ঐক্যের উৎস ও চেতনায় গাজীউল হক
ফকির ইলিয়াস
======================================
বাংলাদেশের রাজনীতিতে সমমনাদের ঐক্য প্রয়োজন-এমন একটা আহ্বান আমরা দীর্ঘদিন থেকে শুনে আসছি। এই ঐক্য যে প্রতিষ্ঠিত হয়নি, তা নয়, হয়েছে। তবে তা হয়েছে বিভিন্ন ইস্যুতে। এই ইস্যুগুলো ক্ষণস্থায়ী হওয়ায় পরে তা আর টিকে থাকেনি। স্বৈরশাসক এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে বিএনপি-জামায়াত এবং আওয়ামী লীগ ছিল একই সমান্তরালে।
'স্বৈরাচার হটাও' এই স্লোগান দিয়ে আলবদর, রাজাকারদের প্রেতাত্মা সওয়ার হয়েছিল বিএনপি-আওয়ামী লীগের ঘাড়ে। তিনদলীয় জোটের রূপ রেখা প্রণয়ন করেছিল এই আট, সাত ও পাঁচ দলের মোর্চা। এরপর স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর নির্বাচনে বিজয়ী হয় বিএনপি।
এরপর বিএনপিকে ক্ষমতা থেকে সরাতে প্রায় একই সমান্তরালে নামল আওয়ামী লীগ ও জামায়াত। 'তত্ত্বাবধায়ক সরকার', 'কেয়ারটেকার সরকার' প্রভৃতি অভিধায় অগ্রসর হলো সেই আন্দোলন।
সঙ্গত কারণে যে প্রশ্নটি আসে তা হচ্ছে বিএনপির বিরুদ্ধে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায়ের আন্দোলনে যে আওয়ামী লীগ ও জামায়াত প্যারালাল আন্দোলন করেছিল- তারা কি সমমনা ছিল? না, ছিল না। জামায়াত এভাবেই রাজনীতির মাঠে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছে কৌশলে, সূক্ষ্মভাবে।
২০০১-এর নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত কর্তৃক চারদলীয় জোট গঠনই হলো তাদের চেতনার প্রকৃত রূপ। সমমনা, ডানপন্থীদের এই ঐক্যের মাধ্যমে বাংলাদেশে রাজাকার আলবদররা রাষ্ট্রক্ষমতার ভাগ পায়। এ সুযোগটি তৈরি করে দেয়ার জন্যও আওয়ামী লীগও কম দায়ী নয়।
কারণ '৯৬-এর নির্বাচনে জিতে শেখ হাসিনা, জাতীয় পার্টির একাংশের আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এবং জাসদের একাংশের আ স ম আবদুর রবকে মন্ত্রী বানানোর মাধ্যমে যে 'সর্বদলীয় শাসন' কায়েম করার চেষ্টা করেছিলেন তা গ্রহণ করেনি বাংলাদেশের মানুষ। তার ওপর সেই কেবিনেটের মন্ত্রীদের স্বেচ্ছাচারিতাও অতিষ্ঠ করে তোলে দেশের মানুষকে। চরম বেদনাদায়ক হলেও নিজামী-সাঈদীর মতো চিহ্নিত রাজাকাররা সাংসদ হওয়ার সুযোগ পায় ২০০১-এর নির্বাচনে।
ঐক্যের রাজনীতির আরেকটি উদাহরণ ২০০৯-এর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ১৯৯০ সালে যে স্বৈরশাসক এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে আওয়ামী লীগ অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিল, সেই এরশাদের জাতীয় পার্টির সঙ্গেই মহাজোট গঠন করে আওয়ামী লীগ।
বাংলাদেশে এভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয় স্বৈরাচারী রাজাকার, ডানপন্থী এবং সামপ্রদায়িক শক্তির পুনর্বাসন। ভোটের মেরুকরণের জন্যই যদি জাতীয় পার্টি-আওয়ামী লীগ ঐক্য হয়ে থাকে তা হলে সেই ঐক্য কি আদর্শগত ঐক্য? না, এখানে আদর্শের কোন ঐক্য চর্চা নেই। যা আছে, তা হলো জাপা, মন্ত্রিপরিষদের ভাগ পেয়েছে। সরকারি বেঞ্চে বসার সুযোগ পাচ্ছে। জাপা ছাড়াই আসন এবং ভোটের অঙ্কে আওয়ামী লীগ এগিয়ে থাকার কারণে জাপার কদর অনেকটা কমেই গেছে আওয়ামী লীগের কাছে।
ফলে, এরশাদ বিভিন্ন দেনদরবার করার পর'' শেখ হাসিনা আমার ছোট বোন''- জিকির তোলার পরও খুব একটা রাষ্ট্রতন্ত্রের কাছে ভিড়তে পারেননি কিংবা পারছেন না। এদিকে সেই সুযোগ নিয়েই বিএনপি-জামায়াতের জোট প্রতীক্ষার প্রহর গুনছে, যদি এরশাদের দলটি কখনও তাদের ঘাটে ভেড়ে!
দুই.
বাংলাদেশে এই যে ক্ষমতাভোগের রাজনীতি, তা জনগণের আশু কল্যাণে কতটুকু কাজে আসতে পারে এই প্রশ্নটি আমি একদিন করেছিলাম ভাষাসৈনিক গাজীউল হককে। ১৯৯২ সালের শেষ মাস। দেশে যুদ্ধাপরাধী-রাজাকার বিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম।
গাজীউল হক তখন এই আন্দোলনের অন্যতম প্রাণদাতা।
ঢাকায় এক ঘরোয়া আড্ডায় এসব বিষয়ে আমাদের আলাপ হচ্ছিল। গাজীউল হক খুব সুদৃঢ় কণ্ঠেই সেদিন বলেছিলেন, বিষয়টি রাজনৈতিকভাবেই মোকাবেলা করতে হবে এবং এই সংগ্রামে আমাদের জয়ী হতেই হবে।
তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, এই জয়ের সংগ্রামে আমরা আওয়ামী লীগের ওপর কতটা নির্ভর করতে পারি? তিনি খুব গম্ভীরভাবে বলেছিলেন, একটা রাজনৈতিক দলের সমর্থন তো লাগবেই। আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কোন বিকল্প দল আছে কি? তার এই পাল্টা প্রশ্নের জবাবে আমি বলেছিলাম, রাষ্ট্রের জনগণ চাইলে তো আরেকটি দল তৈরি করতেও পারে।
তিনি হেসেছিলেন। বলেছিলেন, জাতীয়তাবাদী চেতনার দোহাই দিয়ে, 'বাংলাদেশী' তকমা ব্যবহার করে জে. এরশাদও তো জাতীয় পার্টি করেছেন। তিনি কি সার্থক হতে পেরেছেন- নাকি পারবেন? তেমনিভাবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা যারা বলেন, তাদের বায়ান্ন, ঊনসত্তর, সত্তর-একাত্তরের চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এছাড়া এই দেশে দানবশক্তিকে মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। আমি সেদিনই বুঝেছি, গাজীউল হক গণমুক্তির যে স্বপ্ন দেখেন তার পক্ষে একটি রাজনৈতিক দল ও চেতনার জোর সমর্থন একান্তভাবেই প্রয়োজন।
গাজীউল হক বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। কিন্তু তার মাঝে ছিল বুদ্ধিদীপ্ত একটি স্বকীয় চেতনা। দলের হাইকমান্ডের অন্ধ অনুসারী না হয়ে ক্রিয়েটিভ আউটলুক দিয়ে তিনি দলে ছিলেন অভিভাবকের মতো। তার বিশেষ কিছু চাওয়া-পাওয়ার ছিল না। তিনি খুব সহাস্যে বলতেন, আমি তো আইনজীবী।
তাই নিয়মতান্ত্রিকতা মেনেই আমাকে রাষ্ট্র ও জাতির কথা ভাবতে হয়।
গাজীউল হক ছিলেন মহান ভাষা আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব। মহান মুক্তিযুদ্ধেও ছিল তার অবিস্মরণীয় অবদান। কিন্তু ভাবতে অবাক লাগে এই মহান মানুষটি রাষ্ট্রের অন্যতম রাষ্ট্রীয় পদক'-'স্বাধীনতা পদক' তার জীবদ্দশায় পাননি। তিনি আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য হওয়ার পরও, আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র ক্ষমতা পাওয়ার পরও তাকে এই পদকটি দেয়ার উদ্যোগ নেয়নি।
এর চেয়ে লজ্জা ও দুঃখজনক আর কি হতে পারে? এই দেশে অনেক স্বাধীনতাবিরোধী দুষ্টুদানবরাও অনেক উচ্চ মার্গীয় রাষ্ট্রীয় পদক পেয়েছে। অথচ গাজীউল হক তার জীবদ্দশায় তা দেখে যেতে পারলেন না।
প্রশ্নটি আমারও, গাজীউল হককে কেন ঢাকায় রাষ্ট্রীয় মর্যাদা সমাহিত করা হলো না? হয়তো বলা হবে তার পারিবারিক ইচ্ছায় বগুড়ায় তাকে সমাহিত করা হয়েছে। কিন্তু পরিবারের সদস্যরা তো এ বিষয়টিও ভাবতে পারবেন, পনেরো কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশের নবীন প্রজন্ম যখন মহান ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস পড়বে, তখন তাদের গাজীউল হকের সমাধি দেখার ইচ্ছার উদ্রেক হতেও পারে। ঢাকায় তার সমাধিটি থাকলে অনেকেই এর পাশে গিয়ে দাঁড়ানোর সুযোগটি পেতেন শ্রদ্ধার সঙ্গে।
গাজীউল হক আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তার চেতনা আছে। চেতনা থাকবে। আর সে চেতনাটা হচ্ছে জয়ী হতে হবে। কিছুদিন আগে একটি টিভি চ্যানেলে তার সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকার দেখি।
সে সাক্ষাৎকারেও তিনি খুব আড়ষ্ট কণ্ঠে বলেছিলেন, আমাদের বিজয়ী হতেই হবে। যুদ্ধ জয় করতে হবে। কি সেই যুদ্ধ? সেই যুদ্ধটি হচ্ছে অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে মানবের সংগ্রাম। এই তো সেই দেশ যেখানে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে জাতির জনক শেখ মুজিবের স্বীকৃতির জন্য মামলা করতে হয় আদালতে। শ্রদ্ধের গাজীউল হক, আপনি চিরশান্তিতে থাকুন।
---------------------------------------------------------------------
দৈনিক সংবাদ । ঢাকা। ২৬ জুন২০০৯ শুক্রবার প্রকাশিত
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।