আমি লিখি মানুষের কথা,মানুষ পড়ে না। তারা হাসে। তাদের হাসির জন্যে আমি লিখি 'সবকিছু হাসির বিষয় নয়' তারা হাসে না! তবু আমি লিখব।
ফাঁকা রাস্তায় হু-হু করে ছুটে চলেছে ট্রাক। বাতাসের ঢেউ ভেঙে এগিয়ে চলেছে, পিছিয়ে পড়ছে পিচরাস্তা।
সকলের যেন ঘরে ফেরার তাড়া।
দাঁতে-দাঁত চেপে তৈমুর বললো--টেপটা বন্ধ কর খোকনা, শ্লা হিন্দি গান শুনে কান পচে গেল।
স্টিয়ারিংয়ে হাত পড়লেই তৈমুরের চেহারা, চোখমুখ আলাদা হয়ে যায়। নাকি মাথায় খুন চেপে যায় বুঝতে পারে না খোকন। সে শুধু ভয়ে-ভয়ে
থাকে।
হুকুম তামিল করে।
এখন বেজে চলা টেপের সুইচ বন্ধ করলো খোকন, কিন্তু মুখে বললো--টেপের গানা আর হোটেলের খানা, এই তো আমাদের কপালের লেখন
ওস্তাদ।
খোকনের কথায় মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠলো তৈমুরের মুখে। বললো--তা যা বলছিস মাইরী, হাজার চেষ্টা করেও আমরা কপালের লেখন বদলাতে
পারি না।
কথাটা বলেই তৈমুরের মনটা কেমন যেন বাতাসের মতো হাল্কা হয়ে গেল।
বললো--খালি গলায় একটা গান ধরতো।
খোকন গান ধরলো--
মানুষ হইয়া জনম লইয়া মানুষের করিলাম কি।
খোকনের গেঁয়ো-সুরে গাওয়া গান ছড়িয়ে পড়ে বাতাসের শরীরে। তৈমুরের মনে। উদাস হয়ে যায় সে।
হাত স্টিয়ারিংয়ে, চোখ সামনে ছুটে আসা
পিচরাস্তায়। মন শুধু উদাস হয়।
সুরের মায়াজালে ভেসে ওঠে কোন এক মায়াবী মুখ।
জরিনা তার পথচেয়ে বসে আছে।
আর মাত্র তিরিশ কিমি পথ।
রাইস মিলে ট্রাক ঢুকিয়ে দিয়ে ছুটি পাবে । দু-কিমি মেঠোপথে হেঁটে পৌঁচে যাবে খড়-ছাওয়া মাটির ঘরে।
চকিতা হরিণীর মতো জরিনা তার হাত-পা ধোয়ার পানি দেবে। উনুন জ্বেলে রান্না করবে। তারার মতো চোখ জ্বলজ্বল করবে তার।
চৌকিতে শুয়ে থাকা বাবা গোঁ-গোঁ শব্দ করবে। কতদিন মুখে কথা নেই। গোঁ-গোঁ শব্দে আনন্দ প্রকাশ করে। কাছে গিয়ে বসলে ঠোঁটে হাসি ফোটে।
চোখে ভাসে জলের বিন্দু।
মানুষটা খুব সাদাসিধে ছিল। সেই সরলতার দাম দিয়ে গেছে এককাল মালিকের গোলামী করে। এখন সেই লাঙলে জুড়ে দিয়েছে তৈমুরের নাম।
রাইস মিলের ট্রাক চালাতো বাবা। বেশ স্বছন্দ ছিল সংসার, জীবন।
গোল বাঁধালো একটা অ্যাক্সিডেন্ট।
ট্রাকের ধাক্কায় আহত হয়েছিল একজন পথচারী। অন্য কোন ড্রাইভার হলে পিষে দিয়ে চলে যেত। বাবা তা পারেনি। পাবলিক সেটা বোঝেনি।
বেদম মারে কাহিল করেছিল। তারচেয়েও বেশী কাহিল করেছিল মালিক। বলেছিল--পিষে দিয়ে চলে এলে তুইও বাঁচতিস, আমিও বাঁচতাম।
এখন থানা-পুলিশ, হাসপাতাল-কোর্ট কত জায়গা ছুটতে হবে। কতো জরিমানা লাগবে তা-ই-বা কে জানে।
বাবা বোঝেনি, পিষে দিয়ে চলে গেলে মুক্তি। গাড়ীর নম্বর কেউ যদি মনে রাখতে পারতো তবে। গাড়ির এবং ড্রাইভারের জামিন নিতে মালিকের
খরচ হতো পাঁচশো টাকা। নিহত পথচারীর পরিবার পেত সরকারী বিমার ক্ষতিপুরণ।
আদালতের রায়ে ওই আহত পথচারীর যা ক্ষতিপুরণ লেগেছে তা বাবার মাইনে থেকে নিত্যদিন কেটে নিয়েছে মালিক।
এখনও কাটছে তৈমুরের
মাইনে থেকে। আরো তিনপুরুষ হয়তো এ-ভাবেই যাবে।
রামপুর পেট্রোল-পাম্পের কাছে এসে ঘটনাটা ঘটে গেল।
পথচারী পড়ে গেল সামনে।
তৈমুর ইচ্ছে করলে ওকে পিষে দিয়ে চলে যেতে পারে নিরাপদ গন্তব্যে।
তাই করবে নাকি পঙ্গু হয়ে পড়ে থাকা মানুষটার মতো বোকামী?
খোকনের গান থেমে গেছে। সে অবাক হয়ে দেখল, অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতায় ব্রেকে পা টিপে ছুটে চলা যন্ত্রযানের গতিরোধ করেছে তৈমুর। কাঁপা
ঠোঁটে বললো--চল, লোকটাকে আমরা হাসপাতালে দিয়ে আসি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।