ভালো আছি
অভিজ্ঞতার প্রথম অভিজ্ঞান হলো, অভিজ্ঞতার চিরুনি যখন পাওয়া যায় তখন মাথায় আঁচড়ানোর মত আর চুল থাকে না । পণ্ডিতেরা বলেন অভিজ্ঞতার কোন বিকল্প নেই। তবে অভিজ্ঞতা লাভ করতে করতে মন যখন যৌবনে পদার্পণ করে দেহ তখন বার্ধক্যে উপনীত হয় । কাজেই অভিজ্ঞতা অভীষ্ট লাভের মোক্ষম দাওয়াই হলেও অনেকেরই অভিজ্ঞতা প্রয়োগের সময় ও সুযোগ থাকে না। জীবনটা সাদা কাগজের মত।
অভিজ্ঞতার আখরে এটা যখন পূর্ণ হয় তখন জীবন সূর্য অস্তমিত । নতুন করে এতে আর স্বপ্নের ছবি আকার স্থান সংকুলান হয় না।
কিছু কিছু অভিজ্ঞতা আছে যা একবার কেউ লাভ করলে দ্বিতীয়বার সে আর ওপথ মাড়ায় না। যেমন, নেড়া আর দ্বিতীয়বার বেল তলায় যায় না। তবে আমার মনে হয় নেড়ার মাথায় বেল পড়লে যেটুকু কষ্ট হবে, ঝাঁকড়া চুলঅলার মাথায় বেল পড়লেও তারচে কম কষ্ট হবে না।
তবুও শুধু নেড়ারাই বেল তলায় যেতে ভয় পায়। সবাই অভিজ্ঞতা চায় । চাকুরির ক্ষেত্রে তো অভিজ্ঞতার সার্টিফিকেট না থাকলে দরখাস্তই করা যায় না। গিন্নি অভিজ্ঞ রাঁধুনি বুয়া চান, শিল্পপতি অভিজ্ঞ ম্যানেজার চান, বাবা-মা অভিজ্ঞ গৃহশিক্ষক চান সন্তানের জন্য। রাজনীতিক অভিজ্ঞ ক্যাডার চান, পুলিশ অভিজ্ঞ ক্যাশিয়ার এবং সোর্স চান, গাড়ির মালিক অভিজ্ঞ ড্রাইভার চান।
কিন্তু এমন অনেক ক্ষেত্র আছে যেখানে অভিজ্ঞতা নিষিদ্ধ । কোন মেয়ে দাম্পত্যজীবনে অভিজ্ঞ স্বামী চায় না, কিংবা নারী সঙ্গের অভিজ্ঞতা আছে এমন পুরুষও তাদের পছন্দ নয়। স্বামীরা তো পুরুষ সংসর্গে এসেছে এমন অভিজ্ঞ জীবন সঙ্গিনী কল্পনাই করতে পারেন না।
মুরুব্বীরা সর্ব বিষয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে বললেও সর্ব বিষয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন শোভনও নয়, সম্ভবও নয়। যৌন অভিজ্ঞতার কথা বাদই দিলাম, চৌর্যবৃত্তির অভিজ্ঞতা, ঘুষ খাওয়ার অভিজ্ঞতা, প্রতারণার অভিজ্ঞতা, রাজনৈতিক ধাপ্পা দেয়ার অভিজ্ঞতা অশোভন এবং অমার্জিত।
আজকাল মানুষের হরহামেশাই নতুন অভিজ্ঞতা হচ্ছে। কারও যদি ছিনতাইয়ের অভিজ্ঞতা না থাকে তাহলে বড় বড় শহরে একলা হাটাহাটি করলেই তার অভিজ্ঞতার ঝুলি পূর্ণ হবে। তবে ভাগ্য অপ্রসন্ন হলে ছিনতাইকারীর হাতে মারাও যেতে পারেন। এক্ষেত্রে লব্ধ অভিজ্ঞতা ভবিষ্যতে কোন কাজে লাগবে না। কিছু কিছু ব্যাপার এমন আছে যে এসব ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা অর্জণ সম্ভব নয় ।
যেমন কারও আত্মহত্যার অভিজ্ঞতা থাকে না । মৃত্যুর অভিজ্ঞতাও সম্ভব নয়। এরুপ অভিজ্ঞতা অর্জনকারীরা দ্বিতীয়বার অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগও পায় না কিংবা অর্জিত অভিজ্ঞতা কাউকে ব্যক্তও করতে পারেন না। ভবলীলা শেষ হলে অবলীলায় তা কেউ বর্ণনা করতে পারে না । তবে অনেকেই বিশ্বাস করেন কোন কোন আত্মহত্যাকারী ব্যক্তির আত্মা মৃত্যুর পরও আমাদের চারপাশে ঘুরঘুর করে।
তারা আবার প্রতিশোধও নেয় । হিন্দি সিনেমায় এসব ঘটনার প্রাধান্য বেশি দেখা যায়।
কিছু কিছু মজার অভিজ্ঞতা আছে যা মানুষ সব সময়ই পেতে চায়, অনেক ক্ষেত্রে এসব নাকি নেশাতেও পরিণত হয়। যেমন মাছ মারার অভিজ্ঞতা থেকে কারও কারও এমন শখের সৃষ্টি হয যে বড়শী নিয়ে তিনি খাল-বিল, নদী-নালায় ঘুরে বেড়ান। কেউ কেউ ভ্রমণের অভিজ্ঞতার স্বাদ পেতে পেতে এমন পর্যায়ে পৌছেন যে তিনি আর পর্যটন ছাড়া ঘরে থাকতে পারেন না।
ঘুরে বেড়াতেই তিনি অপার আনন্দ লাভ করেন। কেউ কেউ এমন আছেন কোন নারীর সাথে একবার মেলামেশা করার সুযোগ পেলে বার বার তা পেতে চান এবং তিনি তখন ওই নারীর প্রেমে পতিত হন। কেউ একবার নেশা করলে আবার নেশা করার জন্যে অধির হয়ে ওঠেন। এ সব বিপজ্জনক অভিজ্ঞতা । মাদক সেবনের অভিজ্ঞতা তাকে মাদকাসক্ত করে তোলে।
অভিজ্ঞতা আর অভ্যাসের মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে। যে বিষয়ে অভিজ্ঞতা লাভ করে মানুষ বার বার তা করতে থাকে তা অভ্যাসে পরিণত হয়। পরবর্তীতে তা স্বভাবেও পরিণত হতে পারে। যেমন ঘুষখোর কর্মকর্তার একবার ঘুষের অভিজ্ঞতা হলে দ্বিতীয়বার ঘুষ খাবার জন্যে তিনি লালায়িত হন। দ্বিতীয়বারের পর তৃতীয়বার, এভাবে বার বার এবং বহুবার ঘুষ খেতে খেতে ওটা তার মজ্জাগত অভ্যাসে দাড়ায়।
পরবর্তীতে তার স্বভাব এমন হয় যে ঘুষ ছাড়া তিনি আর কোন কাজই করতে পারেন না। এ নিয়ে একটি মজার গল্প চালু আছে। জনৈক সরকারী সার্জেন পয়সা ছাড়া কোন রোগীর অপারেশনই করতেন না। কালক্রমে তার স্বভাব এতটাই খারাপ হয়ে যায় যে নিজের নাতিকে অপারেশনের জন্যে নিয়ে এলেও মেয়েকে তিনি বলেন, ‘মা কিছু মনে করিসনে, টেবিলে অন্তত পাঁচশত টাকার একটি নোট রেখে দে, তা না হলে অপারেশনে আমার হাতই খুলবে না’।
প্রশ্ন হলো, আমরা কি ইচ্ছে করে অভিজ্ঞতা অর্জন করি, নাকি বাধ্য হয়েই আমরা অভিজ্ঞ হয়ে উঠি? অভিজ্ঞতা দু’ভাবেই অর্জিত হয়, যেমন দাম্পত্য জীবনে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় কারও সংসারে প্রতিনিয়ত ঝগড়াঝাঁটি হচ্ছে, মারামারিও হচ্ছে।
দু এক দিন পর পর স্বামী কিংবা স্ত্রী বাড়ি থেকে বের হয়েও যাচ্ছেন, আবার স্বেচ্ছায় ফেরতও আসছেন । এসব অন্যের কাছে বিচিত্র অভিজ্ঞতা হলেও ওই ঝগড়াটে দম্পতি ইচ্ছে করে এসব অভিজ্ঞতা অর্জন করছে বলে মনে হয় না, বাধ্য হয়েই তারা এসব ব্যাপারে অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছেন ।
কিছু কিছু অভিজ্ঞতা আছে, সত্যিই তা আমাদের কাছে চিন্তার বিষয়। কেউ কেউ সারা জীবন শুধু প্রতারণা করেছেন, কেউ কেউ সারা জীবন শুধু প্রতারিত হয়েছেন।
কারও মার খাওয়ার অভিজ্ঞতা আছে, কারও সারজীবন মার দেয়ার অভিজ্ঞতা আছে।
কেউ মেরে মেরে হাত পাকাচ্ছেন, আবার কেউ মার খেয়ে হাড় পাকাচ্ছেন । কেউ সারাজীবন ঘুষ দিয়েই গেলেন, কেউ সারা জীবন ঘুষ খেয়েই গেলেন। কারও জীবনভর উপভোগের অভিজ্ঞতা, কারও দুর্ভোগের অভিজ্ঞতা। কারও হাসার অভিজ্ঞতা, কারও কাঁদার। কারও সুখের অভিজ্ঞতা, কারও দুঃখের অভিজ্ঞতা।
কারও প্রশান্ত থাকার অভিজ্ঞতা, কারও সর্বস্বান্ত হবার।
কারও ভাল কাজ করার অভিজ্ঞতা, কারও মন্দ কাজ করার অভিজ্ঞতা। কারও করুণ অভিজ্ঞতা, কারও সুখদ অভিজ্ঞতা। কারও বউ ঠেঙ্গানোর অভিজ্ঞতা, কারও বউয়ের ঝাঁটা খাওয়ার অভিজ্ঞতা। কারও ভালবাসায় ছ্যাঁকা খাওয়ার অভিজ্ঞতা, কারও এসিড খাওয়ার অভিজ্ঞতা।
কারও বহু বিবাহের অভিজ্ঞতা, কারও বিবাহ বিচ্ছেদের অভিজ্ঞতা, কারও বিবাহ না করার অভিজ্ঞতা।
ব্যক্তিগত পর্যায়ের অভিজ্ঞতা ছাড়াও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের অভিজ্ঞতাও আছে, যেমন বাংলাদেশের দুর্নীতির অভিজ্ঞতা, দারিদ্রের অভিজ্ঞতা, অশিক্ষা, রোগ, মহামারী, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়সহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের অভিজ্ঞতা। এছাড়াও রাজনীতিক অভিজ্ঞতা প্রসূত বিষয়াদি, যেমন দলীয় সন্ত্রাস, হরতাল, বোমাবাজী, কাদাছোঁড়াছুঁড়ি, গলাবাজী, গালাগালি, গোলাগুলি, ক্ষেত্রভেদে চুলাচুলি ইত্যাদি। সামাজিক অবস্থার অভিজ্ঞতা ছিটেফোঁটা বর্ণনা না করলে লোকে আবার আমাকেই অসামাজিক ভাববে। কাজেই ধর্ষণের অভিজ্ঞতা, চাঁদাবাজীর অভিজ্ঞতা, শিশু হত্যা, গুম খুন, টেন্ডারবাজী, নকলবাজী এ সকল অভিজ্ঞতার কথা না বললে আপনাদের অভিজ্ঞতার ঝুলিও সমৃদ্ধ হবে না ।
যাই বলুন, বঙ্গে জন্ম নিয়ে অদ্যাবধি যে অভিজ্ঞতা লাভ করে চলছি তা এক কথায় অনবদ্য, অভূতপূর্ব। পৃথিবীর অন্য কোন প্রান্তে জন্ম নিলে এমন অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ মানুষ হওয়ার বিরল সুযোগ ভাগ্যে জুটত কিনা সন্দেহ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।