আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

যারা বাউলের একতারা ভেঙ্গেছিল

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ

বাউলের একতারা। বাউলের সাধনযন্ত্র। প্রকারন্তের মামুলি জিনিস হয়তো ।

লাউ শুকিয়ে তৈরি। তবে সে বড় কোমল বস্তু, বড় মিঠে তার ধ্বনিস্বর- যেহেতু গুঞ্জনে গুঞ্জনে শাশ্বত সত্যরে পেতে চায় একতারা । যে কারণে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘ সাহিত্যের ঐকতানসঙ্গীতসভায় একতারা যাহাদের তারাও সম্মান যেন পায়। ’ (‘ঐকতান’। ‘জন্মদিনে।

’) তার পরও একদল শিল্পবিরোধী লোক বাউলের একতারা ভাঙ্গতে বরাবরই তৎপর ছিল। যে কারণে, বাংলায় বাউলমতের উত্থান সহজে হয়নি। নানাভাবে বাউলসাধকদের কন্ঠরোধ করবার চেষ্টা করা হয়েছে। বাউলদের বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছে সামাজিক আন্দোলন, দেওয়া হয়েছে নানা বিধান ও ফতোয়া, রচিত হয়েছে বাউলবিরোধী নানা বইপত্র, লিফলেট। মূলধারার বাইরে বলে গোঁড়া হিন্দু ও মুসলিম-এ দু’ সম্পদায় দ্বারাই বাউলেরা আক্রান্ত হয়েছেন।

এখনও হচ্ছেন। বাউল সম্পর্কে মুন্সী মেহেরুল্লার ধারণা ছিল, ‘বানাইল পশু তারা বহুতর নরে। ’ কবি জোনাব আলী প্রচন্ড আক্রোশে সরাসরি বলেছেন, ‘লাঠি মার মাথে দাগাবাজ ফকিরের। ’ কাঙাল হরিনাথের সাপ্তাহিক ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’য় (আগষ্ট১৮৭২)‘জাতি’ শীর্ষক আলোচনায় লালন ফকির সম্বন্ধে প্রসঙ্গক্রমে আলোকপাত করা হয়। হিন্দুসম্প্রদায়ের ‘জাতি’-বিপন্নতার জন্য লালন ও তাঁর সম্প্রদায়কে এখানে দায়ী করা হয়েছে।

ত্রিপুরা জেলা মুসলিম ছাত্র সম্মেলনের চতুর্থ অধিবেশনে শিক্ষাবিদ ডক্টর মোঃ মোয়াজ্জেম হোসেন মন্তব্য করেন যে, লালনসহ অন্যান্য লোককবি যে-সব গান রচনা করে গেছেন,‘তাহাতে যথেষ্ঠ রসবোধের পরিচয় নাই’ এবং ‘এগুলি গ্রাম্যতাদোষে দুষ্ট বলিয়া ভদ্রসমাজে স্থান করিয়া লইতে পারে নাই। ’ শিক্ষাবিদ ডক্টর মোঃ মোয়াজ্জেম হোসেনের এই (অসার ও হাস্যকর) কথাগুলি মাথায় রেখে লালনের একটি গান স্মরণ করি। এমন মানব-জনম আর কি হবে মন যা করো ত্বরায় করো এই ভবে। অনন্তরুপ সৃষ্টি করলেন সাঁই শুনি মানবের উত্তম কিছুই নাই দেব-দেবতাগন করে আরাধন জন্ম নিতে মানবে। কত ভাগ্যের ফলে না জানি মন রে পেয়েছ এই মানব-তরণী বেয়ে যাও ত্বরায় সুধারায় যেন ভরা না ডোবে।

এই মানুষে হবে মাধুর্য-ভজন তাই তো মানুষ-রুপ গঠলেন নিরঞ্জন এবার ঠকলে আর না দেখি কিনার অধীন লালন তাই ভাবে। শিক্ষাবিদ ডক্টর মোঃ মোয়াজ্জেম হোসেনএর রসবোধ কতটুকু ছিল-সে প্রশ্ন তুলে লাভ নেই। শরিয়তপন্থিরা বরাবরই শিল্পবিরোধী সঙ্গীতবিরোধী-যে কারণে সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী। তবে সত্য এই-অগ্রসরমান সভ্যতা শিক্ষাবিদ ডক্টর মোঃ মোয়াজ্জেম হোসেনদের প্রত্যাখান করছে আর লালনকে গ্রহন করছে। লালনের পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথও সমুজ্জ্বল হয়ে উঠছেন।

১৯২২ সালে শ্রীনিকেতন পল্লীসেবা বিভাগের গ্রামসেবার কাজের ধারা নির্ধারণ করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গেক্রমে শান্তিদেব ঘোষের পিতা কালীমোহন ঘোষকে বলেছিলেন- তুমি তো দেখেছ শিলাইদহতে লালন শাহ ফকিরের শিষ্যগনের সহিত ঘন্টার পর ঘন্টা আমার কীরুপ আলাপ জমত। তারা গরীব। পোষাক -পরিচ্ছদ নাই। দেখলে বোঝার জো নাই তারা কত মহৎ। কত গভীর বিষয় কত সহজ ভাবে তারা বলতে পারত।

আজও ঢাকা শহরে-ধরা যাক চারুকলার সামনে- বাউলকে ঘিরে ধরে একঝাঁক উৎসুক তরুণ-তরুণীকে দেখা যায়। ওই একই কারণে। ‘তুমি তো দেখেছ শিলাইদহতে লালন শাহ ফকিরের শিষ্যগনের সহিত ঘন্টার পর ঘন্টা আমার কীরুপ আলাপ জমত। তারা গরীব। পোষাক -পরিচ্ছদ নাই।

দেখলে বোঝার জো নাই তারা কত মহৎ। কত গভীর বিষয় কত সহজ ভাবে তারা বলতে পারত। ’ আর শিক্ষাবিদ ডক্টর মোঃ মোয়াজ্জেম হোসেন মনে করতেন, লালনসহ অন্যান্য লোককবি যে-সব গান রচনা করে গেছেন,‘তাহাতে যথেষ্ঠ রসবোধের পরিচয় নাই’ এবং ‘এগুলি গ্রাম্যতাদোষে দুষ্ট বলিয়া ভদ্রসমাজে স্থান করিয়া লইতে পারে নাই। ’ রবীন্দ্রনাথ তৎকালীন বাংলার ভদ্রসমাজের শীর্ষস্থানীয় প্রতিনিধি ছিলেন। কাজেই মোয়াজ্জেম হোসেন কাদের কথা বলছেন-ঠিক বোঝা গেল না।

বাংলার ভদ্রসমাজে লালনসহ বাংলার লোক কবির গান বহুপূর্বেই স্থান করে নিয়েছে। ২ প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ও প্রগতিশীল লেখক কাজী আবদুল ওদুদ ছিলেন রবীন্দ্রচেতনায় সমুজ্জ্বল এক প্রাণ। তাঁর জন্ম ২৬ এপ্রিল ১৮৯৪ ফরিদপুর জেলার পাংশা উপজেলার অর্ন্তগত বাগমারা গ্রামে। ১৯২০ সালে ঢাকা কলেজে বাংলার অধ্যাপক হিসেবে পেশাগত জীবন শুরু করেন। তাঁর একটি স্মরণীয় কীর্তি: ‘ব্যবহারিক শব্দকোষ’।

এটি জনপ্রিয় বাংলা অভিধান। কাজী আবদুল ওদুদ-এর অন্যান্য গ্রন্থ-মীর পরিবার; নবপর্যায়; রবীন্দ্র কাব্যপাঠ; শাশ্বত বঙ্গ। ‘শাশ্বত বঙ্গ’ প্রকাশিত হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের ঠিক এক বছর আগে। সে গ্রন্থে আবদুল ওদুদ লিখেছেন-‘এই মারাফত-পন্থীর বিরুদ্ধে আমাদের আলেম -সম্প্রদায় তাঁদের শক্তি প্রয়োগ করেছেন, আপনারা জানেন। ...এক যুগ যে সাধনাকে মূর্ত করে তুলল, অন্য যুগের ক্ষুধা তাতে নাও মিটতে পারে।

কিন্তু, আলেমদের এই শক্তি প্রয়োগের বিরুদ্ধে কথা বলবার সবচাইতে বড় প্রয়োজন এইখানে যে সাধনার দ্বারা সাধনাকে জয় করবার চেষ্টা তারা করেন নি, তার পরিবর্তে অপেক্ষাকৃত দূর্বলকে লাঠির জোরে তারা দাবিয়ে দিতে চেয়েছেন। (শাশ্বত বঙ্গ। ) কী ভাবে? তার সামান্য কিছু সূচনায় বলেছি। আরও বলি। মুন্সী এমদাদ আলী (১৮৮১-১৯৪১) প্রণীত ‘রদ্দে নাড়া’ (২৪আষাঢ় ১৩২৪) নামের অপ্রকাশিত পুস্তিকায় বাউল বা নাড়ার ফকিরদের বিশদ পরিচয় দিয়ে তাদের তীব্র নিন্দা-সমালোচনা করা হয়েছে।

রংপুর জেলার বাঙ্গালীপুর-নিবাসী মওলানা রেয়াজউদ্দীন আহমদ ‘বাউলধ্বংস ফৎওয়া’ অর্থাৎ ‘বাউলমত ধ্বংস বা রদকারী ফৎওয়া’ প্রণয়ন ও প্রচার করেন। বাংলার প্রসিদ্ধ ওলামা ও নেতৃবৃন্দ এই ফতোয়া সমর্থন ও অনুমোদন করেছিলেন। এ কারণেই তখন বলছিলাম, বাংলায় বাউলমতের উত্থান সহজে হয়নি। নানাভাবে বাউলসাধকদের কন্ঠরোধ করবার চেষ্টা করা হয়েছে ...যা হোক। আসল কথা তো কাজী আবদুল ওদুদ বলেই দিয়েছেন: ... কিন্তু আলেমদের এই শক্তি প্রয়োগের বিরুদ্ধে কথা বলবার সবচাইতে বড় প্রয়োজন এইখানে যে সাধনার দ্বারা সাধনাকে জয় করবার চেষ্টা তারা করেন নি, তার পরিবর্তে অপেক্ষাকৃত দূর্বলকে লাঠির জোরে তারা দাবিয়ে দিতে চেয়েছেন।

(শাশ্বত বঙ্গ। ) ৩ আজও বাউলের একতারা ভাঙ্গতে একশ্রেণির শিল্পবিরোধীরা তৎপর। আমরা যেন রবীন্দ্রনাথ ও কাজী আবদুল ওদুদ এর ঐতিহাসিক ভূমিকার কথা ভুলে না যাই। এবং দূত্যিময় মহাকালের দিকে তাকিয়ে আমরা আমাদের কর্তব্যকর্ম স্থির করি। সূত্র: আবুল আহসান চৌধুরী: লালন সাঁইয়ের সন্ধানে।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.