বসে আছি পথ চেয়ে.... আমাদের দেশ স্বাধীন হয়েছিল কতগুলো স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষার ভিত্তিতে। যাকে আমরা বলি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনা বলতে অন্য কিছু নয়- স্বাধীনতা সংগ্রামের পেছনে সক্রিয় মানুষের স্বপ্ন, আকাক্সক্ষা ও আদর্শকেই বোঝায়।
পৃথিবীর সব স্বাধীনতাকামী জনগোষ্ঠীই কতগুলো স্বপ্ন, আকাক্সক্ষা ও আদর্শকে সামনে রেখেই জাতীয় স্বাধীনতার জন্যে লড়াই-সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। আমাদের সেই আদর্শ ছিলÑস্বশাসন, ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে দেশের সকল মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক- তথা সার্বিক মুক্তি।
বাংলাদেশের সংগ্রামকে আমরা শুধু স্বাধীনতা সংগ্রাম বলি না, মুক্তিযুদ্ধও বলি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবও '৭১-এর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বলেছিলেন, 'এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। ' স্বাধীন বাংলাদেশ, স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান নয়। শুধু একটি পতাকা বা নিজস্ব জাতীয় সংগীতের জন্য আমরা দেশ স্বাধীন করিনি। পাকিস্তান যে মতাদর্শ নিয়ে সাম্প্র্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদ, সামন্তবাদ এবং সামরিক স্বৈরশাসনের ধারায় চলেছিল, তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষের সুদীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে।
শত বছরের ধারাবাহিকতায় ও বহু গণসংগ্রামে অসংখ্য মানুষের আত্মবলিদানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্ন, আদর্শ এবং লক্ষ্যগুলো ধীরে ধীরে দানা বেঁধে ওঠে।
আমরা স্বাধীনতার চার দশক অতিক্রম করছি। কিন্তু সেই চেতনা, স্বপ্ন বা আদর্শ কোনোটাই আজ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি। এখনও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী পাকিস্তানপন্থী একটি মৌলবাদী কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রের রাজনীতির কাছে আমাদের মূলধারার রাজনীতি বার বার মার খাচ্ছে। বলা চলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের শক্তি মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছে না।
আমাদের জাতীয় জীবনে নিঃসন্দেহে এটা একটা বড় ট্রাজেডি এবং ক্ষত। স্বাধীনতার এই চারদশক পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক দলগুলোর আত্মজিজ্ঞাসার সময় এসেছে। কেন তারা সকল ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছে না? কেন তারা সাধারণ মানুষের স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা বা স্বপ্ন-সাধ পূরণ করতে পারছে না? কেন অশুভ রাজনীতির ঘাড় ভেঙ্গে দেওয়া যাচ্ছে না? এর জন্য এদেশের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মুক্তিকামী মানুষকে আর কতকাল অপেক্ষা করতে হবে?
ধর্মাশ্রয়ী বৈষমম্যমূলক সংকীর্ণ পাকিস্তানি ভাবধারাপুষ্ট রাজনীতির উন্মেষ
আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িক ভাবধারাপুষ্ট রাজনীতির শিকড় প্রোথিত আছে অতীতের গভীরে, ভারত-বিভাগকালে। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর থেকেই পাকিস্তানি শাসকশ্রেণী বাঙালি জনগোষ্ঠীর ওপর একটি বৈষম্যমূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা জারি রেখেছিল। নানান রাষ্ট্রীয় উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড অর্থনৈতিক বরাদ্দের প্রশ্নে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী বাঙালিকে সমানুপাতিক ন্যায্য পাওনা থেকে বরাবর বঞ্চিত করেছে পাকিস্তানি সামরিক-বেসামরিক সরকারগুলো।
বাঙালি অতএব বৈষম্যমূলক রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বারবার প্রতিবাদ করেছে, সংগ্রাম করেছে, একটি বৈষম্যহীন সমতাভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে।
সংস্কৃতির প্রশ্নেও বাঙালি জনগোষ্ঠীর নিজস্ব বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত আত্মপরিচয় বিকাশের অন্তরায় হিসেবে সক্রিয় থেকেছে পাকিস্তানি শাসকশ্রেণী। পাকিস্তানি মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫৬ শতাংশ হিসেবে, বাঙালি জনগোষ্ঠীর ন্যায্য আকাক্সক্ষা ও দাবি ছিল বাংলাভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হোক। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকশ্রেণী বাঙালির এই ন্যায্য দাবিকে কখনো বলপ্রয়োগের মাধ্যমে, কখনো রাজনৈতিক ছলচাতুরির আশ্রয় নিয়ে, অবজ্ঞা করেছে। বাঙালির এই জাতীয়তাবাদী আকাক্সক্ষাকে পাকিস্তানের ‘ইসলামি চেতনা’ বিরোধী ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করে দাবিয়ে রাখার জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকশ্রেণী।
শুধু তাই নয়, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত পাঞ্জাবি শাসকশ্রেণীর বিরুদ্ধে যে কোনো ন্যায্য গণতান্ত্রিক দাবিকেই ওরা ‘ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র’ হিসেবে আখ্যায়িত করে তা নামঞ্জুর করার অগণতান্ত্রিক পন্থা অবলম্বন করেছে। স্বভাবতই, বাঙালি তার নিজের অভিজ্ঞতালব্ধ ইতিহাসবোধ থেকেই ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির বিপরীতে সেক্যুলার গণতান্ত্রিক রাজনীতির পক্ষাবলম্বন করেছে। ধর্মকে রাষ্ট্র ও রাজনীতির ইহজাগতিক পরিম-লের বাইরে ব্যক্তিজীবনের একান্ত অঙ্গনে নিরাপদ রাখাই উত্তম মনে করেছে। ধর্ম ও রাজনীতিÑ উভয়ের জন্যই তা মঙ্গলজনক মনে করেছে বাঙালি।
কিন্তু পাকিস্তানি শাসকশ্রেণী বাঙালির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কিংবা সাংস্কৃতিক কোনো আকাঙ্ক্ষষার প্রতিই যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করেনি।
ফলে পাকিস্তানি জমানার প্রায় পুরো সময়টাই বাঙালি তার ন্যায্য আকাক্সক্ষা ও দাবি বাস্তবায়নের সংগ্রামে নিয়োজিত ছিল। আপন জনগোষ্ঠীর তিক্ত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়েই বাঙালির ভেতর জাতিগত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চেতনার উন্মেষ ও বিকাশ ঘটেছে। এটা কোনো ইতিহাসবিচ্ছিন্ন বিমূর্ত ধারণার বিষয় নয়। এইসব বিকশিত মূর্ত চেতনার পরিপ্রেক্ষিতেই ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বাঙালি। ছিনিয়ে আনে নির্বাচনী বিজয়।
অধিকাংশ বাঙালির তৎকালীন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান আওয়ামী লীগ সমগ্র পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এই প্রথম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক বাঙালির হাতে পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা ন্যস্ত হওয়ার নিয়মতান্ত্রিক পথ প্রশস্ত হয়। কিন্তু সেই প্রশস্ত পথে, ফের কাঁটা বিছিয়ে দেয় পাকিস্তানি শাসকশ্রেণী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর চাপিয়ে দেয় এক অতর্কিত অন্যায় যুদ্ধ। বাঙালি জাতি দীর্ঘ নয়মাস মরণপণ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাস্ত করে ছিনিয়ে আনে স্বাধীনতার লাল সূর্য। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ন্যাপ-কমিউিনিস্ট পার্টিসহ অপরাপর রাজনৈতিক দলের অগণিত মুক্তিযোদ্ধার অংশগ্রহণে পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়।
পাকিস্তানপ্রেমী ধর্মবাদী কুচক্রীরা তা সহজে গ্রহণ করতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি তাই বার বার আক্রমণের শিকার হয়েছে। ষড়যন্ত্র-খুন-হত্যা ও অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে মুক্তিযুদ্ধের সব উপাত্ত-উপাদান ও অঙ্গীকার ধ্বংস করার অভিযান অব্যাহত রাখা হয়েছে। দেশি-বিদেশি সেই পরাজিত অপশক্তির ষড়যন্ত্রের নাগপাশ থেকে আমরা আজো মুক্ত হতে পারিনি।
পঁচাত্তরের পট পরিবর্তন:মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী পাকিস্তানপন্থী রাজনীতির পুনঃপ্রবেশ
স্বাধীনতার পর দেশি-বিদেশি চক্র বাংলাদেশকে পাকিস্তান বাসানোর ষড়যন্ত্র আবার নতুন করে শুরু করে।
পরাজিত পাকিস্তানি ও তাদের মিত্রদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে প্রায় আত্মগোপনে থাকা জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতিকরা যুদ্ধাপরাধীর লেবাস নিয়েই নিজেদের সংগঠিত করতে থাকে। সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে শক্তিশালী করার জন্য তৎপরতা চালায়। সেনাবাহিনীর ভেতরেও প্রগতিবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল মনোভাবাপন্নদের দ্বন্দ্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে। রাজনৈতিক সুবিধাবাদের অনুকূলে মুক্তিযোদ্ধা সামরিক অফিসারদের কেউ কেউ পাকিস্তানপন্থীদের সঙ্গে হাত মেলায়। এ পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হয় ষড়যন্ত্রকারীদের কোনো কোনো গোষ্ঠী।
সময় ও পরিবেশ তৈরি না হতেই সমাজতান্ত্রিক চিন্তা থেকে ‘বাকশাল’ গঠন করে ফেলেন ১৯৭৫ সালে। এরই আনুকূল্যে নানা ধরনের কালাকানুন আরোপিত হতে থাকে। আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু সরকারকে সাধারণ মানুষের কাছে অজনপ্রিয় করার জন্য ‘বাকশাল’ গঠন ঘৃতাহুতির কাজ করেছিল। এর আগেই কিছুটা প্রশাসনিক অদক্ষতা ও কিছুটা ষড়যন্ত্রের নীলনকশা দুর্ভিক্ষাবস্থায় ফেলেছিল দেশকে। এ সবকিছুর যোগফলে ষড়যন্ত্রকারীরা যখন অনুভব করে ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছে তখনই ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়।
বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হন বিপথগামী সেনাসদস্যদের হাতে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণকারী দেশপ্রেমিক বিদগ্ধ নেতাদের বাঁচিয়ে রেখে ষড়যন্ত্রকারীদের উদ্দেশ্য সিদ্ধি হবে না, এই অনুভব থেকে জেলখানায় হত্যা করা হয় চার জাতীয় নেতাকে।
হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে, বন্দুকের জোরে, বেআইনি সরকার প্রতিষ্ঠা করে, দেশকে সামরিক আইনের আওতায় নিয়ে এসে, সামরিক ফরমান দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-ধারাসম্পন্ন পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য বদল করে পাকিস্তানি ধারা প্রবর্তন করা হয়। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে লাখো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশকে আবার মিনি পাকিস্তান বানানোর পরিকল্পনায় নেতৃত্ব দেন একজন মুক্তিযোদ্ধা জেনারেল জিয়া। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর জিয়া প্রথমে যে কাজটি করলেন তা হচ্ছে দালাল আইনে যারা গ্রেফতার হয়েছিল, যে সাড়ে সাত শ'র মতো অপরাধীর সাজা হয়েছিল তাদের মুক্ত করে দেওয়া।
একই সঙ্গে তিনি দালাল আইনটিও বাতিল করে দেন। ১৯৭২-এর সংবিধানে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। জিয়া সংবিধান থেকে তা তুলে দিয়ে জামায়াত মুসলিম লীগের মতো স্বাধীনতা বিরোধী দলগুলোকে রাজনীতি করার লাইসেন্স দিলেন। সংবিধানের মূল চালিকাশক্তি এবং বাংলাদেশ সৃষ্টির অন্যতম চেতনা ধর্মনিরপেক্ষতাকে বাতিল করে দিলেন।
জিয়া একাত্তরের স্বীকৃত রাজাকার শাহ আজিজ, আবদুল আলীম, মাওলানা মান্নানকে বানালেন মন্ত্রী।
ঘাতক শিরোমণি গোলাম আযমকে পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশে এসে রাজনীতি করার সুযোগ করে দিলেন। একাত্তরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে বেশ কিছু বাঙালি সেনা অফিসার ছিল, যারা পাকিস্তানের হয়ে বাঙালি নিধনে শামিল হয়েছিল। এদের কেউ কেউ পরবর্তীকালে বদলি হয়ে পশ্চিম পাকিস্তান চলে যায় এবং পরে প্রত্যার্পিত হয়ে বাংলাদেশে ফেরত আসে। বেশ কয়েকজন ১৬ ডিসেম্বরের পর এদেশে যুদ্ধবন্দী হয়ে পড়ে। এদের কাউকেই বঙ্গবন্ধু সরকার বাংলাদেশে সেনাবাহিনীতে আর ফেরত নেয়নি।
বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর এ রকম চৌদ্দজন পাকিস্তানি সেনা অফিসারকে জিয়া পুলিশ বাহিনীতে আত্মীকরণ করেন। আর যেই বাঙালি অফিসারটি ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জহুরুল আলম খানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে ধানম-ি- ৩২ নম্বর বাড়িতে গ্রেফতার করতে যায়, তাকে জিয়া বিএনপির মন্ত্রিসভায় সদস্য করে নেন।
পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনের পর ধারাবাহিকভাবে ক্ষমতাসীন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নিজেদের রাজনৈতিক বৈধতা আদায় ও সাধারণ মানুষের কাছে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াবার জন্য ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার করা শুরু করল পূর্ণোদ্যমে। মেজর জিয়া তার সকল বক্তব্য শুরু করার আগে প্রকাশ্যে “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম” বলা শুরু করলেন। জিয়াউর রহমানের নিহত হওয়ার পর আরেক সামরিক শাসক হোসেইন মুহাম্মদ এরশাদ রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারের মাত্রাটা আরো বাড়িয়ে দিলেন একই লক্ষ্যেÑ তার সব অপকর্মকে বৈধতা দেওয়া।
তিনি সংবিধান সংশোধন করে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীতে দেশটাকে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রে রূপান্তরের দিকে এক ধাপ এগিয়ে দিলেন । ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহারের সাথে এরশাদ রাজনীতিতে পীরতন্ত্রের প্রবর্তন করে নতুন মাত্রা যোগ করলেন । তিনি প্রকাশ্যে রাষ্ট্রীয় হেলিকপ্টার ব্যবহার করে বিভিন্ন পীরের কাছে যেতে শুরু করলেন এবং এসব গ-মুর্খ ও ভ- পীরের উপদেশ প্রকাশ্যে সাংবাদিক সম্মেলন করে প্রচার করতেন। এরশাদের পতনের পর প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী দল নির্বাচনী কৌশল হিসাবে নগ্নভাবে ধর্ম ও ভারত বিরোধীতাকে কাজে লাগাল। ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার এমনই নোংরা পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হলো যে, আওয়ামী লীগকে ভোট দিলে ধর্ম চলে যাবে, মসজিদে মসজিদে আজানের পরিবর্তে উলু ধ্বনি হবে, দেশ ভারতের অঙ্গ রাজ্যে পরিণত হবেÑ ইত্যাদি অপপ্রচার জোরেশোরে চারানো হলো।
বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, তারা এ অপকৌশলে সফল হয়ে নির্বাচনে জিতেছিল এবং ক্ষমতাসীন হয়ে তারাও রাজনীতিতে-রাষ্ট্রীয় আচারানুষ্ঠানে- ধর্মের ব্যবহার বাড়িয়ে দিয়েছিল। সামাজিক পরিম-লে ধর্মের ব্যবহার এতটাই তীব্র হয়ে উঠলো যে ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার অধিকারী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বৃহত্তর রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগও ধর্মের ব্যাপারে খুবই স্পর্শকাতর নীতি অবলম্বন করলো। ভোটের রাজনীতির বিবেচনায় এবং বিরোধী প্রচারণার জবাবে- তাদের রাজনৈতিক আচার আচরণেও ধমীর্য় রীতিনীতি প্রদর্শনের প্রতিযোগিতা ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করা গেল। অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল ধারার রাজনীতি ধর্মভিত্তিক ষড়যন্ত্রের রাজনীতির কাছে এভাবেই আত্মসমর্পন করল।
জিয়ার আনুকূল্য ধন্য স্বাধীনতা বিরোধী চক্র
বাংলাদেশে পাকিস্তানপন্থী ধর্মীয় রাজনীতিকে সামাজিক ভিত্তি দিয়েছেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান।
তার হাত ধরেই জামায়াতে ইসলামীসহ ধর্মাশ্রয়ী দলগুলো রাজনীতিতে ফ্যাক্টর হয়ে উঠে। জামায়াতে ইসলামী ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের ঘোর বিরোধী ছিল। মুক্তিযুদ্ধকে প্রতিহত করার জন্য রাজাকার-আলবদর-আলসামশ বাহিনী ও শান্তি কমিটি গঠন করেছিল। বাংলাদেশের পথঘাট ও মুক্তিকামী জনতার বাড়িঘর চেনাতে পাক-হানাদার বাহিনীর গাইড হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে। ৩০ লাখ বাঙালি নিধনে, এক কোটির ওপর দেশছাড়া আরও কয়েক কোটিকে ঘরবাড়িছাড়া, তিন লাখ নারীকে ধর্ষণ ও শারীরিক নির্যাতন, কোটি কোটি টাকার সম্পদ লুন্ঠন ও হাজার হাজার বাড়িঘর জ্বালানো-পোড়ানোতে যারা পাকবাহিনীর চেয়েও বেশি ভয়ঙ্কর ছিল।
গত ৫ অক্টোবর ২০১১ পাকিস্তানের ইংরেজি জাতীয় দৈনিক 'ডেইলি টাইমস'-এর সম্পাদকীয় মন্তব্যে উল্লিখিত বিষয়গুলোকে কবুল করে নিয়ে বলা হয়েছে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী যতটা না হিং¯্র ছিল, ওই উগ্র গোষ্ঠীটি গণহত্যায় তাদের চেয়েও বেশি ভয়ঙ্কর ছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যে দলের নেতারা পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি করে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেওয়ার জন্য মুসলিম দেশগুলোর দ্বারে দ্বারে ঘুরে। খুন, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগকারী যুদ্ধাপরাধীরা সাধারণ ক্ষমার আওতাবহির্ভূত ছিল। প্রায় ১১ হাজার পাপিষ্ঠ নরাধম এসব অপরাধের দায়ে কারাগারে আটক ছিল। সপরিবারে বঙ্গবন্ধু এবং জেলখানায় জাতীয় চার নেতা হত্যা ও ক্ষমতার পালাবদলের পর ১৯৭৫-এর ৩১ ডিসেম্বর বিচারপতি সায়েম এবং জেনারেল জিয়ার সামরিক সরকার দালাল আইন বাতিল করে।
ফলে অভিযুক্ত ও দ-িত ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধী জেল থেকে বেরিয়ে যায়। ১৯৭৬ সালের ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ইসলামী জলসায় স্লোগান ওঠে, 'তাওয়াব ভাই-তাওয়াব ভাই, চাঁদ তারা পতাকা চাই' (ইত্তেফাক, ৮ মার্চ ১৯৭৬)। সে দিনের উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এমজি তাওয়াবের বদান্যতায় ওই জলসায় জামায়াত-আলবদর-রাজাকারদের ছিল স্বাধীনতার পর প্রথম আত্মপ্রকাশ। ওই মজলিসে জামায়াতে ইসলামী ৬ দফা দাবি উত্থাপন করে। দাবিগুলো হলোÑ দেশের পতাকা বদলাতে হবে, নতুন জাতীয় সংগীত চাই, দেশকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করতে হবে, '৫২-এর ভাষা আন্দোলনের শহীদ মিনার ভেঙে দিতে হবে, মুক্তিযুদ্ধের সময় নিহত রাজাকারদের স্মরণে মিনার নির্মাণ করতে হবে।
এরই ধারাবাহিকতায় জেনারেল জিয়া ১৯৭৮ সালে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে ধর্ম নিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ ছাঁটাই করেন। ধর্মের নামে দল গঠনের ওপর জারি করা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন। জামায়াতে ইসলামীর মতো স্বাধীনতাবিরোধী ধর্ম ব্যবসায়ীদের রাজনীতি করার সুযোগ সৃৃষ্টি করে দেন।
তিনি সেনা ছাউনিতে জন্ম দেন বিএনপি নামক রাজনৈতিক দলটির। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী সুবিধাবাদী লোকরা ওই দলে যোগ দিতে থাকে।
যে দলটির মোকাবিলায় বিএনপির আত্মপ্রকাশ, সেই নেতৃত্বশূন্য মাথাকাটা আওয়ামী লীগের তখন ঘোর অমানিশা। সে দলেরও সুযোগসন্ধানী ও কেউ কেউ আদর্শ বিসর্জন দিয়ে নগদনারায়ণের লোভে বিএনপিতে ঢুকে পড়ে। সুচিন্তিতভাবে বিএনপি আওয়ামী আদর্শবিরোধী অবস্থানে চলে যায়। আওয়ামী আদর্শ মানে যে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনানির্ভর আদর্শ, বিএনপি তা আমলে নেয় না। এভাবেই বিএনপি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা শুরু করে।
মোশতাকের করা 'ইনডেমেনিটি অ্যাক্টকে' আইনে পরিণত করেন জিয়াউর রহমান। ওই আইনে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার বন্ধ করা হয়। পঞ্চম সংশোধনীতে পাকিস্তানি ভূতেরা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়, যা বাংলাদেশের আদর্শিক ভিত্তিকে ধ্বংস করে জঙ্গিবাদের উত্থানের পথ পরিস্কার করে। গোলাম আযমের মতো কুখ্যাত মুক্তিযুদ্ধবিরোধী গণশত্রু ১৯৭৫-এর পর বাংলাদেশে আনা হয়। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত অবৈধ নির্বাচনকে এক ব্যক্তি কমিশনের প্রধান হিসেবে বৈধ বলে রায় দেন যে বিচারক, সেই বিচারপতি ছাত্তারকে পাকিস্তান থেকে ফিরিয়ে আনা হয়।
বসানো হয় ভাইস প্রেসিডেন্টের আসনে। কুখ্যাত রাজাকার ও ঘোর বাংলাদেশবিরোধী শাহ আজিজকে করা হয় প্রধানমন্ত্রী। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী খাঁটি মুসলিম লীগাররা বিএনপির বড় বড় নেতা হয়ে যান। শুধু তাই নয়, বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে রোখার জন্য ‘বাংলাদেশি’ নামক একটি নতুন জাতির জন্ম দেয়। যার কোনো ইতিহাস নেই, ঐতিহ্য নেই, নেই কোনো যৌক্তিক ভিত্তি।
আছে শুধু বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে পরিচিতি। বিএনপি নাগরিকত্ব ও জাতীয়তাকে এক মনে করে তালগোল পাকিয়ে ফেলে। তারা বঙ্গবন্ধুকে মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক, জাতির পিতা ও স্বাধীনতার ঘোষক মানতে রাজি নয়। তারা বরং বঙ্গবন্ধুর পরিবর্তে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানকে মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বানানোর অপচেষ্টা করে।
বিএনপি সব সময়ই মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির বিরুদ্ধে সর্বাত্মক ভূমিকা পালন করেছে।
শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ঘাতক-দালালবিরোধী আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন খালেদা জিয়ার সরকার দেশের বরেণ্য ২৪ বুদ্ধিজীবীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করে। পরবর্তীসময়ে মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত নিজামী, মুজাহিদ ও আবদুল আলীমকে মন্ত্রী করা হয়। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে উপদেষ্টা করা হয়।
ষড়যন্ত্রের রাজনীতি ও বিএনপির
বিএনপি সব সময়ই ষড়যন্ত্রের রাজনীতির প্রাণ-ভোমরার ভূমিকা পালন করেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী পাকিস্তানঘেঁসা সাম্প্রদায়িক সুবাধাবাদী রাজনীতির প্রধান ছাতা হিসেবে বিএনপি সব সময়ই অন্যদের ছায়া যুগিয়েছে।
এমনকি বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মেজর জিয়ার হাত দিয়ে এদেশে সৎ ত্যাগী মানুষদের রাজনীতি করার, রাজনীতির মঞ্চ থেকে শাসন ক্ষমতায় আসার যে সংস্কৃতি-তারও মূলোচ্ছেদ করা হয়েছে। ‘মানি ইজ নো প্রবলেম’ ধুয়া তুলে দেশের রাজনীতিকে সন্ত্রাস ও কালো টাকার ওপর নির্ভরশীল করে তোলা হয়েছে। এভাবে জিয়াউর রহমানের নীলনকশা অনুযায়ী প্রকৃত ও সৎ রাজনীতিকদের জন্য রাজনীতি করা ডিফিকাল্ট (তার উক্তি- ও রিষষ সধশব ঢ়ড়ষরঃরপং ফরভভরপঁষঃ ভড়ৎ ঢ়ড়ষরঃরপরধহং) করে তোলা হয়। মেজর জিয়া গোয়েন্দা বাহিনীর মাধ্যমে অর্থ ছড়িয়ে, ভয় ও লোভ দেখিয়ে, অসৎ লোকদের এনে রাজনীতিতে জড়ো করে, তাদের দিয়ে দল গঠন করে, প্রকৃত রাজনীতিকদের রাজনীতির মাঠ থেকে হটিয়ে দিয়ে যে বিষবৃক্ষের চারা দেশের রাজনীতিতে রোপণ করেছিলেন, সেই চারাই আজ মহামহীরুহ হয়ে ওঠেছে। দেশে পুঁজির অবাধ বিকাশের নামে ব্যাংকের দরোজা খুলে দেওয়া হয়েছিল নব্য ব্যবসায়ী লুটেরাদের জন্য, অনুগ্রহভোগীদের জন্য।
রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছিল। তাতে দেশে প্রকৃত পুঁজিপতি ও ব্যবসায়ী শ্রেণী তৈরি হয়নি। তৈরি হয়েছে লুটেরা শ্রেণী এবং লুটপাট ও বিদেশে টাকা পাচারের প্রবল ক্ষমতাশালী একটার পর একটা সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটগুলোর স্বার্থরক্ষা এবং প্রভাব-প্রতিপত্তির প্রতীক হিসেবেই গড়ে তোলা হয়েছিল সমাজব্যবস্থার সর্বস্তরে এমনকি শিক্ষাঙ্গনেও প্রচ- শক্তিশালী সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। দেশের গণতান্ত্রিক ধারার যে সব দল ও সংগঠন রয়েছে সেই দেশপ্রেমিক শক্তি যেন মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে সে জন্য সম্ভাব্য সব কিছুই করা হয়েছে।
মৌলবাদী সন্ত্রাস ও এই লুটেরা সন্ত্রাস মিলে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিকে প্রায় গলা টিপে ধরেছে।
আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের সঙ্গে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মরহুম জিয়াউর রহমানের জড়িত থাকার কথা বলা হলে বিএনপির বর্তমান নেতৃত্ব তা অস্বীকার করেন। কিন্তু হত্যা-ক্যুয়ের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা বদল ও স্থায়ী করার প্রক্রিয়ায়ই বিএনপি নামক রাজনৈতিক দলটির জম্ম। আদালতে বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের বিচার প্রক্রিয়া চলাকালে ঘাতকদের সঙ্গে জিয়ার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা অনেকের মুখেই শোনা গেছে। হত্যা পরিকল্পনার কথা যে জিয়াউর রহমান জানতেন এবং তিনি যে তাদের এগিয়ে যেতে বলেছিলেন, তারও অনেক তথ্য-প্রমাণ এখন পাওয়া যাচ্ছে।
ঘাতকদের কেউ কেউ বিদেশী সংবাদ মাধ্যমের কাছেও এ ব্যাপারে স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্য দিয়েছেন। তাছাড়া সবচেয়ে বড় কথা, জিয়া হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রধা বেনিফিশিয়ারি। তিনি যদি ওই হত্যাকা-ের সঙ্গে সম্পৃক্ত না থাকতেন তাহলে তিনি রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিয়েও কেন খুনিদের বিচারের সম্মুখীন না করে উল্টো তাদের বিচার থেকে দায়মুক্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন এবং বিদেশি দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করেছিলেন? জিয়া নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা বলে দাবি করলেও শাসনক্ষমতা হাতে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও স্বপ্নকে ভূলুণ্ঠিত করে দেশকে পাকিস্তানি ধারায় ফিরিয়ে এনেছিলেন। জিয়ার উত্তরসূরী হিসেবে খালেদা জিয়া তার দেখানো পথেই হেঁটেছেন। অনেক নাশকতা-সহিংসতার সঙ্গেই বিএনপির সংশ্লিষ্টতার কথা বিভিন্ন ঘটনায় প্রকাশ পেয়েছে এবং পাচ্ছে।
অথচ দুর্ভাগ্য, দেশের একটি বুহৎ জনগোষ্ঠীর কাছে বিএনপি এখনও একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল!
ছিয়াশির নির্বাচন ও বেগম খালেদা জিয়ার রহস্যময় আচরণ
বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের হত্যার পর নানা ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার মঞ্চে আবির্ভূত সামরিক শাসক জিয়ার বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন গড়ে উঠার আগেই তিনি উচ্চাভিলাষী সামরিক সহকর্মীদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন। এরপর এরশাদ সাত্তার সরকারকে বন্দুকের নল দেখিয়ে উচ্ছেদ করে ক্ষমতা দখল করেন। ততদিনে সামরিক শাসক ও সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ সোচ্চার হয়ে উঠে। এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, বাম ঘরানার রাজনৈতিক দল সবাই এরশাদের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে রাজপথে নামে। গড়ে ওঠে আন্দোলন।
এই আন্দোলনে যুক্ত হতে থাকে সাধারণ মানুষ। এরই মধ্যে চাপের মুখে এরশাদ ১৯৮৬ সালে সাধারণ নির্বাচন ঘোষণা করে। এই নির্বাচনকে আন্দোলনের অংশ হিসেবে বিবেচনা করে সেই সময়ে ১৫ দলীয় জোট ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু শেষ মুহূর্তে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়ে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপিসহ কয়েকটি ছোট রাজনৈতিক দল এরশাদের ষড়যন্ত্রকেই সফল হতে সহায়তা করে। কেননা এরশাদ চাইছিল যে কোনো মূল্যে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্য ভাঙ্গতে।
তার বিশ্বাস ছিল, বিভক্ত রাজনৈতিক শক্তি এরশাদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে না। এ ক্ষেত্রেও ঘটলও তাই। ছিয়াশির নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের প্রতিপক্ষ হিসেবে এরশাদের পাশাপাশি বিএনপিও দাঁড়িয়ে যায়। বিএনপি যতটা না এরশাদের স্বৈশাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার, তার চেয়ে বেশি নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের চরিত্র হননে তৎপর হয়ে উঠে। বিএনপি নেত্রীর এই আকস্মিক পিছটান সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে।
এর পুরো ফায়দা তোলেন এরশাদ। ১৫ দলের ঐক্য বিনষ্ট হওয়ায় এরশাদের বিরুদ্ধে যে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল তা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে নানা কারসাজি করে প্রশাসন, কালো টাকা, মিডিয়া ক্যুর মাধ্যমে এরশাদ সংখ্যাগরিষ্ঠতা আদায় করে। পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিএনপি যদি ১৫ দলের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে ’৮৬ সালে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করত, তাহলে নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের ইতিহাস অন্যরকম হতো।
ছিয়াশির নির্বাচনে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া কেন শেষ মুহূর্তে পিঠটান দিয়েছিলেন তা সাধারণ মানুষের কাছে এক অপার বিস্ময়।
তবে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের রাজনৈতিক সংকটের মুখে নিক্ষেপ করে তাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সুবিধাবাদের কলঙ্ক আরোপের মাধ্যমে নিজের আপোষহীন ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করতে এক গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই বেগম খালেদা জিয়া সেদিন নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন।
বেগম খালেদা জিয়া অবশ্য বিভিন্ন সময় রহস্যময় ভূমিকা পালন করেছেন, রহস্যময় আচরণ করেছেন। জিয়াউর রহমানের হত্যাকা-ের পর বেগম খালেদা জিয়া ও বিএনপির ভূমিকা ছিল খুবই রহস্যজনক। ক্যান্টনমেন্টেই স্বামীর হত্যাকা-ের এক ধরনের বেনিফিশিয়ারি হয়ে বাড়িঘরের মালিকানা পেয়েছেন এবং সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে বাস করেছেন। যে এরশাদ বন্দুকের জোরে বিএনপি সরকারকে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করেছেন তার কাছ থেকে নানা সরকারি অনুগ্রহ ভোগ করেছেন।
বিচারপতি সাত্তারের নেতৃত্বাধীন বিএনপির নির্বাচিত সরকারকে যখন জেনারেল এরশাদ সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা থেকে হটান এবং বিএনপির অনেক নেতা ও মন্ত্রীকে জেলে ঢোকান, তখন বেগম জিয়া তার বিরুদ্ধে টুঁ-শব্দটি করেননি। বরং সম্পূর্ণ মৌন থেকে এরশাদের সব অবৈধ কাজকে একটা সময় পর্যন্ত নীরব অনুমোদন দিয়েছেন বলা চলে।
স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করে এরশাদের অনুগ্রহভাজন ও দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত মন্ত্রীদের নিজ দলে ফিরিয়ে আনেন এবং গণনির্যাতনকারী পুলিশ অফিসারদের প্রমোশন দেন। এদের মধ্যে এরশাদের আমলে চট্টগ্রামের জনসভায় শেখ হাসিনার প্রতি গুলিবর্ষণকারী পুলিশ অফিসারও রয়েছেন।
যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রশ্নে বেগম জিয়া ও বিএনপির ভূমিকা
১৯৯৬ সালে নানা কারসাজি করে নির্বাচনে জিতে বিএনপির পক্ষ থেকে আস্ফালন করে বলা হয়েছিল, একশ’ বছরেও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে পারবে না।
কিন্তু ২১ বছরের মাথায় এসে ১৯৯৬ সালেই এরা একটা বড় হোঁচট খায়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার প্রক্রিয়া শুরু করে। কাজটা অবশ্যই খুব সহজ ছিল না। তারপরও আওয়ামী লীগ সরকার তখন অত্যন্ত ধৈর্য ও সহনশীলতার পরিচয় দেয়। বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে আত্মস্বীকৃত খুনিদের দ্রুত বিচারের মাধ্যমে তড়িঘড়ি করে ফাঁসিতে ঝোলানোর পথে না গিয়ে প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার আশ্রয় নেওয়া হয়েছিল।
বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা পূরণ করতে কিছু মানুষকে যেনতেনভাবে মৃত্যুদ- দেওয়ার ব্যবস্থা করেননি।
কিন্তু দেশের প্রচলিত বিচার প্রক্রিয়া এতই লম্বা যে, পাঁচ বছরের মেয়াদকালে শেখ হাসিনার সরকার তা সম্পন্ন করতে পারেনি। ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর ঢাকার তৎকালীন দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল ২০ আসামির মধ্যে ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন। নিম্ন আদালতের এই রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের আপিল ও মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিতকরণের শুনানি শেষে ২০০০ সালের ১৪ এপ্রিল হাইকোর্টের তৃতীয় বেঞ্চ ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে ৩ জনকে খালাস দেন। এরপর সরকার বদলের পর এই প্রক্রিয়া কার্যত বন্ধ হয়ে যায়।
অবশ্য ওই সময় ব্যক্তিগতভাবে শেখ হাসিনা হয়তো মনে করেছিলেন, ২০০১ সালের নির্বাচনে তার দল আবার ভোটযুদ্ধে বিজয়ী হবে এবং বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা শেষ করতে কোনো সমস্যা হবে না। কিন্তু ২০০১ সালের নির্বাচনের ফল আওয়ামী লীগের পক্ষে যায়নি। আওয়ামী লীগ বিরোধী সর্বাত্মক অপপ্রচার, বাস্তবতা অনুধাবন করে কার্যকর কৌশল গ্রহণে ব্যর্থতা এবং জাতীয়-আন্তর্জাতিক চক্রের নীলনকশার নির্বাচনে এককদল হিসেবে বেশি লোকের সমর্থন পেয়েও আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হয়।
বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় বসে তাদের ‘আদর্শ’ মতই বঙ্গবন্ধু হত্যা বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে সব ধরনের কূটকৌশ প্রয়োগ করেছে। হত্যা মামলার আপিল শুনানি নিয়ে জোট সরকার ক্রমাগত টালবাহানা করেছে।
জোট সরকারের আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ নেপথ্য থেকে কলকাঠি নাড়ায় একের পর এক বিচারপতি ওই মামলার শুনানি গ্রহণে বিব্রতবোধ করেছেন। এছাড়াও প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিচারপতি নিয়োগ না দিয়ে মামলাকে হিমঘরে পাঠানো হয়েছিল। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার যে ওই মামলা শেষ করতে চায়নি, খুনিদের বিচারের মুখোমুখি হওয়াটা যে জোট সরকারের মনঃপূত ছিল না, এটা কারও না বোঝার কথা নয়। সঙ্গত কারণেই বঙ্গবন্ধুর খুনিদের প্রতি বিএনপি-জামায়াত কৃতজ্ঞ এবং দুর্বল। এই খুনিচক্রের বদৌলতেই যে বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির উত্থান।
আওয়ামী লীগের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় জিতে গণতান্ত্রিক ধারায় দেশের শাসন ক্ষমতা গ্রহণের আকাঙ্ক্ষক্ষা বা প্রচেষ্টা বিএনপির মধ্যে কখনোই দেখা যায়নি। তাইতো নানা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে আওয়ামী নেতৃত্বকে খতম করার প্রক্রিয়ায় তাদের অধিক মনোযোগ লক্ষ্য করা যায়। শেখ হাসিনাসহ আওয়ামীগের সব শীর্ষনেতাকে হত্যার অপচেষ্টার সঙ্গেও বিএনপির সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড হামলা চালিয়ে তাকে হত্যার যে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল, এখন নানাভাবেই এটা জানা যাচ্ছে, ওই ঘটনায় বিএনপির নীতিনির্ধারকরাও জড়িত ছিলেন।
আক্রমণকারীদের রক্ষা করার জন্য বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার নানা অপতৎপরতা চালিয়েছে।
অথচ ওই গ্রেনেড হামলার দায়ও আওয়ামী লীগের ওপরই চাপিয়ে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়েছেন বেগম জিয়া থেকে শুরু করে বিএনপির শীর্ষ নেতারা। শুধু শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলার ঘটনাই নয়, ১০ ট্রাক অস্ত্র পাচার, আহসান উল্লাহ মাস্টার, শাহ এএমএস কিবরিয়া, মনজুরুল ইমামসহ জনপ্রিয় আওয়ামী লীগ নেতাদের হত্যা ইত্যাদি ঘটনার দায় বিএনপি সব সময়ই আওয়ামী লীগের ওপর চাপিয়েছে। এসব ঘটনাসম্পর্কিত মামলাগুলোকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে, আওয়ামী লীগকে ফাঁসাতে সর্বাত্মক ভূমিকা পালন করেছে।
এই দলের কাছে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের বিপুল বিজয় স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণযোগ্য হয়নি। তারা এটাকে সহজভাবে মেনে নিতেও পারেনি।
বিএনপি নেতারা মনে করেন, নির্বাচনে বিএনপি কোনো সময় হারতে পারে না। বিএনপি সব সময় থাকবে শাসক দলের মুকুট পরে। আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করায় বিএনপি নেতৃত্ব চরম অস্বস্তিতে আছে। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য তারা মরিয়া হয়ে উঠেছেন। পরবর্তী নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করার ধৈর্য তাদের নেই।
ইতিমধ্যে তারা সরকার পতনের লক্ষ্যে বিভিন্ন হিংসাত্মক কর্মসূচি পালন করছে। জামায়াতসহ বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠনের কর্মীদের দিয়ে নাশকতামূল।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।