সঙ্গে সাহিত্যের সুবাস ...
ব্রিটিশ আমলের শেষদিকে পূর্ববঙ্গের মানুষ মুসলমানিত্বে ঝুঁকেছে, মুসলিম-রাষ্ট্র পাকিস্তান চেয়েছে। কিন্তু পাকিস্তান আমল শুরু হতে না হতেই সে বাঙালিত্বে ঝোঁকা শুরু করে। বিশেষ করে ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে সে বাঙালিত্বের দিকে ঝুঁকে, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বঞ্চনা একে ত্বরান্বিত করে। হিন্দু বাঙালিরা বাঙালিত্ব ও মুসলমানিত্ব আলাদা করে দেখলেও বাঙালিত্বের সর্বোচ্চ পরাকাষ্ঠা দেখালো মুসলমানরাই। ভাষাভিত্তিক যে জাতি, সেজাতির স্বাধীকার আন্দোলন শুরু হলো ভাষা-আন্দোলনের মধ্য দিয়েই।
সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের মধ্যে মুসলমানিত্বের কালে বাঙালিত্ব বলে শক্ত প্রতিপক্ষ ছিলনা, আবার বাঙালিত্বের কালে মুসলমানিত্ব বলে শক্ত প্রতিপক্ষ পাওয়া যায়নি। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে তারা পরস্পরের প্রতিপক্ষ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এটা একটা দুঃখজনক ও কৌতূহলোদ্দীপক বাস্তবতা। এর বহুবিধ ও জটিল কারণ রয়েছে। তবে ঘটনাক্রম হিসেবে শাসক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ব্যর্থতা, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড, জিয়ার বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ তত্ত্ব, এরশাদশাসনসহ সামরিক আমলাতন্ত্রের ইসলামপসন্দ অবস্থান ইত্যাদি দৃষ্টিগোচর হতে পারে।
পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে পড়ে নব্বই দশকে মুক্তবাজার অর্থনীতিবাহিত ভোগবাদিতার আবির্ভাব, নাইন-ইলেভেন ও তৎপরবর্তী আন্তর্জাতিক ঘটনাবলী এবং জামাতের সঙ্গে মিলে বিএনপি জোটগঠন -- এই তিনটি অনুষঙ্গের কারণে। এই তিনটি কারণে গাণিতিক হিসাবে বাঙালিত্ব খানিক পিছু হটেছে এবং মুসলমানিত্ব অধিক শক্তি অর্জন করেছে। মুক্তবাজারের ভোগবাদিতা বাঙালিত্বের অনুসারীদের আদর্শবিমুখ করেছে, নাইন-ইলেভেনপরবর্তী ঘটনাবলী সেকুলারদের কনফিউজড করে তুলেছে, বিগত জোটসরকারের সময়ে পলিটিকাল ইসলাম প্রভূত আশকারা পেয়েছে ও শক্তিমান হয়ে উঠেছে।
এরই ধারাবাহিকতায় বাউলমূর্তি সরানো হয়েছে, পলিটিকাল ইসলামের আব্দারে।
বিশ্লেষকরা এই ঘটনাকে রিলিজিয়াস না বলে পলিটিকালই বলছেন।
সামনে নির্বাচন, মহাজোটের সঙ্গে সরকারের একধরনের ফয়সালা হয়েছে, বিএনপি-জামাত জোটের সঙ্গে নির্বাচনে অংশগ্রহণ বিষয়ে সমঝোতা হচ্ছিল না; সরকার এই জোটকে চাপে রাখার জন্য জোট ও জামাত নেতা মুজাহিদের নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে, আর এই জোট মুজাহিদকে বাঁচাতে বা নির্বাচনী সমঝোতা নিজেদের দিকে আনার জন্য নির্মীয়মান বাউলমূর্তিকে নামিয়ে ফেলেছে। এটা হয়তো মূলত নির্বাচনকেন্দ্রিক পলিটিক্সের অংশ, কিন্তু এই কাজে ব্যবহার করা হয়েছে পলিটিকাল ইসলামকে। এবং মূর্তিটা এক লোকধর্মগুরুর। এই ঘটনার প্রতীকী তাৎপর্য আছে।
মুসলমানিত্ব টেনে নামালো লোকধর্মকে, আর বাঙালিত্ব ঘটনা ঘটে যাবার পর প্রবল প্রতিবাদে নেমেছে।
লুণ্ঠিতমর্যাদার লোকধর্ম এখন ক্রন্দসী, আর বাঙালিত্ব আর মুসলমানিত্ব মুখোমুখি। এই হলো আমাদের আত্মপরিচয়ের তিনটি ধারার হাল। এখন সময় এসেছে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে এই তিনটি ধারার মধ্যে কোনটি আমাদের জন্য বেশি প্রয়োজন, তা বুঝে নেবার।
আমার বিবেচনায় লোকধর্মকে আমাদের মূল আইডেন্টিটি হিসেবে শনাক্ত করা প্রয়োজন, অন্তঃত বিবাদমান বাঙালিত্ব ও মুসলমানিত্বের প্রকাশ্য দ্বন্দ্বের কারণে (মোটা দাগে আওয়ামী-বাম বনাম আওয়ামী বিরোধীদের রাজনৈতিক সংঘর্ষ) যখন সামাজিক, অর্থনৈতিক বা জাতিগত অগ্রগতি বারবার ব্যাহত হচ্ছে। লোকধর্মের সিনক্রেটিক ও বিশাল-উদার ছাতার তলায় সবারই ঠাঁই হবার কথা।
আমাদের ফিরে পেতে হবে সুলতানী আমলের সেই উদার ও সহনশীল পরিবেশ, যে পরিবেশ তৈরীতে লোকধর্মের অবদান ছিল। এবং এই রূপান্তরের নেতৃত্ব বাঙালিত্বের অনুসারীদেরই দিতে হবে। তার বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার অভ্যাস ও ক্ষমতা রয়েছে। তার পক্ষে বঙ্গীয় ও বাঙালি জাতিসত্তার সামগ্রিক অভিজ্ঞতার আলোকে সমসাময়িক সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব। ঢাকার ইয়াং ইন্টেলিজেন্সিয়া যে বাউলমতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে, তাকে আমি ইতিবাচক এজন্যই বলছিলাম।
শিক্ষিত নাগরিকের পক্ষে পুরোপুরি বাউল হওয়া সম্ভব নয়, কিন্তু বাউলদর্শন তাকে পথপ্রদর্শন করতে পারে। সঙ্গে নিতে হবে বাঙালিত্বের অনুসারীদের, পপুলার ইসলামের অনুসারীদের। পলিটিকাল ইসলামের অনুসারীদের সঙ্গে পাওয়া যাবেনা, বলাবাহুল্য।
বাউলমূর্তিকে পুনরায় খাড়া করিয়ে দেবার মাধ্যমে সেই কাজ শুরু করা যেতে পারে।
তথ্যসূত্র
গোলাম মুরশিদ (২০০৬), হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি, অবসর, ঢাকা।
[সামগ্রিক ইতিহাসের জন্য ভালো বই]
সুধীর চট্টোপাধ্যায় (২০০৫), গভীর নির্জন পথে, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা। [লোকধর্ম সম্পর্কিত প্রাথমিক ধারণার জন্য সুখপাঠ্য একটি বই, নৃতাত্ত্বিক কাজ]
আহমদ শরিফ (২০০৩), বাউল তত্ত্ব, পড়ুয়া, ঢাকা।
রফিউদ্দিন আহমেদ সম্পা. (২০০১), আন্ডারস্ট্যান্ডিং দ্য বেঙ্গল মুসলিমস: ইন্টারপ্রিটেটিভ এসেজ, ইউপিএল, ঢাকা। [বাঙালি মুসলমানের ওপরে রফিউদ্দিনের কাজই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য]
আবুল আহসান চৌধুরী (২০০৭), লালন সাঁইয়ের সন্ধানে, পলল প্রকাশনী, ঢাকা।
শশীভূষণ দাশগুপ্ত (১৯৭৬), অবসকিউর রিলিজিয়াস কাল্ট, ফিরমা, কলকাতা।
[লোকধর্মের ওপরে নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ]
রিচার্ড এম ইটন (১৯৯৩), দি রাইজ অফ ইসলাম এনড বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ার: ১২০৪-১৭৬০, ইউনিভার্সিটি ক্যালিফোর্নিয়া প্রেস, বার্কলি। [মধ্যযুগের ইসলামকে বুঝতে খুবই নির্ভরযোগ্য]
জয়া চ্যাটার্জি (১৯৯৪), বেঙ্গল ডিভাইডেড: হিন্দু কমিউনালিজম এন্ড পার্টিশন ১৯৩২-১৯৪৭, কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, কেমব্রিজ।
[সমাপ্ত]
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।