কৃষ্ণশুভ্রারা বেঁচে থাকুক দূরে সুদূর স্বপ্নসীমান্তে
আমাদের বাসায় টিভির আগমন ঘটেছিল আমার সৌজন্যে। সেসময় টিভি সবিশেষ ছিলো না। তাই টিভি দেখতে আমাকে নিয়ে যাওয়া হতো পাশের বাসায়। তৎকালীন নেসলে কোন এক বিজ্ঞাপনের বালক মডেলের সাথে গলা মিলিয়ে "হুমমম" না বলতে পারলে নাকি আমার প্রতিক্রিয়া হতো তীব্র। তার সাথে যোগ হলো সন্ধ্যা আট টায় আমার পিতার সাহেব বিবি গোলাম (এরশাদের আমলে সংবাদকে নাকি এই নামে বলা হতো) অনুষ্ঠানটি দর্শনের আগ্রহ।
টিভি আসার পরে যা হোল আমাদের সব রিলেটিভ মিলে বেশ একটা ঘরোয়া পরিবেশে টিভি দেখা হতো। তখনকার সময়ে এখনকার মতো সারাদিনব্যাপী নয় বরং টিভির আয়ু ছিলো দিনে কয়েক ঘন্টা। নাটক এবং বই ( বাংলা সিনেমার প্রচলিত নাম) দেখার জন্য দর্শক সমাগম হতো প্রচণ্ড। বিশেষ করে শুক্রবারের বই দেখার দিনে আত্মীয়ের বাইরেও জানালা দিয়ে উকি দেয়া অনাত্মীয় দর্শক এবং তাদের আবেগ দ্বারা তাড়িত হতাম ভীষণভাবে। এর মাঝেই কারেন্ট বাবাজির বদৌলতে কোন এক অনুষ্ঠান মিস করে সবাই যখন বাংলাদেশের বিদ্যুত ব্যবস্থার চৌদ্দ পুরুষ উদ্ধারে ব্যস্ট তখনই সেই চরম প্রার্থিত অনুষ্ঠানের প্রতি আমার আগ্রহের সূচনা।
সেই অনুষ্ঠানটির নাম শুনলাম ইত্যাদি। অধীর আগ্রহে বসলাম দেখতে। বেশির ভাগ জিনিসই আমার ক্ষুদ্র মাথার অনেক উপর দিয়ে গেলো। অথচ ছোট খাটো আর গোফওয়ালা একজন মানুষের কথাতে দেখি আমার পাশের সবাই হেসে কুটিকুটি। মাঝে মাঝে কিছু অদ্ভুত কন্ঠের ছোট নাটক দেখে আনন্দটার ভাগ নিতে চাইলাম।
কিছু ভাগ মিললো শেষে এসে যখন দেখি বিদেশিসব লোক কেমন সুন্দর করে বাংলায় কথা বলছে। সেই থেকে শুরু। আস্ত আস্তে ভালো লাগতে শুরু করে সেই গোফওয়ালা লোকটিকে। পরে জানি ইনার নাম হানিফ সংকেত। নামটির মাঝেই কেমন যেন কৌতুক লুকিয়ে আছে।
আর তিনি আমাদের মুগ্ধ করে যেতে থাকেন তার সৃষ্টিশীলতা দিয়ে। ঈদের সময় বিপ্লব নিয়ে আসে আরেকটি নাম। এটাও নাকি ম্যাগাজিন। নাম আনন্দমেলা। আনন্দ মেলা দেখা নিয়ে সবার আনন্দ অপেক্ষা দেখে আমি অধীর হতাম দেখার আশায়।
আমার শরীর সায় দিতো না। আনন্দমেলার আনন্দের অনেক আগেই আমি ঘুমের আনন্দে বিভোর হয়ে যেতাম। পরে অবশ্য দর্শকদের তীব প্রতিক্রিয়ায় আবিষ্কার করতাম ঘুমিয়ে গিয়ে আমিই সবচেয়ে আনন্দভোগী।
সময় বদলালো। এরশাদ চাচার জায়গায় গণতান্ত্রিক সরকার এলো।
সত্য জনাতে উদ্যোগী সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় আসলো নতুন ধরণের অনুষ্ঠান -- সেটা অবশ্যই অপরাধ বিষয়ক। রোমাঞ্চের আবহ নিয়ে শুরু হলো ম্যাগাজিন "দৃষ্টিকোণ"। রীতিমতো আৎকে উঠেছিলাম উপস্থাপকের দুঃসাহসে। তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধায় নত মাথা আর সোজা হতে চায় না। তার আধুনিক সংস্করণ পরিপ্রেক্ষিতও দারুণ সারা জাগায়।
পরে অবশ্য তাদের সাহসের মূল সূত্র আবিষ্কার করে তাদের জন্য নতজানু করা মাথা খুব সহজে আর নিচু হতে চায় না।
দৃষ্টিকোণের চেয়ে ভিন্ন ধর্মী ম্যাগাজিন নিয়ে এল অন্তরঙ্গ। এর নামের মাজেজা আমি আজও বুঝি না। শুধু মনে আছে সেই অনুষ্ঠানে দেখানো হতো মানুষের অদ্ভুত এবং অস্বাভাবিক কর্মকাণ্ড। যেমন "একজন লোক তার লম্বা চুলের দুদিকে দুটো ইট বেঁধে ক্রমাগত চর্কির মতো ঘুরছে।
" কিংবা কার বুকে ইট রেখে সেটা গুড়া করা হচ্ছে তার কিছু হচ্ছে না। এই অনুষ্ঠানেই প্রথম দেখি নরসিংদীর সাজ্জাদকে। যিনি সদা সর্বদা তার গোল মাথায় গোল চর্মগোলকে চুম্বকের মতো টেনে রাখতেন। এর ফলে তার প্রাপ্তি ঘটলো, ঢাকায় অনুষ্ঠিত সাফ গেমসে দর্শনীয় বস্তুর শোকেসে স্থান পেয়ে। গেমস চলাকালীন সময়ে তার মাথায় বল নিয়ে ঘুরাঘুরি দেখে রেগে যাবার পরিবর্তে বেচারার জন্য কষ্ট হতে থাকে।
এই সময়েই শুরু হ্য় শ্রদ্ধেয় আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান চারুপাঠ। আমার দৃষ্টিতে এটাই এখন পর্যন্ত সেরা । সায়ীদ স্যার কথা বলার শক্তি দিয়ে দর্শককে আকৃষ্ট করতেন। ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান মানে যে ভাড়ামো না এই সত্যকে তিনি খুব দারুণভাবেই ফুটিয়ে তোলেন। কিন্তু আমাদের দেশের সব ভালো জিনিসেৃ মত এই অনুষ্ঠানটিও ক্ষণজীবী কোন এক অজ্ঞাত কারণে।
আজো মিস করি ১৬ বছর আগে দেখা সেই অনুষ্ঠানটিকে।
ইত্যাদি হানিফ সাহেবের দক্ষতায় টিকে থাকে, আর অন্যসব অনুষ্ঠান হারিয়ে যেতে থাকে দর্শপ্রিয়তা হারিয়ে। এর মাঝেই বাউবির কিছু অনুষ্ঠানের সুবাদে আত্মপ্রকাশ করেন বিতার্কিক তুষার সাহেব। এবং সময় কালে টিনি ফেদে বসেন আরেক নতুন ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের। তিনি শুরু করেন শুভেচ্ছা নাম নিয়ে।
সেই অনুষ্ঠানের মান খুব ভালো ছিলো সেটা বলা যাবে না। হানিফ সাহেবের ক্রিয়েটিভিটির বিপরীতে এখানে ছিলো গৎবাধা আইটেমে অ নুষ্ঠান পূর্ণ করার চেষ্ট। তুষার সাহেব অবশ্য পাবলিক ডিমাণ্ড ভালো বুঝেন। কারন গৎবাধা গণ্ডিতেই তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়তা কামিয়ে ফেলেন। সুড়সুড়ি দিয়ে হাসানোর চেষ্টা করা স্থূল কৌতুকে আমি অবশ্যি মজা পেতাম।
কৌতুক করতে গিয়ে লোক হাসাতে না পারলে সেটাই বড়সড় কৌতুক হয়ে ঝড় তোলে। আর তার সাথে উপস্থাপকের নিজেকে বাহবা দেয়া ভাবাবেগ (যেন বলছেন, "....... আরে তুই কী দেখাইলি?") কৌতুকপ্রবণ করে তুলতো সেই অনুষ্ঠানটিকে।
তুষার সাহেবের সাফল্য ম্যাগাজিন জগতে বিপ্লব ঘটিয়ে দিলো। মানের ক্রমোঅধোগতি ঘটিয়ে ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের সংখ্যা ক্রমে উর্ধ্ব গতি প্রাপ্ত হলো। এর মাঝেই যোগ হলে আনজাম মাসুদ (অনেকের মতে গেনজাম মাসুদ), নিউটন আর স্ট্যালিন।
মাসুদ সাহেব অবশ্য তুষার সাহেবের সাথে শুধু ভাবাবেগেই থামলেন না। তিনি হাত পা নাড়িয়ে বিপদজনক অঙ্গ ভঙ্গিতে কারুকার্য মন্দিত করলেন তার অনুষ্ঠানকে। অনুষ্ঠানের মাঝে তার পেন্দুলামের মত দোলা আর তার হাতের ফাঁক গলে কৌতুকময় নাটিকা বেরুতে দেখার আনণ্দই আমাকে আজকালে দর্শ বানিয়ে দিলো। নিউটন সাহেব তার নাম দিয়ে তো ঐতিহাসিকদের মাঝে ধন্দ তৈরি করে ফেললেন। তার ভয়াবহ(!) উপস্থাপনা আমার মত অনেককেই ভাবিয়ে তুলে , নিউটন নামটা শুনলে মানুষের চোখে কে আগে আসবে আমাদের নিউটন নাকি বিজ্ঞনী স্যার আইজাক নিউটন।
এতদ পর্যন্ত ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের সব উপস্থাপকদের ঠোটের উপর গোফের উপস্তিতি অবশ্য আমাকে এই ধারণাই দিয়ে দেয় যে ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতে হলে অবশ্যই গোফ রাখতে হবে। প্রতিদিন সকালে আয়নায় গভীর গোফের রেখার গভীর পর্যবেক্ষণে ভাবতে থাকি আমার উপস্থাপক হওয়া কতদূর। এমনি সময়ে আমার ভাবনাকে ধাক্কা দিলো যে অনুষ্ঠান সেটা হলো উৎসব। এর বিশেষত্ব এর উপস্থাপকহীনতা। সম্ভবত এর পরিচালক কোন উপস্থাপক না পেয়ে এই অভিনব কায়দার শরণাপণ্ণ হন।
দর্শক সারির কেউ একজন কিছু একটা দেখতে চায় অমনি টা শুরু হয়ে যায়। আরে !!! এবার তো মনে হয় উপস্থাপক হওয়া যাবে। এলাকার এক বড় ভাইকে ধরে উৎসবের পাস নিয়ে অডিটোরিয়ামে বসে দেখলাম। সে অভিজ্ঞতা অবশ্য খুব সুখকর না। অনুষ্ঠান দেখে চরম বিরক্ত হয়েও হাত তালি দিতে হলো বাধ্য হয়ে যখন ক্যামেরা আমাদের উপর এসে পড়লো।
হাত তালি একবারেই ক্ষান্তি নেই। আমাদের হাততালি যথেষ্ট জোরে হয়নি বলে যখন আবার ধারণ করা হলো তখন থেকে আমার কাছে ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান আরো কৌতুকপূর্ণ হতে থাকে।
তারপরে অনেক দিন দেখা হতো না ম্যাগাজিন। হঠাৎ করেই চোখে পড়ে গেলেন খন্দকার ইসমাইল ওরফে স্মাইল। তার স্মাইলিং ফেস (অবশ্যি গোফ নেই) সদাই তাকে জাহিরে ব্যস্ত।
তার প্রতিভাতে আমি ক্রমেই মুগ্ধ হতে থাকি। তিনি একাধারে গায়ক উপস্থাপক কবি যাদুকর ছড়াকার সবই। তার এহেন প্রতিভার অনুপম প্রদর্শনী আমাকে ভাবিয়ে তুলে। এর মাঝে একদিন ইত্যাদি অনুষ্ঠান দেখতে গিয়ে আবিষ্কার করি হানিফ ভাই ও তার ক্রিয়েটিভিটি হারিয়ে ফেলেছেন। সেই একই একই কথা একই ধরণের ছাচে কৌতুক।
তাই ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান আর দেখা হয় না।
এখন অবশ্য চাইলেও ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান এতো মজা করে দেখবার উপায় নাই। যুজের সাথে দর্শক চাহিদা বদলেছে। এখনও অবশ্য ভাঁড়ামো হয় কম বরং গভীর রাতে সারাদেশের মানুষকে নতুন ভাবে আনন্দের খোরাক যোগানো হয় আপাত গুরুগম্ভীর অথচ কৌতুক উদ্দীপনাকারী সুশীল টক শো তে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।