১. আবদুল হক
ফরহাদ মজহারের সামনে খুব বড় বিপদ। তাঁর প্রতিটি লেখা পড়েই আমার এরকম শঙ্কা হয়। কারণ আমরা এই প্রজন্মের তরুণরা অন্ধকারেও সাম্রাজ্যবাদের চেহারা ঠিকঠাক ঠাহর করে ফেলেছি। তিনি অবিরাম যেসব শান দেয়া কথা লিখে চলেছেন, সাম্রাজ্যবাদের দৈত্য সেটি আর কতোদিন মুখ বুঁজে সহ্য করবে! একটা না একটা অজুহাত বের করে তাঁকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সে করবেই। কিন্তু সমস্যা হলো, ফরহাদ মজহারের মতো মেরুদণ্ডওয়ালারা ওসব ঝুঁকি আদৌ আমলে নিতে চান না।
বুঝতে চান না যে তাঁদের বেঁচে থাকার লোভ না-ও থাকতে পারে, কিন্তু তাঁদের লেখা থেকে 'হঠাৎ আলোর ঝলকানি'র মতো দিশে পাবার প্রত্যাশা আমাদের থাকতেই পারে!
বাংলাদেশে হুজুগ নামে একটা শব্দ চালু আছে। গত কয়েক বছরে ধর্মের নামে বিভ্রান্ত কিছু ব্যক্তির জঙ্গীবাদী কুকর্মের ফলে আমরা একটা সাদৃশ্যতত্ত্ব দাঁড় করিয়ে ফেলেছি যে ওই দণ্ডিত বাংলাভাইগোষ্ঠির সঙ্গে পোশাকে চেহারায় যাঁদেরই মিল আছে, তারা সব জঙ্গী। স্পষ্ট কোনো অভিযোগ উত্থাপিত না হওয়ায় ধরে নিচ্ছি সেই সাদৃশ্যসূত্রেই হিযবুত তাহরীর নিষিদ্ধ হয়েছে। খুব কাছে থেকে না দেখলেও এদের প্রচারণা থেকে আমি জানি যে এরা একটি বুদ্ধিবৃত্তিক দল। গণতান্ত্রিক দেশে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবেই এদের মোকাবেলা করা সঙ্গত ছিলো।
কোনো অভিযোগ ছাড়াই এ নিষিদ্ধকরণ সরকারকেই বরং বিবেকের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেয়। আজকের পত্রপত্রিকায় খবর এসেছে যে সরকার হিযবুত তাহরীরের কাছে বিপজ্জনক অস্ত্র দূরের কথা, একটি ছোরাও খুঁজে পায় নি।
আমি তাই ভাবছিলাম কী কারণে সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করা হলো সেই রহস্য নিয়ে। আনন্দের ব্যাপার যে আমার ব্লগেরই জনৈক ফকির সাহেব আমাদের জানিয়েছেন যে, আমেরিকারই ইঙ্গিতে সরকার তড়িঘড়ি করে সংগঠনটি নিষিদ্ধ করেছে। তিনি আমেরিকায় আছেন বলে তাঁর দেয়া খবরে আমরা একটু বেশিই আস্থা রাখতে পারি।
তিনি দেখেছেন যে ওরা খোদ আমেরিকার দোসর বৃটেনে গিয়ে পরাশক্তির আধিপত্যবাদের বিপক্ষে উস্কানিমূলক বক্তব্য দিচ্ছিলো। সাম্রাজ্যবাদের খোঁয়াড়ে ঢুকে খোঁয়াড়ের মালিকের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস ওরা কোথায় পেলো? এখন বুঝুক মজা!
কিন্তু আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, হিযবুত তাহরীর নিষিদ্ধ হওয়া বড় কথা নয়, আমাদের জাতীয় আত্মসম্মানবোধ একেবারে ধুলোয় লুটিয়ে পড়াই বড় কথা। আমেরিকার ইঙ্গিত 'বুঝিবামাত্র' বিনে যাচাইয়ে যেভাবে পালন করার হীনমন্ম্যতা দেখিয়েছে সরকার, তাতে সত্যের প্রতি আমাদের প্রত্যয় এবং স্বাধীনতা-স্বার্বভৌমত্বের মর্যাদাকেই ক্ষুন্ন করা হয়েছে!
২. ফরহাদ মজহার
আমি মানবাধিকার নিয়ে কথা তুলেছি। মানবাধিকারের অবস্থান থেকেই পাঠকদের আরো একটি প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলব। সেটা হোল, সরকার চাইলেই কোন রাজনৈতিক সংগঠনকে নিষিদ্ধ করতে পারে কি না।
সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের এই কালে ইসলাম নিয়ে কোন কথা বলা বা উচ্চারণও বিপজ্জনক। একটি কুকুরকে হত্যা করতে হলেও তাকে পাগলা প্রমাণ করতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশে একটি শ্রেণীর কাছে ইসলাম সম্পর্কে এই ধরণের কিছু প্রমাণেরও প্রয়োজন পড়ে না। আপনি ইস... বলবার আগেই মৌলবাদী, সন্ত্রাসী, জঙ্গি ইত্যাদিতে পরিণত হয়ে যাবেন। রাজাকার হওয়া তো ডালভাতের ব্যাপার।
আমি বাংলাদেশের এক শ্রেণীর মানবাধিকার কর্মীদের এক সভায় একবার তাজ্জব হয়ে গিয়েছিলাম। আমি প্রশ্ন তুলেছিলাম যে একজন নাগরিক নিছকই সন্দেহের বশে গ্রেফতার হয়েছে, কিন্তু তার টুপি-পাঞ্জাবি-লুঙ্গি পরবার কারণে সন্দেহর মুখে পড়ায় তার মাজায় দড়ি দিয়ে গরুছাগলের মতো নিয়ে যাওয়া কি মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়? যেকোন ব্যক্তির মর্যাদা রক্ষাই মানবাধিকারের প্রাথমিক কাজ। আমাদের অবশ্যই তার প্রতিবাদ করা উচিত। কিন্তু অনেকে দাবি করলেন টুপি-দাড়িওয়ালা মোল্লা মৌলবিদের এইভাবে ছাড়া আর কোনভাবে নেবে? জামাই আদর দিয়ে? এরা তো সন্ত্রাসী কিম্বা কিছু দিন পরেই সন্ত্রাসী হবে।
আমাদের সমাজ খুব ভালো, কিংবা মুসলমান মাত্রই অসাম্প্রদায়িক এই দাবি আমরা করি না।
সাম্প্রদায়িকতা উপমহাদেশের গভীর অসুখ। এর ইতিহাস আছে। ইসলামের নামে জঙ্গি রাজনীতি নাই এটাও কোনো দাবি নয়। রাজনীতিতে শান্তিপূর্ণ ও সহিংস দুই ধরনের পদ্ধতির ভালমন্দ নিয়ে তর্ক আজকের নয়। বহু দিনের।
কোন আন্দোলন ন্যায্য কি অন্যায্য সেই তর্কও অবান্তর। বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলোর সন্ত্রাস আমরা হরহামেশা দেখছি। মাদ্রাসায় সন্ত্রাসের চেয়েও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান থেকে সন্ত্রাসের জন্ম হয়। বিচ্ছিন্ন ভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে এর উত্তর আমরা খুঁজে পাবো না। খুঁজে পাবো সামগ্রিক ভাবে সমাজের অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি, শিক্ষাব্যবস্থা ইত্যাদির মধ্যে।
আমরা বিনয়ের সঙ্গে আন্তর্জাতিক ভাবে এবং বাংলাদেশে প্রদত্ত মৌলিক মানবিক অধিকারের দিক থেকে একটি প্রশ্ন তুলতে চাই। সেটা হোল বাংলাদেশ সরকার হিযবুত তাহরীর নামে একটি রাজনৈতিক সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। গত ২২ অক্টোবর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (রাজনৈতিক) ড. মোঃ কামাল উদ্দিন স্বাক্ষরিত একটি প্রেস নোটের মাধ্যমে সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করবার কথা জানান। প্রেস নোটে বলা হয়, সংগঠনটি জননিরাপত্তার জন্য হুমকি। অতএব ১০ অক্টোবর থেকে সংগঠনটি নিষিদ্ধ।
কেন হিযবুত তাহরীর জননিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে সরকার তার কোন ব্যাখ্যা দেয় নি। কোন প্রমাণও হাজির করে নি।
হিযবুত তাহরীর-এর বিভিন্ন লেখালিখি আমি পড়েছি। পড়ি। ঠিক যেমন আওয়ামী লীগ, বিএনপি, সিপিবি, জামায়াতে ইসলামী, ওয়ার্কার্স পার্টি প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্য সকল দলের চিন্তা-ভাবনা জানা নাগরিক হিশাবে আমার অধিকার বলে আমি মনে করি।
সব রাজনৈতিক দলের চিন্তা-ভাবনা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান রাখার চেষ্টা করি বলেই ভুল বা ক্ষতিকর রাজনীতির বিরুদ্ধে আমি কলম ধরতে পারি। বুদ্ধিজীবী হিশাবে এটা আমার দায় এবং কাজ। হিযবুত তাহরীরের সঙ্গে আমার চিন্তার পার্থক্য কোথায় সেটা বহু দিন আগে পাক্ষিক চিন্তায় আমি সুস্পষ্ট ভাবেই লিখেছি। কিন্তু আমি মনে করি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও বাংলাদেশের সাংবিধানিক অধিকারের বলে তারা তাদের চিন্তা ও মত অবশ্যই প্রচার করতে পারে। এই অধিকার যেমন তাদের রয়েছে, তার বিরোধিতার অধিকারও আমার বা অন্য যেকোনো নাগরিকের আছে।
হিযবুত তাহরীরের বিভিন্ন লিখিত ও সভা সমিতির বক্তব্যে সংগঠনটি বারবারই সন্ত্রাসী বা সহিংস কর্মকাণ্ডের নিন্দা করে এসেছে। তারা শান্তিপূর্ণ ভাবে বাংলাদেশের সংবিধানে প্রদত্ত মৌলিক মানবাধিকারের ভিত্তিতেই তাদের চিন্তা ও মত প্রচার করে চলেছে। তারা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে শুধু মুখে কথা বলে ক্ষান্ত হয় নি; রাস্তায় মিছিল, সমাবেশ ও নিয়মতান্ত্রিক ভাবে বিক্ষোভ জানিয়েছে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের রণতরী যখন আমাদের সমুদ্রসীমানায় নোঙর করেছিল তারা প্রতিবাদ জানিয়েছে। বিডিআরের হত্যাকাণ্ড ভারতীয় ষড়যন্ত্র বলে তারা দাবি করেছে।
ভারতের বিরুদ্ধে লিফলেট বিতরণ করে তাদের কর্মীরা গ্রেফতার হয়েছে। আমরা কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত বা ইসরাইলের বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারবো না? আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র ও সরকার যদি চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে রুদ্ধ করে দেয়, তবে তা সমাজে ব্যাপক অস্থিরতা ও অসহনশীলতার সৃষ্টি করে। মূলত রাষ্ট্রই এই ক্ষেত্রে সন্ত্রাসী রাজনীতি দানা বাঁধবার বা জন্ম দেবার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এটাও আশ্চর্যের যে হিযবুত তাহরীরের অধ্যাপক মহিউদ্দীনকে বাধ্যতামূলক ছুটি দেওয়া এবং কোন সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া তাঁর বাড়ি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দ্বারা ঘিরে রাখা হয়েছে। এটা মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং তাঁর নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ন করা।
হিযবুত তাহরীরকে নিষিদ্ধ করবার অন্য অনেক কারণের মধ্যে একটি কারণ হচ্ছে, সরকার যে শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছে তাকে শক্তিশালী কিন্তু নিয়মতান্ত্রিকভাবে মোকাবিলা করবার হিম্মত এই সংগঠনটির রয়েছে। এই সংগঠনটির অধিকাংশ সদস্য উচ্চশিক্ষিত। তারা খিলাফত কায়েম করতে চায়। আমার বন্ধু মাহমুদুর রহমান টেলিভিশনে বলেছেন, খেলাফত কায়েম বলতে তারা ঠিক কী চায় আমরা কেউই পরিষ্কার নই। কিন্তু সেই বিষয়ে সমাজে তর্কবিতর্ক হতেই পারে গণতান্ত্রিক সমাজের যা চরিত্র-লক্ষণ।
বাংলাদেশে কী ধরণের শিক্ষানীতি রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে বাংলাদেশকে শক্তিশালী করবে, সেই বিষয়ে তাদের নিজস্ব চিন্তাভাবনা আছে। সেই ক্ষেত্রে তাদের সঙ্গে আমাদের বা অন্যদের মতপার্থক্য থাকতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক ভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা কোন অর্থে জননিরাপত্তার জন্য হুমকি? ইতিহাসের প্রহসন হচ্ছে এই যে, এই সেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যারা শেখ হাসিনাকেও জননিরাপত্তার দোহাই দিয়ে বাংলাদেশে ফিরতে দেয় নি। নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কার্যকলাপের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ কোন কাজের প্রমাণ ছাড়া হিযবুত তাহরীরকে নিষিদ্ধ করার মধ্য দিয়ে সরকার এটাই প্রমাণ করলো যে, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের যে নীতি অনুসরণ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের দোসররা দুনিয়ায় নতুন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে বদ্ধপরিকর; সেই নীতি বাস্তবায়নের অংশ হিশাবেই রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করবার এই নগ্ন হামলা শুরু হয়ে গিয়েছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।