একদিকে চলেছে অমর একুশের বই মেলা ওপর দিকে চলছে ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানানোর নানামুখী আয়োজন আর অপর দিকে সুনামগঞ্জের হাওর পাড়ের প্রত্যন্ত গ্রামের ছোট ছোট শিশুরা জানেনা শহীদ দিবস আর শহীদ মিনারই বা কি? মহান ভাষা আন্দোলনের এ দিন টি কে তারা বছরের অন্যান্য উৎসবের দিন বলেই মনে করে। কারণ আনন্দ উৎসবের দিনই তাদের স্কুল বন্ধ থাকে। একুশ ফেব্র“য়ারী নিয়ে কথা হয় ধর্মপাশা উপজেলার উত্তর বংশীকুন্ডা ইউনিয়নের খিদিরপুর গ্রামের ৪র্থ শ্রেণীর ছাত্রী নাজমা আক্তারের সাথে ছোট্ট নাজমা অবাক হয়ে যায় একুশের কথা বলতেই। সে জানায় যে স্কুলে সে পড়াশুনা করে সেখানে কোন শহীদ মিনার নেই। শিকরা শ্রেণীকে একটি গদবাধা নোটিশ পড়ে বলেদেন আগামীকাল স্কুল বন্ধ ব্যাস শিক্ষার্থীরাও ঐদিন আর স্কুলে আসে না।
এভাবে নীরবে নিভৃতে পেরিয়ে যায় অমর একুশ। এর কারণ অনুসন্ধানে জানা যায়, হাওর পাড়ের গ্রাম গুলোতে যে প্রাথমিক স্কুল রয়েছে তাদের কোনটিতেই শহীদ মিনার নেই। গ্রামের সচেতন যুবসমাজ বাঁশ,কাঠের চেয়ার ইটের ভগ্নাংশ দিয়ে একটি অস্থায়ী শহীদ মিনার তৈরী করে ভাষা শহীদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করে থাকে। বেশ কয়েকটি গ্রামের যুবকদের কথা বলে জানা গেছে কোন কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকাও অর্ধনমিত করে উত্তোলন করা হয়না। স্কুলঘরে ঝুলে থাকে মোটা তালা।
২১ ফেব্রুয়ারীর সরকারী ছুটির দিনটি শিক্ষার্থীরা অন্যান্য স্বাভাবিক দিনের মতো খেলাধুলা ও ঘর-গৃহস্থালি কাজকর্ম করে কাটায়। সুনামগঞ্জের প্রত্যন্ত হাওর এলাকার গ্রামগুলোতে সরকারি-বেসরকারি, এনজিও সব মিলিয়ে প্রায় ৭/৮শ প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের কোনোটিতেই কোনো শহীদ মিনার নেই। হতদরিদ্র পরিবারের শিশু-কিশোররা স্কুলে লেখাপড়ার পাশাপাশি বাড়িতে কাজ করে সময় কাটায়। ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পাঠ্য বই পড়ে তারা ২১ ফেব্রুয়ারী সম্পর্কে জানতে পারে।
তাও পরীক্ষার পর আবার ভুলে যায়। শহীদ মিনার না থাকলেও অমর একুশে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে শহীদ মিনারের অভাবে তারা দিনটিকে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করতে পারে না কিন্তু মন থেকে ঠিকই শ্রদ্ধা জানায়। প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা আর সুষ্ঠুতদারকীর অভাবে হাওর এলাকার কোমলমতি ছাত্রছাত্রী অনেকটা নীরবেই পার করে।
হাওরাঞ্চলের শিক্ষার্থী হতদরিদ্র পরিবাররের প্রতিনিধি। তারা স্কুলে পড়াশুনা করার চেয়ে জমিতে চাষাবাদ করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।
কেউ কেউ খালেবিলে মাছ ধরে, রাখালের চাকরি করে জীবিকা নির্বাহ করে। বাবা-মা চায় তাদের ছেলেমেয়ে আয়-রোজগার মূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাক। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস,৫২-র ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর তেমন কোনো ধারণা নেই। তারা জানায়, পাঠ্য বইয়ে বরকত, সালম, রফিক, শফিক, জব্বার নাম জানলেও শহীদ মিনার কী জিনিস তারা চেনা না ।
গ্রামে এই বিশেষ দিনটিতে শহরের মতো কোনো প্রভাতফেরী, আলোচনাসভা সেমিরনার, কোনো কিছুই হয় না।
যাদের আশপাশে গ্রাম্য হাটবাজার রয়েছে তারা এসব দিবস কোনো রকমে নামকাওয়াস্তে পালন করে থাকে। তারা বাজারের পাশে অই দিনটি অস্থায়ী শহীদ মিনার তৈরি করে মুষ্টিমেয় কিছু লোক ও ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ অর্পণ করে থাকে। সকাল গড়িয়ে বিকেল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অস্থায়ী শহীদ মিনারটি অস্তিত্ব এক বছরের হারিয়ে যায়।
যদি কোনো শিক্ষার্থী ২১-এর প্রভাত ফেরীতে অংশ নিতে চায় তাহলে তাকে ৪/৫ মাইল দূরে হেঁটে গিয়ে অন্য এলাকার কোনো শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শহীদরে স্মৃতির উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা নিবেদন করে। হাওর এলাকার স্কুলগুলোর সার্বিক অবস্থা অনেকটা প্রাকৃতিক কারণেই বেহাল।
প্রতি বছর বন্যা, ঝড়তুফান হাওরের উত্তাল ঢেউ মারাত্মকভাবে তিগ্রস্ত করে স্কুলের অবকাঠামো। এরকম প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মধ্যে শহীদ মিনার তৈরির কথা তারা মাথায় আনতে পারে না। আবার কোনো কোনো স্কুলে বিশাল খেলার মাঠ রয়েছে কিন্তু শহীদ মিনার নেই। এর বিপরীত অবস্থাও রয়েছে হাওর এলাকায়। কোথাও শুধু স্কুল ভবনের বাইরে অতিরিক্ত কোনো স্থান নেই শহীদ মিনার তৈরির জন্য।
সরকার ১৯৭৩ সালে সারা দেশের সঙ্গে হাওর এলাকার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো সরকারিকরণ করেছে কিন্তু সরকারিকরণের প্রায় ৩৭ বছর পেরিয়ে যাচ্ছে তবুও দেশপ্রেমের চেতনা জাগাতে কোনো শহীদ মিনার তৈরির উদ্যোগ নেয়নি। যে কয়টি স্কুলে শহীদ মিনার তৈরি করা হয়েছে তাও স্থানীয় উদ্যোগে। হাওর এলাকার মাধ্যমিক স্কুলগুলোতে গুটিকয়েক শহীদ মিনার রয়েছে।
এছাড়া উপজেলা সদরগুলোতে আড়ম্বর করে জাতীয় দিবস পালিত হয় যার বাতাস হাওরপাড়ের বিছিন্ন গ্রামের এক কোণে পড়ে থাকা প্রাইমারি স্কুলগুলোতে লাগে না।
ধর্মপাশা উপজেলার দণি বংশীকুণ্ডা ইউনিয়নের দক্ষিণউড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবঃ শিক্ষক আব্দুল মালেক বলেন, তাদের স্কুলে কোনো শহীদ মিনার নেই উৎসাহী শিক্ষার্থীরা ৩ কিলোমিটার পথ পারি দিয়ে অন্য একটি স্কুলে গিয়ে শহীদ মিনারে ফুল দেয়।
দিনের পর দিন এভাবে চলতে থাকলে হাওর পাড়ের জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে অমর একুশের চেতনা হারিয়ে যাবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।