে কঠোর হস্তে দমাতে এগিয়ে এলো না। বঙ্গবন্ধু যদি তৎকালীন সেনাপ্রধান কে এম সফিউল্লাহকে বলেই থাকেন ‘সফিউল্লাহ তোমার ফোর্স আমার বাড়ি আক্রমণ করেছে, তুমি ফোর্স পাঠাও’ -তারপরও সফিউল্লাহ কেন সেদিন তার বাহিনী নিয়ে ধানমণ্ডি অভিমুখে ছুটলেন না? কেন সেদিন খুনিদের প্রতি পাল্টা গোলাবর্ষণ করা হলো না? আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, কোনো বিদ্রোহ কিন্তু তখন দেশব্যাপী হয়নি। কিছু খুনি মর্মান্তিকভাবে জাতির জনককে সপরিবার হত্যা করেছে। তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিলে এরা রাষ্ট্রক্ষমতা হাতিয়ে নেয়ার ধৃষ্টতা দেখাতে পারতো না। এই কাপুরুষোচিত আচরণের দায় কে নেবে আজ? পনেরোই আগস্টের বেনিফিশিয়ারি হতে নেপথ্যে ধাপে ধাপে ষড়যন্ত্রকারীরা তৈরিই ছিল।

তা না হলে মুজিব হত্যাকাণ্ডের নির্মম ঘটনার পরপরই তথাকথিত শান্তির পতাকাধারী কিছু দেশ অতি উৎসাহী হয়ে তড়িঘড়ি করে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল কেন? কী ছিল তাদের নেপথ্য উদ্দেশ্য? এরকম অনেক প্রশ্নই তোলা যাবে। এর অনেক উত্তরই জানেন দেশবাসী। সব চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ঐতিহাসিক রায় হয়েছে। বাঙালি জাতি জিতেছে ঠিক একাত্তরের মতোই। আমি টিভির সংবাদে শুনেছি, রায় ঘোষণার সময় বিএনপির সিনিয়র নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ আদালতে ছিলেন।

তিনি তার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছেন, এই রায় যেন দ্রুত কার্যকর করা হয়। উল্লেখ করা দরকার, এই মওদুদ আহমদ শেখ মুজিবের স্নেহভাজন ছিলেন। তার কি উচিত ছিল না একজন খ্যাতিমান আইনজীবী হিসেবে গিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি আনিসুল হক, এডভোকেট আবদুল মতিন খসরু, ব্যারিস্টার তাপস প্রমুখের পাশে গিয়ে দাঁড়ানো। না তিনি তা করেননি। কেন করেননি? একটি ঐতিহাসিক ক্ষণের সহযাত্রী হতে তার কি অসুবিধা ছিল? রায় ঘোষণার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন দেশের বর্ষীয়ান আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিকুল হক।

তিনি বলেছেন, রায় দ্রুত কার্যকর করা হোক। তিনি জোর দিয়ে বলছেন, আজই করা হোক। রফিকুল হক উদাহরণ টেনেছেন জিয়াউর রহমান হত্যা মামলার ক্ষেত্রে রায় বিকেল সাড়ে তিনটায় হওয়ার পর সন্ধ্যা সাড়ে ছটায়ই কার্যকর করার নজির রয়েছে। খুবই সত্যি যে, গোটা দেশের মানুষই এ রায় দ্রুত কার্যকর দেখতে চান। এ জন্য বিদেশে অস্থানরত বঙ্গবন্ধুর খুনিদেরও দেশে ফিরিয়ে আনার সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

এ জন্য মিত্র দেশসমূহের, জাতিসংঘের, বিশ্ব মানবাধিকার সংস্থাগুলোর সাহায্য গ্রহণ করা উচিত। পলাতক খুনিরা এখনো বিদেশে থেকে নানাভাবে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, শান্তি-সমৃদ্ধির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। বিশেষ করে লিবিয়ায় যে খুনিরা রয়েছে এদের ফিরিয়ে আনতে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করা দরকার। সুবিচার সবসময়ই প্রজন্মের মননকে প্রসন্ন করে। তারা সাহস পায় সত্যের পক্ষে থাকতে।

তারা এগিয়ে এসে বুকে ধারণ করে সত্যের আলোক রেখা। বাংলাদেশে যারা এ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে, তারা অচেনা নয়। এদেরকে রাজনৈতিকভাবে প্রতিহত করতে হবে। মনে রাখতে হবে এসব অপশক্তি নানা ছলছুতোয় বারবার ছোবল দিতে চাইবে। বাঙালি জাতি গেলো চৌত্রিশ বছর যে শোকপাথর বহন করে চলেছে, সময় এসেছে তা ঝেড়ে ফেলার।

সময় এসেছে জাতি হিসেবে বাঙালির মাথা উঁচু করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার। ২০ নভেম্বর ২০০৯ ------------------------------------------------------------------- দৈনিক ভোরের কাগজ । ঢাকা । ২১ নভেম্বর ২০০৯ শনিবার প্রকাশিত

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.