সঙ্গে সাহিত্যের সুবাস ...
পর্ব ১: Click This Link
আর্যরা যখন এদেশে সত্যিকারের প্রভাব ফেলতে পারলো ততদিনে দীর্ঘ পথপরিক্রমায় তা খানিকটা বদলে যায়, অনার্য সংস্কৃতির মিশেলে তা বঙ্গীয় আর্য বা ব্রাহ্মণ্যরূপ লাভ করে। বৌদ্ধ ধর্মের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। বৌদ্ধ ধর্মের হীনযান ও মহাযান এই দুই যে ধারা, তার মধ্যে বঙ্গে মহাযান ধারাটি এখানে গৃহীত হয়, যা আবার বৌদ্ধ ধর্মের সহনশীল ও উদারপন্থী ধারা। মহাযান ধারাটি সহজযানে রূপান্তরিত হয়ে বৌদ্ধিক তান্ত্রিকতায় এসে স্থির হয়, যা পরবর্তী কিছু লোকধর্ম যেমন নাথপন্থা এবং বাউলমতে ব্যাপক প্রভাব রাখতে সমর্থ হয়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত 'চর্যাপদ' আসলে কিছু তান্ত্রিকমতের কবিতা।
আর ইসলামের সুফিবাদের কথা তো আগেই বলা হয়েছে। এই তিন উদারপন্থী ধারা এই অঞ্চলের মানুষদের মধ্যে একটা উদারবাদী ধর্মীয় ও দার্শনিক ভিত্তি গড়ে দেয়। আজ যে মুসলমান একসময় বৌদ্ধ ছিল, পরে সে হিন্দু হয়েছে এবং আরও পরে মুসলমান হয়েছে। তাই আজকের যে মুসলমান, তারমধ্যে মুসলমানভাব প্রবল হবার পরও, উত্তরাধিকারসূত্রে তিন ধর্মেরই নানা মৌলিক বৈশিষ্ট্য তার অগোচরেই সে বয়ে বেড়াচ্ছে। বাঙালিত্ব বিকাশ লাভ করেছে এই তিনধর্মের সহনশীলতার মধ্য দিয়েই।
এবং তাতে হিন্দু কবিলেখকদের তুলনায় মুসলমান কবিদের অবদান কোনো অংশে কম নয়।
রিচার্ড এম ইটনের (১৯৯৩) গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে যে ষোড়শ শতকের কবি হাজী মুহাম্মদ আল্লাহ ও গোঁসাইকে একইরূপে দেখেছেন, সৈয়দ মুর্তজা রসুলকন্যা ফাতিমাকে ডাকছেন জগতজননী, সৈয়দ সুলতান খোদাকে ডাকছেন নিরঞ্জন বলে। বিখ্যাত সত্যপীর-এর 'সত্য' অংশটি হিন্দু ভগবান বিষ্ণুর আরেক নাম সত্যনারায়ণ থেকে এসেছে। একজন পীরের কাছে এসে হিন্দুত্ব ও মুসলমানিত্ব লীন হয়ে যাচ্ছে। এই মিশ্র সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ উপনিবেশের আগ দিয়ে বাঙালিত্ব ধীরে ধীরে দানা বাঁধছে।
আজও দক্ষিণবঙ্গের মুসলমান বাওয়ালীরা বনবিবির পূজা করে এজন্য যে বনের দেবী তাদের অশুভ শক্তির হাত থেকে রক্ষা করবে। একসময় ওলাবিবির পূজা দিত মুসলমান হিন্দু সকলেই। চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতিতে সেই রীতির বিলোপ ঘটেছে।
তবে ব্রিটিশ আমলে এটা একটা ঘটনা যে মুসলমানরা হিন্দুদের তুলনায় পিছিয়ে পড়ে। তার নানা কারণ রয়েছে।
সেই ব্যাখ্যায় আপাতত না গিয়ে বলছি যে ঊনবিংশ শতাব্দিতে কলকাতাকেন্দ্রিক নবজাগরণের মধ্য দিয়ে হিন্দু মধ্যবিত্ত বিকাশ লাভ করলে এবং সাহিত্য, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতিতে তারাই এগিয়ে গেলে বাঙালিত্বের বিকাশের প্রক্রিয়াটি প্রায় পুরোপুরি হিন্দুদের হাতে চলে যায়। বাঙালিত্ব ও হিন্দুত্ব প্রায় সমার্থক হয়ে ওঠে। শ্রীকান্ত উপন্যাসে শরৎচন্দ্র তাই এরকম একটি ফুটবল ম্যাচের কথা উল্লেখ করেছিলেন যেখানে 'বাঙালি' ও 'মুসলমান'রা প্রতিপক্ষ হিসেবে অংশ নেয়। এইভাবে ব্রিটিশদের ইন্ধন ও নানা বাস্তব ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে দুই জাতির মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা বাড়তে থাকে।
মুসলমানরা ঊনবিংশ শতাব্দির শেষ দিক থেকে আত্মসচেতন হয়ে ওঠে।
১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গে মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষিত হবে এরকম ভাবা হয়েছিল। কিন্তু হিন্দু নেতা-কর্মীরা এর প্রবল বিরোধিতা করে। বঙ্গভঙ্গবিরোধী সহিংস আন্দোলনের মধ্য দিয়ে হিন্দুদের নেতৃত্বে বাঙালিয়ানা রক্ষার দাবি তুঙ্গে ওঠে। এই বাঙালিয়ানার মধ্যে তারা মুসলমানদেরও রাখতে চাইলো, ব্রিটিশরা বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে বাঙালিদের বিভক্ত করে দুর্বল করে দিতে চায়, এই ছিল তাদের মত। ১৯১১ সালে ব্রিটিশ সরকার বঙ্গভঙ্গ রদ করতে বাধ্য হয়।
এই পর্যায়ে বাঙালিত্বের আলোচনাটি স্থগিত রেখে মুসলমানিত্বের আলোচনাটি শুরু করা দরকার।
[চলবে]
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।