আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাউলের মূর্তি সরানোয় মুসলমানি সাফল্য: আত্মপরিচয় অনুসন্ধানের পুনর্পাঠ, পর্ব ৪

সঙ্গে সাহিত্যের সুবাস ...

পর্ব ৩: Click This Link ব্রিটিশ নীতি যাদের কাছ থেকে ব্রিটিশরা ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়েছিল সেই মুসলমানদের বরাবরই তারা পৃথক রাজনৈতিক সত্তা হিসেবে ভেবেছে। পৃথকভাবে দেখার এই নীতি কখনও মুসলমানদের বিপক্ষে গিয়েছে, কখনও পক্ষেও এসেছে। ব্রিটিশদের গৃহীত অন্তঃত তিনটি পদক্ষেপ মুসলমানদের ভবিষ্যৎ ভাগ্য নির্ধারণ করে দিয়েছে: এগুলো হলো ১৮৩৭ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ এবং ১৯৩২ সালের সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা। ঐতিহাসিক ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টারের (১৮৭১) মতে, 'ব্রিটিশ শাসনামলে মুসলমান জাতটি সব অর্থে একেবারে ধ্বংস হয়ে যায়'। প্রথম বড়ো আঘাত আসে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে পুরনো প্রশাসন ও ক্ষমতাকাঠামো একেবারে ভেঙ্গে ফেলা হয় এবং এভাবে 'আশরাফ' মুসলমানরা (এলিট মুসলমান, যাদের অন্তঃত আরব, তুর্কী বা নিদেনপক্ষে মধ্য এশীয় ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল অথবা যারা ব্রিটিশ আগমণের পূর্বে রাজ-রাজড়া জাতীয় পদবিতে সমাসীন ছিল) সাংঘাতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর এটি মূলত একটি রাজস্বব্যবস্থা হবার কারণে 'আতরাফ' (নিম্নবর্গীয় মুসলমান, মূলত ধর্মান্তরিত স্থানীয় লোকজন) কৃষকরাও এর শিকার হয়। অন্যদিকে এই বন্দোবস্তের ফলে একটি মধ্যস্বত্বভোগী জমিদার শ্রেণীর সৃষ্টি হয় যাদের মূল কাজ ছিল কৃষকদের কাছ থেকে কর সংগ্রহ করে ব্রিটিশ সরকারের কাছে জমা দেয়া। এই জমিদার শ্রেণীর বেশিরভাগই ছিলেন হিন্দু এবং এই করসংগ্রাহকরা নানা উপায়ে 'মুসলমান' কৃষকদের কাছ থেকে কর আদায় করতো। একপর্যায়ে তাদের নিপীড়কের ভূমিকায় দেখা যায়।

অন্যদিকে এই নিপীড়নসৃষ্ট প্রাপ্ত উদ্বৃত্ত অর্থ দিয়ে এই জমিদারসন্তানরা কলকাতায় ইংরেজি পড়া শুরু করে, ইউরোপীয় শিক্ষায় আলোকিত হয়ে সাহিত্য-সংস্কৃতিতে অবদান রাখা শুরু করে, কিছু সমাজসংস্কারও করে (যেমন সতীদাহ প্রথা উচ্ছেদ), একটি 'ভদ্রলোক' বা 'বাবু' শ্রেণীর জন্ম হয়, ব্রিটিশদের সঙ্গে দেনদরবার করে অধিকার আদায় করতে তারা সমর্থ হয়ে ওঠে। এমনকি ইউরোপীয় শিক্ষা তাদের উপনিবেশবিরোধী আন্দোলনে তাত্ত্বিক সমর্থন দেয়। যখন হিন্দু বাবুরা সমাজে এভাবে অগ্রবর্তী ও আধুনিক হয়ে ওঠে, মুসলমানদের অবস্থা তখন করুণ থেকে করুণতর হতে থাকে। একপর্যায়ে তারা আবিষ্কার করে তারা ব্রিটিশ ও হিন্দু উভয় দ্বারাই নিপীড়িত। ব্রিটিশ আমলের শেষ দিকে তারা সংগঠিত হতে থাকে, ১৯০৬ সালে ঢাকায় মুসলিম লিগের জন্ম হয়।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত যদি মুসলমানদের জন্য অভিশাপ হয়ে থাকে তবে ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ তাদের জন্য আশীর্বাদ বা কম্পেনসেশন হিসেবে দেখা দেয়। ঢাকাকে কেন্দ্র করে পূর্ববঙ্গ ও আসাম নামক রাজ্যটিতে মুসলমানরা বিকশিত হবে, এই ছিল লর্ড কার্জনের পরিকল্পনা। কিন্তু এই পদক্ষেপ হিন্দু মধ্যবিত্ত মানতে চায়নি, তারা একে বাংলাকে বিভক্ত করে দূর্বল করে দেবার ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখে এবং তাদের প্রবল প্রতিবাদে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হয়। কিন্তু বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে হিন্দু নেতারা যতই মুসলমানদের একক বাঙালিত্বের ছাতায় রাখতে চাননা কেন, দুই ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে ততদিনে সাম্প্রদায়িক বিভাজন সুনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। মুসলমানরা মুসলিম লিগ ও হিন্দুরা কংগ্রেসকে ঘিরে সংগঠিত হতে থাকে।

কংগ্রেসের যদিও একটা সেকুলার চেহারা ছিল, কিন্তু কংগ্রেসের ভেতরকার চরমপন্থী হিন্দুরা ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগের সময় (দ্বিতীয় বঙ্গভঙ্গ) চেয়েছে বাংলা দুই ভাগ হয়ে যাক। কারণটা হলো ১৯৩২ সালের সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা। জয়া চ্যাটার্জির (১৯৯৪) মতে ম্যাকডোনাল্ডের সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা বাংলায় নাটকীয়ভাবে ক্ষমতার ভরকেন্দ্র উল্টে দেয়। বিংশ শতাব্দির শুরুতে মুসলমানরা বঙ্গে সংখ্যায় সামান্য বেশি ছিল, কিন্তু সমাজে হিন্দু ভদ্রলোকদের প্রভাবই বেশি ছিল। কিন্তু এই রোয়েদাদে যেভাবে আইনসভার আসন বিন্যস্ত হয় তাতে মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত হয়।

বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভায় মুসলমানদের জন্য শতকরা ৪৮.৪ ভাগ, হিন্দুদের জন্য ৩৯.২ ভাগ এবং ইউরোপীয়দের জন্য ১০ ভাগ আসন বরাদ্দ করা হয়। এভাবে মুসলমানরা রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান হয়ে ওঠে। রাজনৈতিক অধিকার ও অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা অর্জনের মানসে এভাবে বাঙালি মুসলমানরা ধীরে ধীরে পাকিস্তান আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে। মুসলিম লিগে যদিও আবুল হাশিমের মতো উদারপন্থী নেতারা ছিলেন এবং যদিও পাকিস্তান আন্দোলনে বাঙালি মুসলমানরা বেশি মাত্রায় উচ্চকণ্ঠ ছিল, কিন্তু নানা ঘটনাচক্রে এই আন্দোলনের নেতৃত্ব উর্দুভাষী ও কট্টর আশরাফ মুসলমানদের হাতে চলে যায়। হিন্দুত্ববাদ বাঙালি মুসলমানদের দিক থেকে ব্রিটিশ আমলের শেষদিকে মুসলমানিত্বের দিকে অধিকমাত্রায় ঝুঁকে পড়ার জন্য তাদের এককভাবে দায়ী করা যাবেনা।

হিন্দুত্ববাদের জোয়ারও এর জন্য অনেকাংশে দায়ী। কারণ হিন্দুদের দিক থেকে ভারতীয়ত্ব মানে হিন্দুত্ব ধরে নেয়া হতো। এমনকি বাঙালিত্বের ডিসকোর্সেও তারা মুসলমানদের ঠাঁই দিতে চায়নি। শ্রীকান্ত উপন্যাসে বাঙালি ও মুসলমানদের মধ্যকার ফুটবল-ম্যাচের কথা আগেই বলেছি। তবে ভারতীয়ত্ব ও হিন্দুত্বকে সমার্থক মনে করে যে ডিসকোর্স চালু হয়, পার্থ চ্যাটার্জির (১৯৮৬) মতে, তাতে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, অরবিন্দ ঘোষ, স্বামী বিবেকানন্দ প্রমূখের লেখালেখি ও কার্যক্রম তাত্ত্বিক ভিত্তি দেয়।

১৯২০, ১৯৩০ ও ১৯৪০ দশকের ঘটনাবলী তাই বাঙালি মুসলমানের কাছে মুসলমান পরিচয় বাঙালি পরিচয়ের চাইতে ওপরে স্থান পায়। তাই বলা যায় ঊনবিংশ শতাব্দির ইসলামী সংস্কার আন্দোলন ও বিংশ শতাব্দির প্রথম পর্যায়ের রাজনৈতিক ঘটনাবলী পূর্ববঙ্গের মানুষের মানসপটে মুসলমানিত্বের অস্তিত্বটি স্থায়ী হয়ে যায়। তবে বিভাগপূর্ব সময়ে যদি বাঙালিত্বের ওপরে মুসলমানিত্ব প্রতিষ্ঠা লাভ করে, বিভাগপরবর্তী পাকিস্তান আমলে মুসলমানিত্বের ওপরে বাঙালিত্বের বিজয় ঘোষিত হয়। অধুনা সেই সেই ইতিহাস সবারই জানা, সেই পরিসরে অনুপ্রবেশের আগে আমি এবার আলোকপাত করতে চাইবো লোকধর্মের ওপর, যা একসময় সমাজে সর্বসাধারণের ধর্ম ছিল, বাঙালিত্বের বৈশিষ্ট্য গঠনে যার প্রভাব ছিল, কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দির ইসলামী সংস্কারের কারণে যা প্রত্যন্ত সমাজে গৌন ধর্ম আকারে পশ্চাদাপসারণ করে। [চলবে]


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.