এমনি এমনি ঘুরে বেড়াই
গত দু’তিন দিন যাবত হাল্কা শীত পড়েছে মনে হচ্ছে। ফ্ল্যাটবাড়িগুলোর থাই গ্লাসের জানালা গলে শীতের শুরুর দিকের এই আমেজ আর ঘরের ভিতর ঢুকতে পারে না। আজ সকাল সকাল বাস ধরার জন্য বের হয়ায় এই শীতটুকু টের পেলাম। ভাগ্যিস বের হয়ার সময় মা গায়ের চাদরটা নিয়ে নিতে বলেছিল। নইলে এখন বাসে বসে আরাম করে ঝিমানোর বদলে ঠকঠক করে কাঁপতে হতো।
বাস স্টার্ট দেয়া মাত্রই আমার ঝিমুনিটা কেটে গেল। একটা খুশি খুশি ভাব চলে আসলো। অনেক দিন ধরে বাসার সবাই মিলে কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয় না। এবার ছুটিটা একদম ঠিক সময়ে পেয়েছি।
কোথায় যাচ্ছি তাই তো বলা হলো না......যাচ্ছি ময়মনসিংহে...আমার ছোট্টোবেলার শহরে।
ব্রহ্মার পুত্র যে শহরটাকে আপন করে আগলে রেখেছে......সাথে আমার ছেলেবেলার স্মৃতিগুলোকেও।
তখন আমার বয়স খুব বেশি হলে চার কি পাঁচ বছর হবে। কোন একটা ছড়ার বইয়ে একটা ছড়ার শেষের লাইন ছিল -
“ঊর্মিগুলো নদীর উপর এপার-ওপার ভাসে”
‘ঊর্মি’ শব্দের অর্থ জানা ছিল না। দৌড়ে গেলাম বাবার কাছে,
- “ বাবা! বাবা! ঊর্মি মানে কি?”
- “ঊর্মি মানে ঢেউ... নদীর ঢেউ দেখেছ না......সেই ঢেউ। ”
- “নদীতে তো পানি দেখি ।
পানিকেই কি ঢেউ বলে?”
- “আরে না!পানির উপর উচু-নিচু হতে দেখ নাই? ”
- “ঊহু”
- “কি বলে মেয়ে? ঐ যে কিছুদিন আগে আমরা ট্রেন এ করে যাওয়ার সময় না তোমাকে নদী দেখালাম। তখন দেখ নাই?”
- “হু, দেখলাম তো। পানি-ই তো ছিল। অনেক বেশি পানি। এটাকেই ঢেউ বলে?”
আমার ছোট্টো মস্তিষ্কে কেন যেন ‘ঢেউ’ বস্তুটি কি ঢুকতে চাইছিলো না।
বাবাও ধৈর্যশীল শিক্ষক এর মতো আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করতে লাগলেন।
একটা লাল রঙের বড় সাইজের বাটিতে পানি নিয়ে তাতে আঙ্গুল দিয়ে নাড়া দিয়ে বললেন
- “ এই যে দেখ! পানিটা কেমন করে বাটির গায়ে ধাক্কা দিচ্ছে । বাতাসে নদীর পানিতেও এমন ধাক্কা লাগে। পানিগুলো উচু-নিচু হয়ে যায়। সেটাই ঢেউ।
"
আমি কিছুক্ষন বোকার মতো সেদিকে তাকিয়ে থেকে বললাম
- “কই ধাক্কা দিচ্ছে? এখানে তো বল এর মত কি যেন? মা তো বলছে এইগুলাকে বুদবুদ বলে। ”
বাবা আবারও সেই বাটির মাঝে কৃত্রিম ঢেউ তৈরি করে আমাকে বোঝানোর বৃথা চেষ্টা করলেন।
আমার গোবর মাথায় বেপারটা কিছুতেই ঢুকছিলো না।
বাবা এবার বৃহৎ পরিসরে আমাকে বোঝানোর চেষ্টায় নামলেন।
কাপড় ধোয়ার বড় নীল বালতিতে পানি ভরলেন।
তার মাঝে আমার নতুন কেনা ডোনাল্ড-ডাক বসানো নৌকা যেটা চাবি দিলে চলতো সেটা ছেড়ে দিলেন। আমার তখন বুক ধুকপুক করছে।
এই বুঝি আমার নৌকাটা নষ্ট হলো। আমার বাবার ‘ঢেউ শিক্ষার ক্লাস’ থেকে খেলনাটা নিয়ে পালাতে পারলে বাঁচি - এই অবস্থা!
বাবাও নাছোড় বান্দা। আমাকে বুঝিয়েই ছাড়বে।
যখন দেখলাম আমার সেই নৌকা কোনো ক্ষতি ছাড়াই পানিতে কি সুন্দর করে চলছে -আমার খুশি আর ধরে না। বাবা ‘ঢেউ কি” বোঝানোর চেষ্টায় তখনো তৎপর। ওদিকে আমি আমার খেলায় মগ্ন। কে শোনে কার কথা!
অবশেষে অবস্থা বেগতিগ দেখে বাবা সেদিনের মত ক্ষান্ত দিলেন। পরদিন খুব সকালে আমাকে ব্রহ্মপুত্রের তীরে পার্কে নিয়ে গেলেন।
সেখানে ‘ঢেউ শিক্ষা ক্লাস’ এর বাকী অংশ সম্পন্ন করলেন। বাবার হাত ধরে ছোটো ছোট পায়ে হেঁটে গিয়ে ‘নদ’ এর পাড়ে বসে দেখলাম ‘ঢেঊ’ কি!
এটাই ছিল আমার জীবনের প্রথম প্র্যাক্টিক্যাল ক্লাস!!
বাস এর মধ্যে ঢাকা ছেড়ে শহর এর বাইরে চলে এসেছে......
যেতে যেতে ছোটোবেলার কথাগুলো একের পর এক গল্পের বই এর পাতার মত আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে......।
(মনে হয় চলবে…….. )
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।