বেদনার পায়ে চুমু খেয়ে বলি এই তো জীবন
বেলা এখন বেশ বেড়েছে। রোদজ্বলা লালাভ আকাশটা যেন নিচে নেমে আসছে একটু একটু করে; সেই সাথে তেজী সূর্যটাও। সারাদিনের খেটে খাওয়া মুখপোড়া ব্যস্ত পৃথিবীর সাথে কিসের যেন বোঝাপড়া তার। তালে তাল মিলিয়ে ঝাঁ ঝাঁ করতে থাকে মাঠ-ঘাট, প্রান্তর। ধূলো ওড়ায় পথের হাওয়া।
তখন, ক্ষেতের আল ধরে সবার অলক্ষ্যে, দ্রুত পায়ে হাঁটতে থাকে ঘোমটা টেনে মুখ লুকানো একটি দেহ। পা টলে যেতে চায়। ক্লান্তি হার মানতে চায় সুদীর্ঘ পথের কাছে। তবু ত্রস্তা নারী থামে না। ঘোমটার আড়ালে সাবধানী চোখ নেড়ে পথ চলে।
কেউ চিনে ফেলল নাতো? না না! কেউ চিনে ফেলার আগেই তাকে পৌঁছাতে হবে শ্যামনগর। সময় বেশি নেই। রুদ্ধশ্বাস বুকে চেপে আরও দ্রুত পা চালায় সে।
একে ওকে জিজ্ঞেস করে করে বাড়িটা খুঁজে পেতে বেশ বেলা বয়ে যায়। গাছপালায় ঢাকা শান্ত বাড়িটার আশে পাশে তেমন বাড়ি-ঘর নেই।
শেষ যে কটা দেখেছিল তাও অনেক আগে হারিয়ে গেছে পথের বাঁকে, গাছের আড়ালে।
বুকের ভেতর দুরু দুরু করে কাঁপতে থাকে হাসনার। কাউকে দেখা যাচ্ছে না। শোনা যাচ্ছে না কারও কণ্ঠস্বর।
অবশ্য কেউ যে থাকবে না সেটা আগে থেকেই জানা আছে তার।
বোধহয় সে জন্যই, কারও না থাকাটাই বিশেষ একজনের উপস্থিতির কথা আরও প্রকটভাবে জানান দিচ্ছে। ভেতরে ভেতরে গুটিয়ে যেতে থাকে হাসনা। মনে মনে গালাগাল করে যমুনাকে। মাগীটার জন্যই তো এখানে আসা। গালাগাল করে নিজেকেও।
ফিরে যাবে কী? বেলা তো এখনো পুরোপুরি শেষ পড়েনি। যাবে ফিরে?
চিন্তাটা মাথায় আসার প্রায় সাথে সাথেই হারিয়ে গেল অচেনা একটা গলার আওয়াজে। মুহূর্তের মধ্যে ভোজবাজির মত উপস্থিত হয় আওয়াজের মালিক। ভারিক্কি চালে এগিয়ে এসে হাসনার পাশ ঘেষে দাঁড়ায়। এই কী তাহলে সলিম মোল্লা? শ্যামনগরের চেয়ারম্যান? যমুনা কী তবে এই লোকের কথা বলেছিল? হাসনা সংশয়ে দেখতে থাকে তাকে।
মধ্যবয়স্ক এক লোক। চর্বিমণ্ডিত থলথলে শরীর। গোলগাল কামানো মুখ। স্থির চাহনীতে ধূর্ততার আভাস। পরনের মাড় দেওয়া কটমটে পাঞ্জাবীটার মতই খানদানী ছাপ লোকটার চোখেমুখে।
ঠোঁট উল্টে অবজ্ঞাভরে জিজ্ঞেস করে লোকটাÑ
‘নাম কিরে তোর? এহানে কী চাই?’
ভড়কে যাওয়া কণ্ঠে বলে ওঠে হাসনা, ‘জে... আমার নাম হাসনা। হাসনা বানু। ’
নামটা যেন বহু প্রতীক্ষিত। বহুশ্র“ত। নাম শুনেই হলদে দাঁত বের করে বিশ্রিভাবে হেসে ওঠে লোকটা।
খানিক আগের খানদানী চোখজোড়া জ্বলে উঠে কামনার উচ্ছ্বাসে।
‘আইছিস তাইলে! আয়। ভিত্রে আয়। ’ বলতে বলতে খপ করে লোকটা চেপে ধরে হাসনার বাহু। ঘৃণায় রি রি করে ওঠে ওর সমস্ত শরীর।
ঝটকা মেরে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চায়। লোকটার শক্ত আঙুল যেন গেঁথে বসেছে, নিজেকে ছাড়াতে পারেনা কোনমতে। সে অবস্থাতেই টানতে টানতে হাসনাকে ভেতরে নিয়ে চলে লোকটা। নিজের ঘরে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে মেঝেতে।
পড়ে যেতে যেতে নিজেকে কোনমতে সামলে নেয় হাসনা।
প্রাথমিক বিহ্বলতা কাটাতে সময় লাগে তার। সজ্জিত ঘরের চারপাশে তাকায়। দুচোখে অন্ধকার দেখতে থাকে। সেই অন্ধকারে মুহূর্তের জন্য ভেসে ওঠে খোকনের জ্বরে ভোগা পাণ্ডুর মুখটা, অর্ধনিমিলিত অসহায় চোখে চেয়ে থাকা সোয়ামীর পঙ্গু হাত-পা। খিদে অনুভুত না হওয়ার জন্য পেটে কষে বাঁধা লাল রঙের সেই গামছা ।
ভেসে ওঠে খোকনের খালি হয়ে আসার ওষুধের বোতল। ডুকরে কেঁদে ওঠে সে।
দরজার খিল এঁটে এগিয়ে এসে খিস্তি ছাড়ে লোকটা, ‘চোপ্, চোপ্ হারামজাদী? চিল্লাবি না। লোকে শুনবো না? আমার তো সমাজ বইলা একটা কথা আছে, নাকি? অই বজ্জাতী? নাচতে নেইমে ঘোমটা দিছস কেনে?’ বলেই খপ করে হাসনার ঘোমটা টেনে খুলে দেয়। আকুল করা কান্নায় ভেসে যেতে থাকে হাসনার দু চোখ।
চিবুক। গলা। অসহায়তার নোনা জোয়ার যেন ভাসিয়ে নিতে চায় তাকে। যেমন করে ভেসেছিল গত পরশু রাতে।
সেদিন প্রায় এক মাস পর এসেছিল যমুনা।
সঙ্গে করে চাল আর গোটা কয়েক আলু আনতে সেদিনও ভোলেনি। বেশ্যাপল্লীর সর্দারনী সে। এক সময় নিজেই দেহ বেঁচে খেত। সময় গড়িয়ে দেহের ভাঁজে বয়স বাসা বাঁধতেই টনক নড়ে তার। একসময় সব ছিল তার।
স্বামী, সংসার, সমাজ। হাসনাদের মত প্রতিবেশী।
কিন্তু বিধি বাম। যৌতুকের লোভে যমুনা স্বামী পরিত্যাক্তা, বাড়তি বোঝার ভয়ে পরিবার এবং এক সময় পেট চালাতে দেহ বেচার অপরাধে সমাজ পরিত্যাক্তা হয়ে সে নিজেই এখন আলাদা একটা সমাজ গড়ে নিয়েছে। দেহপসারীনির সমাজ সেটা।
সে সমাজে সামাজিকতা নেই; অথচ সমাজের লোকদেরই নিত্য যাওয়া আসা! রক্ত মাংসের খেলা চলে সেখানে রাতভর।
সমাজের লোকদের কাছে করুণা পায় নি যমুনা। এখন নিজের সমাজেরই সে একচ্ছত্র অধিপতি। অস্বীকার করবে না। এখানে সে ভালই আছে।
সমাজ থেকে সে পুরোপুরিই বিচ্ছিন্ন। দিনের বেলা পারত পক্ষে সে বের হয় না। পেট চালানোর মত সামাজিকতা রক্ষার জন্য অর্থাৎ কিনা বাজার-ঘাট করার জন্য বাইরে তাকে বেরুতেই হয়। এবং অবশ্যই বোরখা পরে। তাও করতে হয় অনেক দূরে গিয়ে যেখানে তাকে কেউ চেনে না।
সবচেয়ে বড় কথা বোনের মেয়ে হাসনাকে সে কোন ভাবেই ভুলতে পারে না। হাসনার ছেলে খোকনকেও একটু আদর করার লোভে রাতের আঁধারে লুকিয়ে চুরিয়ে ওদের দেখতে আসে যমুনা। সঙ্গে করে নিয়ে আসে চাল ডাল। হাসনার স্বামী মাস দুয়েক আগে স’মিলে কাজ করতে যেয়ে ডান হাত আর ডানপা হারানোর পর থেকে সে প্রায় এটা করা শুরু করেছে। এবং সেটা খোকনের বাপের অজান্তেই।
খোকনের বাপের এক কথাÑবেশ্যা বেশ্যাই। তার আলাদা কোন পরিচয় নেই। যমুনা খালাকে এ বাড়িতে কেউ দেখে ফেললে পুরো গ্রাম ছোঃ ছোঃ করবে। তখন কোন যমুনা এসে উদ্ধার করবে? শেষ-মেষ তার বউ এর পরিচয় হতো বেশ্যা বউ, আর সে নিজে... না না! যমুনা খালাকে এ বাড়িতে ঢুকতে দেয়া যাবে না। এ বাড়ির ত্রিসীমানায় প্রবেশ করতে দেখলে দা দিয়ে কোপাবে তাকেÑ এমনই ছিল খোকনের বাপের এক কথা।
এক যুক্তি। হাসনা ভেবে পায় না, পেটে যার ভাত নেই সে সমাজ বইতে যায় কী করে? সমাজ সমাজ করে খোকনের বাপ পাগল প্রায়। কই? সমাজ তো তাকে পিন্দনের কাপড় দিতে পারছে না। দুটো ভাত ফুটিয়ে তুলে দিতে পারছে না অসুস্থ্য সন্তানের মুখে। সে সমাজ তো এই বেশ্যার চালের চেয়েও নিকৃষ্ট।
যমুনারও জানা ছিল, খোকনের বাপের ধুয়া ধরা সমাজের প্রতি যতখানি ভক্তি, তার আনা চালে ততোধিক অভক্তি। । তাই তো সে আসত রাতের আঁধারে। চাল নিয়ে। হাসনা চাল যোগার করতে পারত না সে কথাও জানতো সে।
দুর্মূল্যের এই বাজারে চাল কিনে খাওয়ার সাধ্য কোথায় তার? অল্প দামে চিড়ে কিনে তাই পানিতে ভিজিয়ে লবণ ডলে খায়। পঙ্গু হওয়ার কারণে খোকনের বাপও কোন কাজ পায় না যে দুটো করে খাওয়াবে। অগত্যা হাসনাকেই এবাড়ি ও বাড়ি ছুটতে হয় কাজের ধান্ধায়; দুটো ভাতের জন্য। দু-তিন দিনের আধখাওয়া পেটটাকে এক বেলা ভাত খাইয়ে সান্তনা দেয়ার জন্য সকাল সন্ধ্যা খাটে সে। তবু চাল জোটে না।
চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় সে মজুরির বদলে চাল চায়। কিন্তু কেউই দিতে চায় না। ধনী গরিব সবার মাঝেই চালের হাহাকার। হাহাকার তোলে ঘরের অসুস্থ্য খোকন। জ্বরের মুখে পানিতে ভেজানো চিড়ে তার রোচে না।
ভাত খেতে চায়। গরম ভাত। এক সময় যমুনার আনা দুটো চাল চড়িয়ে চুপি চুপি ছেলেটাকে খাওয়াত। কিন্তু খোকনের বাপের হাতে ধরা পড়ে যাওয়ায় সেটাও বন্ধ হয়। চুলের মুঠি ধরে হেচকাতে হেচকাতে সেদিন হাসনার মুখ থেকে বের করেছিল আসল কথা।
সেদিনই রাত জেগে দাওয়ায় বসে ছিল যমুনা খালার আসার অপেক্ষায়। হাতে ছিল দা। কতবার পায়ে পড়ে মিনতি করেছিল সে, কতবার! শোনে নি।
রাত বাড়তেই যমুনা খালা আসে। আসার সাথে সাথে দা হাতে লাফিয়ে পড়ে খোকনের বাপ।
পঙ্গু দেহ নিয়ে মাটিতে গড়িয়ে গড়িয়ে যমুনাকে তাড়া করে। তার সদ্য শুকানো কাটার ক্ষত ফেটে তাজা রক্ত ঝরে, জল ঝরে হাসনার চোখে। অঝোর ধারার জল। ঠিক আজকের মত।
মেঝেতে হাটু মুড়ে জুবুথুবু হয়ে বসে আছে হাসনা।
ভীত চোখে তাকায় চেয়ারম্যানের দিকে। স্বেচ্ছায় ডেকে আনা আসন্ন বিপদের আশঙ্কায় চোখের পাতা পর্যন্ত কাঁপে না। শীতল চোখ দুটো শুধু চেয়ে থাকে, চেয়ে চেয়ে বিপদ আর তার নিজের দূরত্বের মাপ নেয়। মাত্র পাঁচ ছয় হাত দূরে খাটের ওপর বসে আছে লোকটা। খাটের নিচ থেকে বাংলা মদের বোতল বের করেছে।
গেলাসের পর গেলাস গিলছে। আর গা শিউরানো ভঙ্গিতে বার বার তাকাচ্ছে তার দিকে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।