আমি নিজেকে একজন উদারপন্থী হিসেবে দাবি করতেই পারি। কেউ কেউ বলবেন উদারতা মানে কাপুরুষতা। কারন আপনি দুর্বলতা ঢাকতে চাচ্ছেন। আবার কেউ চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে, ঐ যে উদারতার নিচে দুর্বলতা উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। উগ্রপ্রন্থী হতে সাহস লাগে।
এতদিন পরে এসে মনে হয় সত্যই আমি কাপুরুষ। কি একটু সাহসী মনে হচ্ছে? নিজেকে কাপুরুষ হিসেবে স্বীকার করতেও তো সাহস লাগে। তাই না? যাইহোক দীর্ঘদিন বুকে চেপে থাকা পাথর আজকে সরাতে চাই।
আজ থেকে বেশ কিছু বছর আগের ঘটনা। ২০০৫ সাল।
আমি কেবল মাধ্যমিক পাস করেছি। সেবার আমাদের এলাকায় ঐ সালে যারা বিভিন্ন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন তাদেরকে নিয়ে এক সংবর্ধনা ও পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। আয়োজন জোরেশোরে শুরু হল। কেননা প্রধান অতিথি হল সংসদ সদস্য। আরও কত বড় বড় মানুষ আসবেন তার ঠিক নেই।
বিশিষ্ট ব্যক্তি বর্গের বক্তব্য নিয়ে একটি প্রস্তাবিকা বই প্রকাশিত হল। আমার ছোট্ট একটি লেখা সেখানে ঠাই পেল। আমার আনন্দ দেখে কে!
ধিরে ধিরে দিনটি কাছে আসতে লাগল। সেই বিশেষ দিনটি হল ১৬ই ডিসেম্বর। আমাদের মহান বিজয় দিবসের দিন।
আমার দেশ, আমার মা যেমন এই দিনে স্বীকৃতি লাভ করেছিল, আমিও আমার প্রথম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার স্বীকৃতি লাভ করবো। আমি আরেকটু দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়েছি। মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের পক্ষ থেকে আমাকে বক্তব্য দিতে হবে। আমি প্রগাঢ় আনন্দে দিনটির অপেক্ষা করতে লাগলাম।
অবশেষে এল সেই মহেন্দ্রক্ষন।
আমি পরিপাটি হয়ে গেলাম অনুষ্ঠানের মাঠে। সবাই প্রায় এসে পরেছে। অপেক্ষা শুধু এম.পি সাহেবের। তিনি এলেন অবশেষে। এখানে তাকে উল্লেখ করা অবশ্য কর্তব্য মনে করছি।
তিনি হলেন বাংলাদেশের বিশেষ একটি রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় নেতা । তিনি বোধহয় শুরা পান করেন না, তবুও শুরা সদস্য। আহা কী মায়াভুলানো মুখ! আর কী সফেদ দাড়ি! সেই দাড়ির গোরায় বিশেষ কিছু খেলা করছিল কিনা আমার জানা নেই।
অনুষ্ঠান শুরু হল। আমি মঞ্চের সামনের দিকে বসে আছি।
কী বক্তব্য দিব তা মনে মনে গুছাচ্ছি। আর দোয়াদরুদ পড়ছি সব যেন গুলায়ে না যায়, পা দুটো যেন ঠিক থাকে।
এতক্ষণ কারও বক্তব্য মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম না। হঠাৎ ভীষণ অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম কেও বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা জানাচ্ছে না। আজ যে বিজয় দিবস তাও উল্লেখ করছে না।
কোন বক্তাতো নয়ই এমনকি উপস্থাপকও নয়। আমি পুরা টাসকি খেলাম। বার বার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে নিশ্চিত হলাম আজই ১৬ই ডিসেম্বর। এখন আমি কী করি। আমি তো ঠিক করে রেখেছি বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা দিয়ে আমার বক্তব্য শুরু করবো।
বেশ কিছু সময় পর আয়োজক দের একজন আমাকে ডেকে পাঠালেন। বললেন, ‘তোমার বক্তব্য দেবার সময় আজ বিজয় দিবস উল্লেখ করার দরকার নেই। ’
আমি বললাম, ‘কেন? আজ তো বিজয় দিবস। ’
‘দেখ কত বড় বড় জ্ঞানীরা বলছে না। তুমি বলবে কেন? তুমি তো ওদের মত জ্ঞানী না।
তাই না?’
আমি বললাম, ‘হু’
তিনি আমাকে চমৎকার করে বুঝিয়ে দিলেন। আমি তো নিতান্ত বালক। উনারা না বললে আমার বলা ঠিক না। এতে পাপ হতে পারে।
এবার আমার ডাক পড়ল মঞ্চে।
আমি ধীর লয়ে মঞ্চে উঠলাম। কারও মুখের দিকে তাকালাম না। অতঃপর একসময় আমার লজ্জাস্কর ও ক্লান্তিকর বক্তব্য শেষ করলাম। না, মায়ের বিজয়ের কথা বলতে পারলাম না। যখন মঞ্চ থেকে মাটির দিকে তাকিয়ে নামছিলাম তখন মাটি যেন কথা বলে উঠল।
‘কিরে ব্যাটা মাকে অস্বীকার করতে পারলি?’
আজ চিৎকার করে কেঁদে বলতে ইচ্ছা করছে, ‘মাগো আমায় মাফ কর, তোমার কাপুরুষ ব্যাটাকে মাফ কর। ’
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।