আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাউলের মূর্তি সরানোয় মুসলমানি সাফল্য: আত্মপরিচয় অনুসন্ধানের পুনর্পাঠ, পর্ব ৫

সঙ্গে সাহিত্যের সুবাস ...

আগের পর্বসমূহ: Click This Link লোকধর্ম আমি এখানে যাকে লোকধর্ম বলছি তাকেই অনেকে 'মাইনর রিলিজিয়াস সেক্টস' (এইচ এইচ উইলসন), বা 'অবসকিউর রিলিজিয়াস কাল্টস' (শশীভূষণ দাশগুপ্ত, ১৯৭৬), অথবা গৌনধর্ম বা উপধর্ম (সুধীর চক্রবর্তী, ২০০৫)এবং মোটের ওপরে সবাই মিস্টিসিজম বলে থাকেন। সুধীর চক্রবর্তী অষ্টাদশ শতকে বাংলায় অন্তঃত ১০২টি লোকধর্ম ছিল বলে উল্লেখ করেছেন। আর এই লোকধর্মসমূহের অন্যতম ভূমিকা ছিল শাস্ত্রীয় ব্রাহ্মণ্যবাদ ও শাস্ত্রীয় ইসলাম নিয়ে দার্শনিক প্রশ্ন উত্থাপন করা এবং বিতর্ক করা। তান্ত্রিকতা, সুফিবাদ ও বৈষ্ণববাদ -- তিন ধর্মের তিনটি উদারবাদী ধারা এইসব লোকধর্ম সংগঠনে প্রভাব রেখেছে। বৌদ্ধ তান্ত্রিকতা অন্ধ্রপ্রদেশে প্রাপ্ত দ্বিতীয় বা তৃতীয় শতকের এক সাঁচিলিপিতে বলা হয়েছে যে বাংলা ছিল এক বৌদ্ধ এলাকা।

আবার চীনা পর্যটক হিউয়েন সান লিখেছেন মৌর্য শাসকদের রাজধানী মগধে তিনি যে বৌদ্ধধর্ম দেখেছেন, বাংলার বৌদ্ধধর্ম তা থেকে আলাদা ছিল। আগেই বলেছি বৌদ্ধধর্মের উদার মহাযান ধারাটি বঙ্গে গৃহীত হয় এবং তার বিবর্তিত রূপ সহজযান থেকে তান্ত্রিকতায় এসে স্থির হয় যা অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যবর্তী সময়ে বিকশিত হয়। শশীভূষণ দাশগুপ্ত একটি উল্লেখযোগ্য তান্ত্রিক রীতি হিসেবে যোগমৈথুনকে উল্লেখ করেছেন। বোধিচিত্ত লাভে এঅঞ্চলের বৌদ্ধরা গুপ্ত যোগমৈথুন চর্চাকে উপায় হিসেবে বেছে নিয়েছিল। তবে তান্ত্রিক সাধনায় আরও দুটি রীতি হলো গুরুবাদ এবং মানবদেহে গুরুত্বপ্রদান।

ভারতীয় ধর্মসমূহে বিশেষত লোকধর্মসমূহে গুরুবাদের এজন্য গুরুত্ব দেয়া হয় যে, যেসব রহস্যময় বা গুপ্ত চর্চার মাধ্যমে গুরু সত্যকে জেনেছেন, একজন সাধারণ আগ্রহীর পক্ষে সেই সত্যকে জানা সম্ভব নয়। তাই তাকে গুরুর শিষ্য হতে হবে। এ হলো এক লণ্ঠন থেকে আরেক লণ্ঠনে আলো ছড়িয়ে দেবার মতো ব্যাপার। আর তান্ত্রিকতায় ধরে নেয়া হয় মানবদেহ হলো ব্রহ্মাণ্ডের সারবস্তু। যদি দেহের সিদ্ধিলাভ সম্ভব হয়, তবে তিন ভূবনের সব বিষয়েই সিদ্ধি অর্জন করা সম্ভব হবে।

সুফিবাদ বখতিয়ার খিলজির আগমনের পূর্বেই একাদশ শতকে সুফিরা ভারতে মতবাদ প্রচার শুরু করেন এবং দ্বাদশ শতকের শেষে তা জনপ্রিয় মতবাদ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। শশীভূষণ দাশগুপ্ত বলেন উপনিষদের প্যানেনথিয়েস্টিক মিস্টিসিজম, বৈষ্ণবীয় ভক্তিবাদ, বৌদ্ধধারার সহজিয়া আন্দোলন বিশেষত বঙ্গে যে উদারবাদী দার্শনিকতাকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল, তা সুফিবাদের প্রসারেও ভূমিকা রাখে। আর এভাবেই আর্যধর্মের মতো পারস্য থেকে বঙ্গে পৌঁছতে পৌঁছতে সুফিবাদও বঙ্গীয় চেহারা পায়। সুফিবাদ আরবের প্রকৃত ইসলামের থেকে বেশ খানিকটা আলাদা। প্রকৃত ইসলাম অদ্বৈতবাদে বিশ্বাসী এবং এখানে খোদা ও বান্দার সম্পর্ক প্রভূ ও দাসের।

কিন্তু সুফিরা দ্বৈতবাদে বিশ্বাস করে যেখানে খোদা ও বান্দার সম্পর্ক ভালোবাসার। সুফিসাধনার একটি পর্যায় হলো 'ফানা' যেখানে খোদা ও বান্দা লীন হয়ে যায়। এই ফানার বিষয়টি বৌদ্ধধর্মের 'নির্বাণ'-এর মতোই। যোগসাধনাও পরবর্তী সময়ে সুফিবাদে যুক্ত হয়, যাকে 'মুরাক্বিবা' বলা হয়ে থাকে। গুরুবাদও সুফিবাদে গুরুত্বপূর্ণ।

একজম মুরিদ পীর বা মুর্শিদের সাহায্য নিয়ে ফানাফিল্লার স্তরে পৌঁছতে পারে। অদৃশ্য খোদার চাইতে দৃশ্যমান মুর্শিদ এভাবে ভক্তিবাদী মুসলমানদের কাছে বড়ো হয়ে ওঠেন। আজকের বাংলাদেশেও অজস্র মাজারের অস্তিত্ব ও পীরপূজার রীতি সুফিবাদের প্রভাবকেই স্পষ্ট করে তোলে। বৈষ্ণববাদ বৈষ্ণববাদ হলো হিন্দুত্ববাদের একটি র‌্যাডিকাল ও সংস্কারবাদী ধারা। বাংলার সাধারণ হিন্দুদের ওপরে বৈষ্ণববাদের প্রভাবই বেশি পড়েছে, শাস্ত্রীয় ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরোধিতায় যার ভূমিকা অপরিসীম।

বৈষ্ণব সহজিয়া আন্দোলন বৌদ্ধ সহজিয়া আন্দোলন দ্বারা প্রভাবিত। ভক্তি, ভালোবাসা ও সমতার নীতিতে বৈষ্ণববাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই ভক্তি ও ভালোবাসা প্রকাশ পেয়েছে রাধা ও কৃষ্ণের ভক্তিবাদী সম্পর্ক নিয়ে রচিত পদমালায়। বৈষ্ণববাদের চরম বিকাশ ঘটে নদীয়ায় চৈতন্য দেবের মাধ্যমে যা পরে সারা বাংলায় ও ভারতের কিছু অংশে ছড়িয়ে পড়ে। তবে শ্রী চৈতন্যের আগেও জয়দেব, বিদ্যাপতি ও চণ্ডিদাসের কাব্যের মাধ্যমে বৈষ্ণববাদ বিকশিত হয়েছে।

সমতা ও ভক্তিবাদনির্ভর চৈতন্যের বাণী প্রচারে তৎকালীন মুসলমান শাসক আলাউদ্দিন হোসেন শাহ কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াননি। বরং ব্রাহ্মণরা এর প্রবল বিরোধিতা করে। কারণ ব্রাহ্মণরা বর্ণপ্রথা টিকিয়ে রাখতে চায় আর চৈতন্য এর বিলোপের বাণী প্রচার করেন। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো চৈতন্য তার বাণী প্রচারের জন্য সংস্কৃত নয়, ব্রাত্যজনের ভাষা বাংলাকেই বেছে নেন। শাস্ত্রীয় মন্ত্রের পরিবর্তে চৈতন্য নামকীর্তনকে ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন।

বৈষ্ণববাদের সমতার বাণী বাংলায় প্রভূত জনপ্রিয়তা অর্জন করে। আরেক অর্থে ইসলামের সমতার বাণী যে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিল চৈতন্য তার মতবাদের মাধ্যমে তাকে ভালোভাবেই মোকাবেলা করেন এবং এভাবে বাংলায় হিন্দুধর্ম তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে। কিন্তু চৈতন্যের মৃত্যুর ৫০ বছরের মধ্যেই গোস্বামীরা বাংলা ছেড়ে বৃন্দাবনে গিয়ে আসন গাড়েন এবং চৈতন্যের সমতার ধারণাকে বাতিল করেন। এবং এভাবে বৈষ্ণববাদ ব্রাহ্মণদের দ্বারাও স্বীকৃত হয় এবং দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে -- বর্ণপ্রথার সমর্থক ব্রাহ্মণ বৈষ্ণব ও বর্ণপ্রথাবিরোধী সাধারণ বোষ্টম। এভাবে বৈষ্ণববাদ তার প্রকৃত রূপ হারায় এবং সমতাবাদী বৈষ্ণববাদ উপধর্ম বা লোকধর্মে আশ্রয় নেয়।

তান্ত্রিকতা, সুফিবাদ ও বৈষ্ণববাদ -- এই তিন উদার ও সমতাবাদী মতবাদের সর্বোচ্চ প্রতিফলন ঘটেছে বাংলার বাউলদের মধ্যে। এবার বাউলতত্ত্ব সম্পর্কে জানা যাক। বাংলার বাউল বাউলতত্ত্ব হলো বাংলায়, বিশেষত পূর্ববঙ্গে সবচেয়ে জনপ্রিয় লোকধর্ম। সবচেয়ে বিখ্যাত বাউল দার্শনিক ও গীতিকার হলেন লালন শাহ (১৭৭৪-১৮৯০) যার আখড়া ছিল কুষ্টিয়ায়। তান্ত্রিকতা থেকে যোগসাধনা, সুফিবাদ থেকে ফানার ধারণা ও বৈষ্ণবদের থেকে ভক্তিবাদ বাউল মতবাদকে সমৃদ্ধ করেছে।

এছাড়া গুরুবাদ ও দেহতত্ত্বও বাউল মতের অপরিহার্য অংশ। বাউল মতবাদ প্রশ্ন উত্থাপনের মাধ্যমে, তর্কের মাধ্যমে তার দার্শনিকতার চর্চা করতে চায়। মারফতের অবস্থান থেকে তার প্রশ্ন শরীয়তপন্থা নিয়ে। বাউলরা বিশ্বাস করেন মুসলমান মাধব বিবি ও আউল চাঁদ বাংলায় বাউলমত প্রবর্তন করেন, মাধব বিবির শিষ্য বীরচন্দ্র তা জনপ্রিয় করেন এবং ঊনবিংশ শতাব্দিতে লালন শাহের মাধ্যমে তা পূর্ণ পরিচিতি লাভ করে। আহমদ শরিফের (২০০৩) দেয়া তথ্যানুসারে সাম্প্রতিক বাংলাদেশে ৩ লক্ষ বাউল আছেন।

বাউলরা দুই ধরনের: গৃহী ও বৈরাগী। বাউল গান কেবল পল্লীগীতিমাত্র নয়, বাউলগুরু একইসঙ্গে কবি ও দার্শনিক। চৈতন্যদেব বলেছিলেন 'মুই সেই', সুফি মনসুর হাল্লাজ বলেছিলেন 'আনাল হক' আর বাউলরা বলেন 'দেহের মাঝে আছেরে সোনার মানুষ, ডাকলে কথা কয়'। বাউল তত্ত্বে আত্মা ও পরমাত্মা একই, আত্মা পরমাত্মারই অংশ; তাই আত্মাকে জানাই হলো পরমাত্মাকে জানা। দেহের মাধ্যমেই আত্মাকে জানা বাউলদের আধ্যাত্মিক সাধনার অংশ।

'খাঁচা'র ভেতর 'অচিন পাখি'র আসাযাওয়ার অনুসন্ধানের কারণ হলো এই। বঙ্গে বাউলদের গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ভূমিকা রয়েছে। তারা তাদের মতবাদের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িকতা, জাতিগত সংঘাত, ধর্মীয় চরমপন্থার বিরোধিতা করেছে বরাবর। এভাবে তারা সব ধর্মের মানুষকে বাউল মতবাদের একক ছাতার নিচে আনতে সমর্থ হয়েছে। অন্নদাশঙ্কর রায় বলেছেন ঊনবিংশ শতাব্দির শহরকেন্দ্রিক নবজাগরণে রামমোহন রায়ের যে-ভূমিকা, গ্রামবাংলায় লালনের ভূমিকা একইভাবে সমাজসংস্কারকের।

কাঙাল হরিনাথ তার পত্রিকা 'গ্রামবার্ত্তাপ্রকাশিকা'য় স্থানীয় জমিদারদের বিরুদ্ধে লিখলে জমিদারের লাঠিয়ালরা হরিনাথের ওপর চড়াও হয় এবং লালন তার শিষ্যদের নিয়ে সেই লাঠিয়ালদের বিরুদ্ধে দাঁড়ান এবং বন্ধু হরিনাথকে রক্ষা করেন। ঘটনাচক্রে সেই জমিদারী ছিল রবীন্দ্রপরিবারের, যদিও রবীন্দ্রনাথের ওপর লালনের প্রভাব অবিসংবাদিত। রবীন্দ্রনাথের মনের মানুষের ধারণাটি বাউলমত দ্বারা প্রভাবিত। বাউলদের অসাম্প্রদায়িক অবস্থান ব্রাহ্মণ ও মোল্লা উভয়কেই ক্ষিপ্ত করে। বিশেষত ঊনবিংশ শতাব্দির ইসলামী সংস্কার আন্দোলন পরবর্তী সময়ে বাউলদের কার্যক্রমকে মোল্লারা অনৈসলামিক ঘোষণা করে।

তাদের বিরুদ্ধে ফতোয়া দেয়া হয়, পুস্তিকা লিখিত হয় এবং শারীরিকভাবে আক্রমণ করা হয়। অনেক বাউলের লম্বা চুল কেটে ফেলা হয়, দোতরা ভেঙ্গে ফেলা হয়। [চলবে]

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.