আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাউলের মূর্তি সরানোয় মুসলমানি সাফল্য: আত্মপরিচয় অনুসন্ধানের পুনর্পাঠ, পর্ব ৩

সঙ্গে সাহিত্যের সুবাস ...

পর্ব ১: Click This Link পর্ব ২: Click This Link মুসলমানিত্ব পাঁচশ বছরের মুসলমান শাসনের সময়ে দেখা গেছে সমাজে শাসকদের চাইতে সুফি দরবেশদের প্রভাবই বেশি ছিল। এমনকি শাসকরা সুফিদের সমীহ করতো, তাদের ধর্মপ্রচারের সুবিধার্থে শাসকরা জমিবরাদ্দ করে দিত। সুফিরাও সমাজের মানুষের নাড়ীর স্পন্দন ভালো বুঝতেন, স্থানীয় অনেক আচার-বিশ্বাসকে তাদের মূলনীতিতে আত্তীকরণ করেন। এমনকি অবাঙালি হলেও তারা বাঙালি রমণীদের বিয়েশাদী করে স্থানীয় হবার চেষ্টা করেছেন। শাসকদের চাইতে তাদের প্রভাব বেশি থাকায় শাসকদের তরবারী দীর্ঘ শাসনামলে খুব কমই উদ্ধত হয়েছে।

তরবারী দিয়ে বঙ্গ দখল হয়েছে, কিন্তু পরবর্তী শাসকরা সেই তরবারী কোষমুক্ত তেমন করেননি। আবার বহিরাগত শাসকদের শাসনকার্যের জন্য স্থানীয় হিন্দু রাজা বা সামন্তদের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করতে হয়েছে। বহিরাগত শাসকরা স্থানীয় বাঙালি সাহিত্য সংস্কৃতির ব্যাপক পৃষ্ঠপোষণাও করেন। এই সময়কাল এক অর্থে ছিল ইন্দো-মুসলিম শাসন। এমনকি সুলতানী আমলের নির্বিবাদী আড়াইশো বছরের মাথায়, পঞ্চদশ শতকে হিন্দু রাজা গনেশ সালতানাত দখল করলেও তার নিজ সন্তান যদুকে জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ নামে মুসলমান বানিয়ে মসনদে বসান।

হিন্দুদের দিক থেকেও উগ্র হবার সুযোগ ছিলনা। বঙ্গে এককভাবে কোনো ধর্মের মানুষেরই প্রাধান্য বিস্তার করার উপায় ছিলনা। তবে ব্রিটিশ আমলে ব্রিটিশ সরকারের গৃহীত কিছু নীতি, হিন্দু চরমপন্থা এবং ইসলামী সংস্কার আন্দোলনের কারণে এতদিন বাঙালিত্বে বিশ্বাসী মুসলমানদের একটি অংশ খাঁটি আরব-ইসলামের দিকে ধীরে ধীরে ঝুঁকে পড়ে। ইসলামী সংস্কার আন্দোলন ব্রিটিশরা ভারতের শাসন ছিনিয়ে নেয় মুসলমানদের কাছ থেকে। তাই ব্রিটিশদের সঙ্গে হিন্দুদের চাইতে মুসলমানরাই প্রথম পর্যায়ে বেশি শত্র“ভাবাপন্ন ছিল।

তাদের ব্রিটিশবিরোধিতা প্রকাশ পায় সর্বভারতীয় ওয়াহাবী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। এই ওয়াহাবী আন্দোলন ছিল আসলে এক ধরনের জিহাদ, যার উৎপত্তিস্থল আরব দেশ এবং ভারতে ব্রিটিশবিরোধিতা এই জিহাদের অন্তর্গত ছিল। তবে বিশেষত বঙ্গে তা ফরায়াজী আন্দোলনরূপে ঊনবিংশ শতাব্দিতে প্রকাশিত হয়। এর প্রবর্তক হাজী শরীয়তুল্লাহ দীর্ঘদিন আরবদেশে শিক্ষাগ্রহণ করেন এবং ওয়াহাবী মতের সঙ্গে পরিচিত হন। ফরায়াজী ও একই ধাঁচের কয়েকটি আন্দোলন বঙ্গে খাঁটি ইসলামের ধারণার জন্ম দেয় ও প্রসার লাভ করে এবং লোকধর্মপ্রভাবিত বঙ্গীয় ইসলাম হুমকির মুখে পড়ে।

বিশেষত বৌদ্ধিক তান্ত্রিকতা, সুফিবাদ প্রভাবিত যাবতীয় লোকধর্ম চর্চাকারীরা এই পিউরিফিকেশনের শিকার হয়। বাউল ধ্বংসের ফতোয়া দেয়া হয়, তাদের তৎপরতাকে অনৈসলামিক ঘোষণা করা হয়, বাউলদের ঝুঁটি কেটে নেয়া হয়, সমাজের মূলধারা থেকে বাউলরা প্রান্তিক ধারায় চলে যায়। শহুরে শিক্ষিতদের বাঙালিপনা আর্থিক-রাজনৈতিক-শিক্ষাগত কারণে ক্ষমতাবান হবার কারণে তেমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। ইসলামী সংস্কার আন্দোলনের একটা ইতিবাচক দিক হলো এর ব্রিটিশবিরোধিতা। কারণ হিন্দুরা যখন কেরানি হবার মানসে ইংরেজি পড়ালেখা শুরু করে দিয়েছে, কিন্তু মুসলমানরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লেগে গেছে।

আর এর নেতিবাচক ফল হলো এই যে গ্রামভিত্তিক বাঙালি সমাজে যে সমতার, উদারতার, সহনশীলতার একটা পরিবেশ ছিল, মোল্লাতন্ত্রের বিকাশে তা চিরতরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাউলতত্ত্বের সঙ্গে মোল্লাতন্ত্রের বিরোধ তাই ঐতিহাসিক। এইবেলা বাউলমূর্তি সরানোর জঙ্গিপনাকে আমরা স্মরণে আনতে পারি। বাউলগুরু লালনের মূর্তি বলে কথা! পৌত্তলিকতা, হাজীদের অসম্মানের যুক্তিগুলো বাহ্যিক, মূলে রয়েছে এই চিরকালীন বিরোধ। লালনের মৃত্যুদিনের প্রাক্কালেই এই ঘটনা ঘটেছে, সেটাও স্মর্তব্য।

সুফিবাদ প্রভাবিত বাউলতত্ত্বের সঙ্গে মোল্লাতন্ত্রের বিরোধের ক্ষেত্র কোনগুলো, তা আলোচনার পরবর্তী পর্যায়ে আলোকপাত করা হবে। [চলবে]

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.