যৌতুক কিংবা বরপণ এমন একটি প্রথা যা কোনো পিতা তার কন্যার সম্মান এবং জীবনের মূল্য হিসেবে প্রদান করতে বাধ্য হয় কন্যার স্বামীকে। এ প্রথার উদ্ভব কোথায় কিভাবে তা জানা না গেলেও, প্রতিটা সমাজেই কোনো না কোনো সময়ে এটার প্রচলন ছিলো।
দ্বাদশ কিংবা ত্রয়োদশ শতাব্দীতে কায়রোতে এক সম্রাট, তার কন্যাদের বিয়েতে যে পরিমাণ যৌতুক দিয়েছিলেন, তাতে তার সম্রাজ্যের মেরুদন্ড ভেঙে গিয়েছিলো, কথিত আছে সে সময়ে তার কনিষ্ঠা কন্যার যৌতুক হিসেবে প্রায় ১০ লক্ষ দিহরাম প্রদান করেছিলেন তিনি। জায়গীর এবং অন্যান্য সম্পদের বিবরণ শুনলেও অবাক হতে হয়।
তার প্রিয় দাসীর কন্যার জন্য তার বরাদ্দ ছিলো ১০ হাজার দিহরাম এবং অন্যান্য উপঢৌকন।
একই সাথে ষষ্টদশ শতকে ইউরোপে অসংখ্য অনুঢ়া রমনী ছিলো, যাদের যৌতুকের অর্থ সংগ্রহ করা সম্ভব হয় নি বলে বিয়ে হয় নি। উচ্চ শ্রেনী এবং নিম্ন শ্রেনী এতে বিবেচ্য বিষয় ছিলো না। ইদানিং হয়তো তেমন প্রকট এবং অশোভন যৌতুক প্রথা ইউরোপে নেই। সামাজিকতা রক্ষার নামে এখনও বলকান অঞ্চলে এই প্রথার অনুসরণ হচ্ছে তবে সেটা সমগ্র ইউরোপে তেমন ভাবে প্রচলিত নয়।
সেই প্রবনতা সম্ভবত যুগের সাথে তাল মিলিয়ে আরও বীভৎস আকার ধারণ করেছে, ভারতীয় সমাজে এটার প্রভাব কতটা জঘন্য ভাবে পড়েছে সেটার প্রমাণ পাওয়া যায় সেখানকার কঠোর যৌতুকবিরোধী আইনের খসরা দেখলেই।
১৯৯৪ সালে সেখানে যৌতুকের কারণে ৫১৯৯ জন নারীকে হত্যা করা হয়
Click This Link
যৌতুকের কারণে বিবাহবিচ্ছেদ, সন্তানের পিতৃত্ব অস্বীকার করা কিংবা গর্ভবতী স্ত্রীকে পিতৃগৃহে ফেরত দিয়ে আসা, নানাবিধ অভব্য আচরণ ভারতীয় সমাজে শুরু হয়েছে, এবং উঁচু উঁচু ভবন নির্মানের সাথে সাথে এইসব যৌতুক নির্যাতিতা রমনীর মৃত্যুর সংখ্যাও বেড়েছে।
আমার এক বন্ধুর গল্প শুনে অবিশ্বাস্য মনে হলো, তার বোন, হিন্দী সাহিত্যে পিএইচডি করেছে এবং তেমনই উপযুক্ত একটি পাত্রকে বিয়ে করেছে, সে বিয়েতে যৌতুকের পরিমাণ শুনে আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম। একজন উচ্চ শিক্ষিত যুবক, যার নিজস্ব সম্পদের অভাব নেই, সে ভালো চাকুরি করছে, সে এমন অশোভন এবং অশিষ্ট আচরণ কিভাবে করে?
সেই ভদ্রলোক মাতৃঅন্তপ্রাণ, সুতরাং তার বেতনের সব টাকাই মায়ের হাতে তুলে দেন তিনি, সংসার খরচ চালানোর দায়িত্ব তার উচ্চশিক্ষিত চাকুরীজীবি স্ত্রীর। গত বছর তাদের একটা সন্তান হয়েছে, সেই সন্তান হওয়ার পর থেকে বন্ধুর বোন আর চাকুরী করতে পারছে না, সুতরাং এখন তাকেই নিয়মিত বোনের সংসার খরচ পাঠাতে হচ্ছে- সংবাদটা শুনে ক্ষিপ্ত হলেও তার ভেতরে কিন্তু কোনো বিকার নেই, এটাই সামাজিক প্রথা, আমাদের সমাজের নিয়মটাই এমন-
অন্ধ এবং অসভ্য একটা নিয়মের জালে সবাই আটকা পড়ে আছে, এমনটাই মনে হলো তার কথায়, এবং অন্য সবার ভাবনাও এমনই, তাদের কাছেও যৌতুক গ্রহন এবং যৌতুক বিনিয়মটা অন্যায় কিংবা অশোভন কিছু মনে হয় না। উচ্চশিক্ষিত পরিবারের সদস্যরাও কন্যা সন্তান জন্মানোর সাথে সাথে তার যৌতুকের টাকা জমানো শুরু করেন।
এবং পাত্র ভেদে যৌতুকের পরিমাণ ৫ থেকে শুরু করে ৪০ লক্ষ রুপী হতে পারে। পাত্রের সামাজিক মর্যাদা, তার শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং তার চাকুরির উপরে এই যৌতুকের পরিমাণটা পরিবর্তিত হয়।
প্রকৌশলী, সরকারী চাকুরীজীবি পাত্র হিসেবে সবচেয়ে দামী, একই সাথে অনাবাসী ভারতীয়, যাদের বাইরে চাকুরী আছে এবং যাদের ভবিষ্যতে আরও ধনী হয়ে উঠবার সম্ভবনা আছে, তারাও পাত্র হিসেবে দামী। একজন পিএইচডিধারী পাত্রের মূল্য বিয়ের বাজারে অন্তত ১০ লাখ।
এইসব সংবাদ অনেকটা অবাক এবং বিবশ করে ফেলে আমাকে।
একজনের গল্প শুনলাম, সে বিয়ে করতে গিয়েছে ভারতে, যাওয়ার আগে সে ২৫ জনের প্রাথমিক তালিকা করে গিয়েছিলো, পরবর্তীতে যৌতুক নিয়ে দরকষাকষি করে সেটা নামিয় এনেছে ২টিতে, একজন পাত্রী সুন্দরী এবং যৌতুক কম দিবে, অন্য একজন পাত্রী তেমন সুন্দরী নয়, তবে যৌতুকের পরিমাণটা মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো, সে দ্বীতিয় পাত্রীকে বিয়ে করে নিয়ে এসেছে।
যৌতুক বিরোধী আইন কঠোর ভাবে প্রয়োগ হওয়ার ফলে ইদানিং পাত্রেরা যৌতুকের জন্য তেমন চাপ সৃষ্টি করতে না পারলেও, তাদের বিয়ের এবং বিয়ের পরে ঘর সাজানো এবং চলাচলের ব্যবস্থা করে দেয় মেয়ের পরিবার। এবং এটাকেই তারা স্বাভাবিক হিসেবে মেনে নিয়েছে।
মেয়ের সাথে মেয়ের সংসার সাজিয়ে দেওয়ার যাবতীয় উপকরণ এবং সেই সাথে বিয়ের সমুদয় খরচ পাত্রী পক্ষই বহন করবে, এটাতে লজ্জিত হওয়ার কিছু খুঁজে পায় না আমার উচ্চশিক্ষিত বন্ধুরা, এবং সেটা আমাকে আরও অবাক করে।
তোমাদের শিক্ষিত হওয়ার লক্ষ্য কি তাহলে? তোমরা কি বিয়ের বাজারে নিজেদের দাম বাড়ানোর জন্য এত বেশী শিক্ষার্জন করছো, দিন রাত লড়াই করে ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে ভর্তি হচ্ছো, সরকারী চাকুরীর প্রতিযোগিতার লিপ্ত হচ্ছো।
এবং তোমাদের কি কখনই এ বিষয়ে অনুতপ্ত মনে হয় না।
এটা একটা সামাজিক প্রথা, আমরা না চাইলেও এটা আমাদের দেবে, আমরা কি করতে পারি?
বাংলাদেশের পরিস্থিতি অন্তত ভারতের চেয়ে উন্নত, যদিও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে এখনও কন্যা সন্তান অভিশপ্ত হিসেবেই জন্ম নিচ্ছে, এখানে যৌতুক বিরোধী প্রচারণা এবং সরকার এবং বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ধারাবাহিক প্রচেষ্টায় অন্তত একটা নিম্ন সীমা নির্ধারিত হয়েছে, অনেক পরিবারই এখন যৌতুক গ্রহন করে না, কিন্তু একই সাথে উত্তর বঙ্গের অনেক জেলায়, যেসব জেলায় ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্প শুরু হয়েছে, সেখানে যৌতুকের হারও বেড়েছে।
পূর্বে যেসব ছেলেরা একটা সাইকেল আর একটা হাত ঘড়ি উপহার পেলেই বিয়ে করতে যেতো, তারা এখন ২০ হাজার টাকার নীচে রাজী হতে চাইছে না। এমন কি এখন তারা সাইকেল নয় একটা রিকশা আর একটা টেলিভিশন দাবী করছে যৌতুক হিসেবে। এটা একেবারে নিম্নবিত্ত পরিবারের হিসাব, কিন্তু তাদের তুলনায় একটু ধনী পরিবারের যৌতুকের অঙ্ক সব সময়ই লাখের ঘরে ঘুরছে এবং এরাই পারিবারিক ভাবে স্ত্রী নির্যাতন করছে এবং কখনও কখনও পুড়িয়ে মারছে ।
শুধুমাত্র বিষন্ন হওয়া যায় এইসব সংবাদ পেয়ে, পড়ে। বাংলাদেশের নারী নির্যাতন আইন অত্যন্ত কঠোর, এবং এই আইনে অভিযুক্তের জামিন হয় না। এরপরও নারী নির্যাতন, যৌতুকের প্রকোপ কমছে না, অধিকাংশ সময়ই বিষয়টা সামাজিক স্বীকৃতি পেয়েছে বলেই আদালতে উপস্থিত হতে পারছে না।
যারা শিক্ষিত তারা আবার ঘর সাজিয়ে দেওয়ার প্রথায় বিশ্বাসী। অথচ এটাও যে যৌতুকের একটা আলাদা তরিকা এটা মানতে তারা নারাজ।
তারা যৌতুক প্রথাকে ঘৃণা করে, অনেকে সামাজিক মর্যাদার জন্য মেয়েকে সাজিয়ে দিতে চায়।
সাম্প্রতিক একটি বিয়েতে মেয়ে পক্ষের বিয়ে বাবদ বরাদ্দ শুনে আমার রীতিমতো বিবমীষা জেগেছিলো, হতে পারে তাদের প্রচুর বিত্ত- কিন্তু একটা মেয়ের বিয়ের জন্য ২ কোটি টাকা খরচ করে ফেলানোটা রীতিমতো অপরাধ মনে হয়, এবং অন্য সব পোশাকশিল্প মালিকদের কন্যাদের বিয়েতেও নাকি ইদানিং বরাদ্দটা ৫০লাখ থেকে ৭৫ লাখের কোটায়।
আমাদের মতো দরিদ্র দেশে সস্তা শ্রমের ঘাম শুষে নিয়ে নিজের কন্যার বিয়েতে এমন অপরিমেয় অর্থ অপচয় করাটা কোনোভাবেই আমার কাছে শোভন মনে হয় না, কিন্তু বাস্তবতা হলো এটা তাদের কাছে খুব স্বাভাবিক সামাজিকতা রক্ষার একটা বিষয়।
অথচ এই প্রথা কিংবা অসভ্যতা অন্য সবার সামনে যে বিকৃত উদাহরণ সৃষ্টি করছে সেটার প্রভাব সম্পর্কে তারা ওয়াকিবহাল নয়, কিংবা তারা এটার অশুভ প্রভাবকে কোনোভাবেই অস্বীকার করতে না পারলেও অবজ্ঞা করে যাচ্ছে।
ভারতের সমাজে ধারাবাহিক অবহেলায় এখন অধিকাংশ দরিদ্র পরিবারের পিতা তার শরীরের প্রত্যঙ্গ বেচে কন্যার বিয়ের যৌতুক প্রদান করছে।
বাংলাদেশেও হয়তো এমনই দিন সামনে আসবে, বিয়ের নামে শিক্ষিত এবং ধনীদের এমন অশোভন পয়সার লড়াই দেখে বাংলাদেশের সমাজও একদিন তার দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে বাধ্য করবে নিজের প্রত্যঙ্গ বেচতে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।