আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পথের গল্প ০০৬

অতি দক্ষ মিথ্যুক না হলে সত্যবাদিতা উৎকৃষ্ট পন্থা

কোথাও নির্ধারিত সময়ের ভেতরে পৌঁছাতে হবে এবং বাসা থেকে বের হতে দেরী হয়েছে, এমন সব দিনে আমি বাসের কথা চিন্তাও করি না এখন। ঢাকা শহর হঠাৎ হঠাৎ স্থবির হয়ে যায়, আমার হাতে সময় আছে খুব বেশী হলে ৩৫ মিনিট, তবে যদি রাস্তায় কোনো জ্যাম না থাকে তবে বাসে সেখানে পৌঁছাতে লাগে ১২ মিনিট, কিন্তু বাসা থেকে বাসস্ট্যান্ড যাওয়ার এবং সেখানে গিয়ে অপেক্ষা করবার সময়গুলো বিবেচনা করে প্রথমেই ঝেড়ে ফেললাম চিন্তাটা মাথা থেকে। একমুখী সড়ক ব্যবস্থা তেমন কোনো উন্নতি করে নি ঢাকা শহরের ট্রাফিকের অবস্থা আগের মতোই ভয়াবদ, তার উপরে আমি যেখানে যাবো সেখানে যেতে অন্তত দুটো বড় রাস্তা পার হতে হবে যেগুলোতে রিকশার প্রবেশ নিষেধ। এটাও একটা দুর্ভোগ। তবে মধ্যবর্তী অঞ্চলে রিকশা চলাচল করতে পারে।

কিন্তু অন্য সব দিন এই পরিস্থিতিতে যেকোনো রিকশাকে জিজ্ঞাসা করলেই সে মুখের উপরে না বলে রিকশা টেনে চলে যায়, কিন্তু দিনটা ব্যতিক্রম বলতেই হবে। এ্যাঁই রিকশা যাবে, বলে হাঁক দেওয়া মাত্রই রিকশাওয়ালা ভদ্রভাবে জানতে চাইলো কোথায় যাবেন? জায়গার নাম শুনে বললো, হ্যাঁ যাবো, কিন্তু আমি তো এই দিকে নতুন, ভাড়া জানি না, আমাকে ঠকাবেন না। আমি সামনের সিগারেটের দোকান থেকে একটা সিগারেট ধরিয়ে নাকে মুখে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললাম চলেন। ভাই একটু অপেক্ষা করেন, সামনের বাসায় ভাইয়া বলছে আমার মেয়ের জন্য বই দিবে, তার ফোন নাম্বারটা লিখে রাখি। আপনার মেয়ে কোন ক্লাশে পড়ে? এইবার ক্লাশ নাইনে উঠলো।

আপনার কয়জন ছেলে মেয়ে? আল্লার দয়ায় ধরেন ৫টা, বড়টা অপেন ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। আমার মধ্যবিত্ত সংকোচ আমাকে পেয়ে বসে, আমি একজনের রিকশায় উঠে বসে আছি, যার ছেলে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, এবং এই সংকোচ আমি কাটাতে পারি না। বুঝলেন ভাই আজকে শরীরটা খারাপ, জ্বর জ্বর লাগছিলো, ছেলে বললো, বাবা তোমার যাওয়ার দরকার নাই কিন্তু একজনের কাছে হাওলাত করছি ৪০০ টাকা সেইটা ওকে সোমবারেই ফেরত দিতে হবে। নিজের চিকিৎসার খরচ আছে, ডাক্তারের কাছে গেলে টেস্টের খরচ আছে, বাসায় বসে থাকলে তো টাকা পাওয়া যাবে না। আমি কোনো কথা না বলে মৌন থাকি, আরও কিছু দুর যাওয়ার পরে বললো, আমি তো ভাই রিকশা চালাই না, এই কয়েক দিন হলো রিকশা চালাইতাছি, যদি হাতে কিছু টাকা আসে তাহলে ব্যবসা করবো বুঝলেন।

আমার ছোটোভাইটা বড়লোক, ওর কাছে টাকা চাইলেই পাওয়া যাইতো কিন্তু ওর বৌটা বুঝলেন ভালো না, সারাক্ষণ খ্যাচখ্যাচ করে, বৌয়ের কথা চিন্তা করে ভাই আমাকে টাকা দিতে পারে না। আমি কিছুক্ষণ পর বললাম, আচ্ছা আপনার কোনো ধারণা আছে আমি কি করবেন? আমার হাতে টাকা না থাকলে তো আর ব্যবসার হিসাব করে লাভ নাই। টাকা অন্য মানুষের পকেটে থাকবে আর আমি ব্যবসার হিসাব করবো এমন তো হবে না। টাকা হাতে আসলে ব্যবসার চিন্তা করা যায়। যত টাকা থাকবে তার উপরেই ব্যবসার চিন্তা।

আমি অকাট্য যুক্তিতে হেরে মিনমিন করে বললাম তাও একটা ধারণাতো আছে, মিনিমাম কত হলে একটা ব্যবসা দাঁড়া করানো যায়। ধরেন গাবতলী থেকে কলা কিনে অন্য সব দোকানে সাপ্লাই দিলেও লাভ থাকবে,এই ব্যবসার জন্য ধরেন ৬০০০ টাকা পুঞ্জী লাগবে। আমি আর কোনো কথা না বলে চুপ থাকলাম কিছুক্ষণ। আমার বড় মেয়েটার এইসএসসি পরীক্ষার কোচিং চলতেছে, তো পরীক্ষার ফিস আর কোচিংয়ের ফিস মিলে লাগবে ৩০০০ টাকা। তো মেয়ে আইসে বললো, বাবা ৩০০০ টাকা লাগবে, আমার কাছে তো টাকা নেই, আমি তখন হাতের মোবাইলটা বন্ধক রাখি পাইলাম ২৬০০ টাকা, সেই টাকা থেকে ২০০০ টাকা দিলাম মেয়েকে , ওর পরীক্ষার ফর্ম ফিলাপ করতি হবে।

আর বাকি ৪০০ টাকা দিলাম ওর কোচিংয়ের স্যারকে। স্যার অবশ্য ভালো মানুষ, বললো আমার টাকার দরকার নাই, আপনি পরে সুবিধামতো সময়ে দিলেই চলবে। কিন্তু সেইটা তো হয় না, টাকা তো দিতেই হবে। আর বাকি টাকা দিয়ে ঔষধ কিনলাম। তারপরও সেইখানে ধরেন ৪০০ টাকা বাকি সেটাও দিতি হবে।

ছেলে মেয়ে বলছে বাবা রিকশা চালানোর দরকার নেই, কিন্তু কি করবো কন? আমি কিছুই উত্তর দিতে পারি না, কিংবা এসব কথার কোনো উত্তর হয় না আসলে। তাই জিজ্ঞাসা করলাম আপনি আগে কি করতেন? আমার একটা চায়ের দোকান ছিলো গুলশানে, সেই দোকান বেচে পয়সা দিয়েছিলাম এক আদম ব্যাপারীকে সে টাকা নিয়ে উধাও হয়ে গেছে অবশ্য আমার বন্ধুরা বলেছে ও টাকা আমি ফেরত পাবোই। কিন্তু সেটা না পেলে কিভাবে হবে? এটা তেমন নতুন কিছু না, এমন অনেক মানুষই এমন প্রতারণার শিকার হচ্ছে বাংলাদেশে। তো এই লোক কোন কোম্পানীর হয়ে কাজ করে? তাতো জানি নে, ঐ লোক সৌদিতে থাকে, মাঝে মাঝে আমার দোকানে এসে চা খেতো, সেই থেকে পরিচয় হলো, বিশ্বাস হলো, তাকে টাকা দিলাম তারপর তো তার আর দেখা নাই। তো কত টাকা দিয়েছিলেন ওকে।

দোকান বিক্রী করে দেড় লাখ টাকা দিয়েছিলাম, কিন্তু ওকে না পেলে তো আর টাকা ফেরত পাবো না। আমার বিশ্বাস আমি এই টাকা ফেরত পাবোই পাবো, আমার বন্ধুরা সব জায়গায় খুঁজতেছে, যেদিন খুঁজে পাবো ,সেই দিন না হলেও টাকা তো ফেরত পাবো। তো তার নাম মনে আছে আপনার। আজমল, আমার গন্তব্য চলে এসেছে, আমাকেও নেমে যেতে হবে। এখানে একজন রিকশাওয়ালা, যার পূর্বে একটা চায়ের দোকান ছিলো, যা বেচে সে সৌদীতে গিয়ে ভাগ্য পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেছিলো, এবং সেই মানুষটাই তার টাকা নিয়ে উধাও হয়ে গিয়েছে, তার ঘরের এক মেয়ে নাইনে উঠেছে, তার বই কিনবার পয়সা নাই, অন্য মেয়ের পরীক্ষার ফি, স্যারের বেতন দেওয়ার পয়সা নাই, তার নিজের চিকিৎসার প্রয়োজন, এইসব অসংখ্য সমীকরণের মাঝে আমি পকেটে হাত দিয়ে দেখলাম মাসের শেষের দিকে তেমন নগদ নেই, তবে আজ বেতন পেলেও পেতে পারি, না পেলে হয়তো হেঁটে আসতে হবে বাসায়, নাইলে ধার করতে হবে, পকেটে হাত দিয়ে খুঁজে পেলাম একটা ১০০ টাকার নোট, আর অন্য পকেটে খুচরা পয়সা মিলিয়ে হয়তো আছে ৩৫ টাকা, কি আর হবে, ভাড়া খুব বেশি না, ১২টাকা, ১০০ টাকা দিয়ে পাশের লোকটার কাছ থেকে কলম ধার নিয়ে একটা কাগজে নিজের টেলিফোন নাম্বার লিখে দিয়ে বললাম, ভাই যদি ঐ লোকটার কোনো খোঁজ পান কিংবা তার ট্রাভেল এজেন্সীর কোনো ঠিকানা পান আমাকে এই নাম্বারে ফোন করে জানায়েন।

আপনার কোনো মোবাইল নাম্বার আছে যেখানে কন্টাক্ট করা যাবে। বললাম না আমার মোবাইলটা বন্দক দিছি। আমি আর কথা না বাড়িয়ে রওনা দিলাম, রাস্তা পার হয়ে অন্য দিকে রিকশা চাপতে হবে- আমি তো ভাই রিকশা চালাই না, দেখি যদি কিছু টাকা পাই

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।