সঙ্গে সাহিত্যের সুবাস ...
আগের পর্বসমূহ: Click This Link
এতক্ষণের আলোচনায় এটা হয়তো স্পষ্ট করা গেছে যে বঙ্গের যে-ইসলাম তা প্রধানত পপুলার ইসলাম (জনধর্ম), ঊনবিংশ শতাব্দির সেই সংস্কার আন্দোলনের ফলে জন্ম নিয়েছে স্কলাস্টিক ইসলামের (শাস্ত্রীয় ধর্ম), আর দেশবিভাগের আগ দিয়ে মুসলিম লিগের মাধ্যমে জন্ম নিয়েছে পলিটিক্যাল ইসলামের (রাজনৈতিক ধর্ম), স্বাধীন বাংলাদেশে যা জামাতে ইসলামী অন্য অনেক ছোট ইসলামী দলের মাধ্যমে চর্চিত হচ্ছে। সামাজিক পর্যায়ে অনেক আশঙ্কাজনক ধর্মীয় উন্মাদনা দেখা যাবার পরও, বাংলাদেশের মুসলমানরা গড়পড়তা অন্য মুসলমান দেশগুলোর চাইতে যে অপেক্ষাকৃত উদার তা কিন্তু সুফিবাদ ও লোকধর্মসমূহের প্রভাব হয়েছে। সাধারণ মুসলিম সাইকিতে একটা স্থায়ী উদারনৈতিকতা বা উন্মুক্ততা সেঁটে আছে, যা মধ্যযুগের পাঁচশ বছরের মুসলিম শাসনের সময় মুসলিমমানসে খোদাই হয়ে যায়। লোকধর্মের প্রভাবে পপুলার ইসলাম সংগঠিত হলেও স্কলাস্টিক ইসলাম ও পলিটিক্যাল ইসলাম লোকধর্মসমূহকে শত্র“ চিহ্নিত করেছে এবং নানা সময়ে আক্রমণ করেছে -- ফতোয়া দিয়ে, শারীরিকভাবেও।
অন্যদিকে বাঙালি জাতিসত্তা যখন একটা চেহারা পাচ্ছে মধ্যযুগে, কাব্য ও সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে, তাতেও লোকধর্মসমূহের অবদান রয়েছে।
লোকধর্মসমূহের উদারনৈতিক এপ্রোচ সমাজে যে সমতার পরিবেশ তৈরি করেছিল তার প্রেক্ষাপটেই বাঙালিত্বের চেতনা বিকশিত হয়। পরবর্তী সময়ে বাঙালিত্বের জোয়ারে দুইবার বঙ্গ ভেসে গিয়েছিল, প্রথমবার প্রধানত হিন্দুদের দ্বারা, বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের সময় এবং দ্বিতীয় দফায় ষাটের দশকে পাকিস্তানবিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সময়ে, প্রধানত মুসলামানদের মাধ্যমে। বাঙালিত্বের সাইকিতেও লোকধর্মের মানবপ্রেমের বাণী স্থায়ী একটা ভূমিকা রেখেছে। মূলত পাকিস্তান আমলের পূর্বেকার পপুলার ইসলামের অনুসারীরাই পরে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে শরিক হয়েছে। তবে মুসলমান হয়ে পাকিস্তানী মুসলমান শাসকদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাবার পেছনে কমিউনিজমের ভূমিকা রয়েছে।
কমিউনিজমের সেকুলার মতাদর্শ আধুনিক তত্ত্বের মোড়কে বাঙালিত্বের সঙ্গে মিশে যায়। যদিও ১৯৭১ সালে কোনো কমিউনিস্ট বিপ্লব হয়নি কিন্তু তখন পর্যন্ত দর্শন হিসেবে বাঙালি জাতীয়তাবাদে কমিউনিজমের প্রভাব এতটাই ছিল যে শেখ মুজিবুর রহমান সংবিধানে চার মূল নীতির মধ্যে সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা রেখেছিলেন। তবে কমিউনিজম প্রভাবিত সেকুলারিজম এবং আধুনিকতা এক পর্যায়ে আল্ট্রা সেকুলারিজমে রূপ পেয়েছে, এবং ইসলামবিরোধিতা অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে বাঙালিত্বে অনুপ্রবেশ করেছে। মুক্তিযুদ্ধে ইসলামপন্থী দলগুলোর বিরোধিতা এই বিষয়টিকে সুনিশ্চিত করেছে। এই আল্ট্রা সেকুলারিজম ও মডার্নিজম বাঙালিত্বের দিক থেকে লোকধর্মকে উপেক্ষা করতে উৎসাহিত করেছে -- কারণ তা গ্রাম্য, কারণ তা অনাধুনিক।
বাউল গান আধুনিক শিক্ষিতের কাছে অডিও ইন্ডাস্ট্রিবাহিত পল্লীগীতিমাত্র। লুঙিপরিহিত জটাধারী বাউল তার দৃষ্টিতে নিম্নবর্গের প্রতিনিধিমাত্র। মাজার হলো তার কাছে ভণ্ডগুরু ও গাঁজাখোর শিষ্যের আবাসমাত্র। অথচ দেখা যাবে নিম্নবর্গের বাউলের বা মাজারকেন্দ্রিক মুর্শিদের তত্ত্বকথা বোঝার বুদ্ধি পশ্চিমা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালির ঘটে নেই বললেই চলে।
তবে সময় খানিক পাল্টেছে।
সমাজতন্ত্রের পতন ঘটেছে। উদভ্রান্ত বাংলাদেশের ইয়াং ইন্টেলিজেনশিয়া নতুন কোনো মতাদর্শের দাস হতে চায়। এখন তারা বাউল দর্শনে দারুণ আগ্রহী। পোস্ট-মডার্ন তরুণ বুদ্ধিজীবী এখন শেকড়ে ফিরতে চায়। দেখা গেল সেকুলারিজমের দিক থেকে বাউলদর্শন কম বিপ্লবী নয়।
তবে কায়দা ভিন্ন আর গ্রাম্য একটা অবয়ব থাকায় এতদিন চোখে পড়েনি। ধর্মকথা নিয়েই আছে বাউল (রসুল, মদিনা, রওজা ইত্যাদি শব্দের বহুব্যবহার স্মর্তব্য), কিন্তু তার বক্তব্যের সার হলো স্কলাস্টিক বা শরিয়া ইসলামকে খারিজ করা। সেকুলারের আর বাউলের এরকম কিছু মূলনীতিতে কোনো ভেদ নাই। তবে সেকুলারের কথা গ্রাম-গঞ্জের সাধারণ মানুষ বোঝেনা, কিন্তু বাউলের জটিল তত্ত্ব সহজেই বোঝে। অতএব বাউলপথে সমাজ বদলের চেষ্টা করা যেতে পারে।
এটাকে আমি ইতিবাচক হিসেবে দেখছি। কেন দেখছি, সেই আলোচনায় ফিরে আসবো, তার আগে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর বাঙালিত্ব ও মুসলমানিত্বের দ্বন্দ্বের দিকটিতে একটু আলোকপাত করবো।
[আগামী পর্বে সমাপ্য]
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।