সঙ্গে সাহিত্যের সুবাস ...
বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রে বসবাসকারী বাঙালি মুসলমানদের আত্মপরিচয় অনুসন্ধান করতে গেলে পাওয়া যাবে তিনটি ধারা -- বাঙালিত্ব, মুসলমানিত্ব ও লোকধর্ম। বাঙালিত্ব হলো এই মানুষগুলোর জাতিগত পরিচয়, মুসলমানিত্ব হলো ধর্মীয় পরিচয় এবং লোকধর্ম হলো প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর চর্চিত গৌনধর্মসমূহ।
বাঙালি মুসলমানের কাছে এই দ্বৈধতার প্রশ্নটি বরাবরই ঘুরেফিরে এসেছে যে আমি মূলত কে, বাঙালি না মুসলমান? বাঙালিত্বে বিশ্বাসী যে সে তার মুসলমানিত্ব খারিজ করতে পারলে যেন বাঁচে, আর মুসলমানিত্বে যে বিশ্বাসী, সে মনে করে বাঙালিপনা হলো হিন্দুয়ানি ব্যাপার। অথচ দুটোরই এমন জাতিগত ও ঐতিহাসিক সত্যতা আছে যে কোনোটিকেই পুরোপুরি বাদ দেয়া চলেনা, সম্ভবও নয়। এই অঞ্চলের 'মুসলমানের' জীবনযাপনে যেমন কিছু হিন্দুয়ানি/বাঙালি ব্যাপার ঢুকে গেছে, তেমনি 'বাঙালি'কেও বহির্বিশ্বে মুসলমান পরিচয় বয়ে নিয়ে বেড়াতে হচ্ছে, তা সে ইসলামের চর্চা করুক আর নাই করুক।
নাইন ইলেভেনের পর এখন তা এক জটিল রূপ পেয়েছে। তবে লোকধর্ম চর্চাকারীর কাছে এই বিতর্ক অহেতুক মনে হতে পারে। কারণ সে এমন দার্শনিক চিন্তার ও মানবিক ভাবনার পর্যায়ে বিরাজ করে যে, এই বিতর্ককে তার কাছে কৃত্রিমভাবে বানিয়ে-তোলা শিক্ষিত মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চামাত্র মনে হবে।
আমাদের আত্মপরিচয়ের ডিসকোর্সকে ঘিরে বাঙালিত্ব ও মুসলমানিত্বের বিতর্ককে নিয়ে বহু দিস্তা কাগজ ব্যয় হয়েছে, কিন্তু লোকধর্মের বিষয়টিকে এই আলোচনায় অনুপ্রবেশের অনুমোদন দেয়া হয়নি। এই রচনায় বাঙালিত্ব ও মুসলমানিত্বের বিষয়টি ছাড়াও লোকধর্মকে গুরুত্ব দিয়ে বিশেষভাবে আলোকপাত করা হয়েছে।
লোকধর্মের বিষয়টিকে এই আলোচনায় যুক্ত করতে পারলে যেমন আত্মপরিচয়ের বিষয়টি ভিন্ন মাত্রা পায় তেমনি একটি সমাধানিক একটা জায়গাও পৌঁছা সম্ভব।
বাঙালিত্ব
বাঙালিত্ব হলো আমাদের বাংলা ভাষাভিত্তিক এক জাতিগত পরিচয় যা আসলে আমাদের প্রাথমিক পরিচয়ই বটে। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এজন্যই বলেছিলেন যে মা-প্রকৃতি আমাদের চেহারায় এমন এক ছাপ মেরে দিয়েছে যে টিকি-পৈতা বা দাড়ি-টুপি-লুঙ্গির বাহ্যিক চিহ্ন দিয়ে তাকে লুকানো সম্ভব নয়। তবে বাঙালিত্বের এই জাতিগত পরিচয়টি পূর্ণ রূপ পেয়েছে, ঐতিহাসিক বিচারে, খুব বেশি দিন নয়। গোলাম মুরশিদের (২০০৬) পর্যবেক্ষণ থেকে জানা যাচ্ছে: ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতকের আগে সত্যিকারের বাংলা ভাষা বিকাশ লাভ করেনিভ চতুর্দশ শতকের আগে অখণ্ড বঙ্গদেশ গড়ে ওঠেনি।
আর এই অঞ্চলের লোকেরা বাঙালি বলে পরিচিত হননি আঠারো শতকের আগে।
এই সময়কালের পূর্বে এই অঞ্চল বরেন্দ্র, সমতট, বঙ্গ, হরিকেল এরকম কয়েকটি জনপদে বিভক্ত ছিল এবং অধিবাসীরা জনপদ অনুসারেই পরিচিত হতো। আর উত্তর ভারতে আর্যরা খ্রিস্টপূর্ব দুই হাজার বছর পূর্বে আসলেও দূরবর্তী পূর্ব ভারত বা এই অঞ্চলে তারা আসে অনেক পরে। এই অঞ্চলের অনার্য লোকজন তাদের কাছে 'বর্বর'রূপেই পরিচিত ছিল। খ্রিস্টের জন্মের মাত্র কয়েকশ বছর আগে, মৌর্য আমলে (৩২১-১৮১ খ্রি.পূ.) আর্যপ্রভাব অনুভূত হয়।
কিন্তু আর্যদের ধর্ম ব্রাহ্মণ্যবাদ তখনও এই অঞ্চলে বিস্তার লাভ করতে পারেনি, এই অঞ্চল তখন ছিল বৌদ্ধদের অঞ্চল। পরবর্তী সময়ে পাল আমলে (৭৫০-১১৬১) বৌদ্ধধর্মের চূড়ান্ত বিকাশ ঘটে। আর ১১৬১ সালে দাক্ষিণাত্য থেকে আসা সেনরা বাংলা দখল করে এবং বৌদ্ধদের হত্যা করে ও তাড়িয়ে দেয়। তবে এই হত্যাযজ্ঞের আগ পর্যন্ত এই অঞ্চলে বৌদ্ধ ও হিন্দুরা পাশাপাশি শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতো। পালরা হিন্দু দেবতা শিব ও বিষ্ণুর পৃষ্ঠপোষণা করতো।
তবে সেনরা শ্রেণীভেদপ্রথাসমেত রক্ষণশীল হিন্দুমত প্রতিষ্ঠা করে। বেঁচে থাকা বৌদ্ধরা উত্তর ভারত বা দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে পালিয়ে যায় অথবা হিন্দু পরিচয় গ্রহণ করে এখানেই থেকে যায়।
তুর্কী সেনা বখতিয়ার খিলজি দুর্বল সেনশাসক লক্ষণ সেনকে পরাজিত করে বঙ্গবিজয় করেন ১২০৪ সালে। কিন্তু তার আগমনের পূর্বেই আরবরা বাণিজ্যের লক্ষ্যে এদেশে আসতে শুরু করে নবম শতক থেকে। আর আসতে থাকেন ধর্মপ্রচারক দরবেশরা।
এই পীর-দরবেশরা অবশ্য আরব নয়, আসেন ইরান ও মধ্য এশিয়া থেকে। তারা সঙ্গে নিয়ে আসেন অবিকৃত আরব-ইসলাম নয়, পারস্য সুফিমত প্রভাবিত ইসলাম। যাহোক এই সুফিদের শান্তির বাণী, সমাজসেবা বর্ণভেদে বিন্যস্ত হিন্দুসমাজের নিচুতলার মানুষদের আকৃষ্ট করার জন্য যথেষ্ট হয়। আবার হিন্দুত্বের পরিচয়ে লুকিয়ে থাকা পাল আমলের বৌদ্ধরা ইসলামের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়। দলে দলে লোক ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে।
বখতিয়ার-পরবর্তী সুলতানী আমলে এই প্রবণতা বেগবান হয়। বখতিয়ার-পরবর্তী পাঁচশ বছরের মুসলমান-শাসনকালে (সুলতানী ও মোগল সুবা) এই অঞ্চলে হিন্দু ও মুসলমানরা শান্তিপূর্ণভাবে ও অসাম্প্রদায়িক রীতিতে পাশাপাশি বসবাস করতো। সত্যি বলতে, সেনদের বৌদ্ধবিতাড়ন ছাড়া প্রাচীনকাল থেকেই এদেশের মানুষ সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে উঠে বসবাস করার সুযোগ পেয়েছে -- সাম্প্রদায়িকতা নামক বস্তুটির সঙ্গে আমরা পরিচিত হয়েছি ব্রিটিশ আমলে। শাসকদের উদারতার পাশাপাশি, মূল কারণটা হলো এই যে বৌদ্ধ, হিন্দু ও ইসলাম, এই তিন ধর্মই অবিকৃত রূপে এখানে চালু হয়নি। বরং অনার্য সংস্কৃতির সঙ্গে মিলে তিন ধর্মেরই একটা বঙ্গীয় চেহারা পেয়েছে।
বলা যায় তিন ধর্মেরই সহনশীল বা উদার রূপটি বাংলায় বিকশিত হয়েছে।
[চলবে]
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।