যে শিক্ষক বুদ্ধিজীবী কবি ও কেরানী প্রকাশ্য পথে হত্যার প্রতিশোধ চায়না আমি তাদের ঘৃণা করি
১
ঝিমধরা আকাশ থেকে অকৃপণ বৃষ্টি ঝরে চলেছে। উত্তরের আকাশ অনেকটা নীচে নেমে এসেছে, যদিও তা দেখার উপায় নাই। যদিও তা বোঝার উপায় নাই। ইন্তাজ মিয়ার বস্তিতে কখনো সূর্য ওঠে না। ইন্তাজ মিয়ার বস্তিতে কখনো আকাশ দেখা যায় না।
হারানরা বড় হয়েছে আকাশ না দেখে না দেখে। শুধু মাত্র বড় রাস্তায় গেলে একটুকরো ধোঁয়াটে আকাশের দেখা মেলে। যদিও এ নিয়ে হারান বা তার মত কারোই তেমন কোন মাথাব্যথা কোন কালেও ছিল না। হারানের পিচুটি লাগা চোখ তা বাদে অনেক কিছুই দেখে। মনে রাখে না, কিন্তু দেখে।
সক্কাল বেলা গার্মেন্টের মেয়েগুলোকে কুচি পায়ে দৌড়াতে দেখে। জয়নাল, খবির, রসুল আর শমশেরকে তেল দেওয়া চুলে তেড়ি কেটে রিকসা নিয়ে বেরিয়ে যেতে দেখে। আব্দুল বুড়ো বিড়ি ফুকতে ফুকতে খুক খুক কাশে আর ক্যাঁচোর ক্যাঁচোর করে রিকসা টানে। তাকেও দেখে। দুপুরে জবা, মিনতি, কুলসুম এমন কয়েকজনকে মুদি দোকানে ফিস ফিস করতে দেখে।
আর দেখে রাতে তার মা হঠাৎ মোটা হয়ে যায়। দুই জন হয়ে যায়। কি সব ফিস ফিস কথা শোনে আবার সব নিশ্চুপ। ঝিমধরা আকাশ আরো নিচে নেমে এসেছে। হারানের বাপ আজ কাজে গেল না।
সারা দিন বিড়ি ফুকবে আর মা’র সাথে ক্যাচাল করবে। হারান এক একটা দিন এভাবেই পেছনে ঠেলে দেয়। এমনিতেও দিনগুলো চলেই যেত, তথাপি হারানের মনে হয় যত দিন যাবে, ও তত বড় হতে থাকবে। ও বড় হবে আর বেশি বেশি চাল, বেশি বেশি ভাত। সাদা সাদা জুঁই ফুলের মত ফকফকা ভাত।
ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত!
২
ঝিম বর্ষা কেটে মাস দুয়েক পরে বেশ ফকফকা আকাশ। তাও হারানকে বড় রাস্তায় গিয়ে দেখতে হয়। গত দুই মাসে হারানের বাপ আর একটা ‘মা’ ধরে ভেগেছে। ওর মা হারানদের চারটেকে নিয়ে সেই আগের ঝুপড়িতে এখনো। এসব কোন বিকার হারানকে ধরে না।
ওর মাথায় সেই পুরোনো চিন্তা। যত বড় তত বেশি ভাত। তারও তিন মাস পরে হারানদের সেই ঝুপড়িটাও ছাড়তে হয়। এবার ঝুপড়ির বারান্দা। একচিলতে বারান্দায় হারানের মা কুকুর ছানার মত চার চারটে বাচ্চা নিয়ে কোঁকাতে থাকে।
ইন্তাজের বস্তি এবং এর আশেপাশের ঘিনঘিনে এলাকার এ নিয়ে কারো দিনপ্রবাহে সামান্যতম বিচ্যুতিও ঘটে না। চোখ সওয়া। বড় রাস্তার ওপারে, আরো মাইলখানেক গেলে যে কাঁচঘেরা বাড়ি সেখানে হারানের মা খুব সকালে যেয়ে সেই রাতে ফেরে। সাথে ভাত থাকে বলে হারানের কষ্ট নেই। হারান সারা দিন তিন ভাই-বোন নিয়ে অপেক্ষায় কাটিয়ে দেয়।
জানে, রাতে মা এবং ভাত একই সাথে আসবে। কিন্তু একদিন আসে না। মা আসে। ভাত আসে না। হারানকে বিড় বিড় করে কি কি সব বলে ওর মা।
হারানের কানে সে সব কথা ঢোকে না। কি বুঝে চুপ করে শুয়ে পড়ে। ক্ষিদেয় ঘুম আসার কথা নয়, অন্তত তেমনটিই সাধারণের ধারণা! কিন্তু এখানে অংকের হিসেব-নিকেশ খুব সহজেই মিলে যায়। হারানরা ঘুমাতে পারে, কারণ এই আধপেটা খাওয়া নতুন কিছু না।
৩
পর দিন সকালে হারান ছোট্ট একটা ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।
মা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে-
-হারান কই যাছ ?
-চাইল আনতে। খুব সোজাসাপ্টা কথা। মা আরো অবাক হয়-
-চাইল কি রাস্তায় গড়াইতেছে নাকি? তরে এই বুদ্ধি ক্যাডা দিছে?
-চাইল আনতে যাই। আবারো সেই নির্লিপ্ত উত্তর। ওর মায়ের কপালে ওঠা চোখের সামনে দিয়ে হারান হনহনিয়ে চলে যায়।
তার পর ওর মা ফ্ল্যাশব্যাকে কি কি ভেবেছিল সেই ভাবনার হাত ধরে আমরা এগুব না।
৪
হারান সটান চলে গেছিল মিয়া বাজারের চালের আড়তে। অনেকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে তারপর এক সায়েবের চালের ব্যাগটা রিকসায় তুলে দিয়েছিল। আড়তদার প্রথমে ঝামটা দিয়ে উঠলেও কি মনে করে পরে আর কিছু বলেনি। হয়ত হারানের করুন মুখটাই এর কারণ।
জানা যায় না। কেননা অমন অনেক করুণ মুখ প্রতিদিন শত শত ঝামটা আর নিকেশি গালি খেয়ে অভস্থ, আর মহাজনও রগরগে গালি দিয়ে অভ্যস্থ। ঘন্টা কয়েক বাদে হারান সাহস করে এলামেলো ছিটিয়ে থাকা চাল ঝাড়ু দিয়ে একখানে গুছিয়ে দেয়। দিন শেষে হারানের সেই ছোট্ট ব্যাগে কেজি খানেক চালের যোগান হয়ে যায়। হারান বীর দর্পে বাড়ি ফেরে।
গল্পের এখানটাতে কোন রকম ট্যুইস্ট নেই। আমরা এই গল্পটা এখান থেকে টেনে অন্য চমৎকার পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে পারি। হরহামেশা যা হয়ও, কিন্তু এখানে তেমনটি ঘটবার সুযোগ নেই।
৫
হারান, গেদি,শাবানা, বেলি আর তাদের মা। এই পাঁচজনের সেই বারান্দার সংসার হিসেবমত ভালই চলার কথা।
বড় রাস্তায় কার্পেটিং হয়। জয়তুনের বিয়ে হয়। বিয়ের পর পরই জয়তুন এই বস্তি ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যায়। সেই আব্দুল বুড়ো হঠাৎ মরে যায়। সারা বছর টুপি না পরা মানুষগুলো কি কি সব সুর করে বলে আর একটা খাটিয়ায় বুড়োকে নিয়ে যায়।
বিকেলে খাটিয়াটা ফিরে আসে। বুড়ো ফেরে না। এরই মধ্যে হারান প্রতিদিনই একটু একটু করে বড় হতে থাকে। হারান আগেই জানত-ও যত বড় হবে, তত চাল বেশি আসবে। কোথা থেকে কি হয় হারান বা তার মা বোঝে না।
হারান খুব শরীর খারাপ নিয়ে বারান্দায় শুয়ে থাকে। কবিরাজ এসে কি সব গাছের রসটস দিয়ে যায়। হারানের গলা দিয়ে সেসব জ্বলতে জ্বলতে নামে। দশ-পনের দিন পর হারান আবার সেই ব্যাগ হাতে। বড় রাস্তা।
মিয়া বাজার। চালের আড়ৎ। অসুখের কারণে হারানদের ঘরে যা ছিল তা শেষ। দুর্বল শরীর নিয়ে হারানের সেই ছোট্ট ব্যাগে আজ আধা কেজি চালও হয়নি। হারান বড় হয়েছে, তাই সে জানে আরো চাল দরকার।
সবার অলক্ষে হারান আড়তের একেবারে শেষ মাথায় চলে যায়। লাট দেওয়া চালের বস্তা ছাত পর্যন্ত ঠেকেছে। দুই সারি বস্তার ফাঁকে যে একচিলতে জায়গা সেখানে হারান গুটিশুটি মেরে বসে থাকে। ও জানে আর একটু পরেই মহাজন তার লোকজন নিয়ে চলে যাবে তালা বন্ধ করে! তখন সে ইচ্ছামত ব্যাগ ভরে চাল নিয়ে বাড়ি যাবে.....
কিন্তু অতটুকু মাথায় এটা আসে না যে বন্ধ আড়ৎ থেকে সে বেরুবে কি করে! একসময় সবাই চলে যায়। হারান উঠে দাঁড়িয়ে ভোমা দিয়ে বস্তা ফুটো করে তার নিচে ব্যাগ পেতে ধরে......হড়হড়িয়ে চাল পড়তে থাকে.....একসময় ছোট্ট ব্যাগটা ভরেও যায়.....হারানের খুব রাগ হয় কেন সে আজ একটা বড় ব্যাগ আনেনি! সেই ছোট্ট ব্যাগটা নিয়ে এবার হারান ফিরে যেতে চায়.....কিন্তু একি! হঠাৎ হুড়মুড় করে উপরের বস্তাগুলো গড়িয়ে পড়তে থাকে......প্রথমটা পায়ের উপর....তার পরেরটা বুকের উপর.....তারপর আরো.....শেষ দিকে নিজের কানেই গোঙানির শব্দটা আসে..... চিৎকার করে মা-কে ডাকতে চায়...... গলা দিয়ে কোন শব্দ বেরোয় না! আবারো জোরে মা-কে ডাকে.....মা যেন অনেক দূরে, তাই মনে হয় শুনতে পাচ্ছেনা, আরো জোরে ডাকতে হবে.....হারান দেখে হঠাৎ সে আকাশে উড়ছে! মেঘের উপর বসে উড়ছে.....অনেক নিচে ওর মা, গেদি, শাবানা, বেলি ওরাও প্রজাপতির মত উড়ে বেড়াচ্ছে.....হারান চিৎকার করে ওদের ডাকে, ওরা শুনতে পায় না.....হারানের রাগ হয়, আবার ডাকে, আবার...তারপর ডট।
পুনশ্চঃ এটা কোন গল্প নয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।