সত্য কাঁদে নিভৃতে, সাথে তার থাকে শুধু মহাকাল। সত্যের দীপশিখা চিরদিন জ্বলে । সত্য কখনো মিথ্যাকে করে নাকো ক্ষমা।
১।
বাবা আমাকে বাঁচাও।
ওরা আমাকে মেরে ফেলছে, বাবা............ বাঁচাও ... আমাকে.........। বাঁচাও...............
নাআ......... না না তোকে কেউ মারতে পারবেনা বাবা, না না...
ঘুমের ঘোরে চিৎকার করে উঠল রঞ্জু। পাশে শুয়ে থাকা তার বউ লোনা বলছিল কি হয়েছে তোমার? এই স্বপ্ন দেখেছ মনে হয়। পানি খাবে? লোনা উঠে গিয়ে পানি এনে দিল। রঞ্জু পানি খেল।
খুব ভয় পেয়েছে রঞ্জু, ঘেমে গিয়েছে। লোনা ফ্যানের স্পীড বাড়িয়ে দিল। রঞ্জু কি দেখেছ স্বপ্নে? এত ভয় পেয়েছ তুমি। রঞ্জু বলল না কিছুনা। শুয়ে পড়।
সে রাতে আর রঞ্জুর ঘুম হলনা। বার বার মনে হচ্ছে ছোট্ট সোনামণিটা কে? আমাকে বাবা বলে ডাকল। কে তাকে মেরে ফেলল?
সকালে লোনা উঠেই নাস্তা রেডি করে রঞ্জু কে ডাকছিল। এই রঞ্জু উঠো আজ কাজে যাবেনা? রঞ্জু সকালের দিকে ঘুমিয়েছিল। বলল লোনাকে আর একটু পড়ে উঠব।
নিজের ব্যবসা দেরি করে গেলে সমস্যা নেই । আমি আর একটু ঘুমাবো লোনা। প্লিজ আমাকে ডেকনা। আচ্ছা ঠিকাছে ঘুমাও তুমি।
লোনা আর রঞ্জুর ছোট্ট সংসার।
রঞ্জুর বাবা- মা বেঁচে নেই। তাই ওদের সংসার বলতে দুটি মানুষ। বিয়ের পাঁচ বছর হয়ে গেছে ওদের কোন বাচ্চা নেই। বাচ্চা নেই বলতে ওদের বাচ্চা হচ্ছেনা। প্রথম প্রথম রঞ্জু গুরুত্ব না দিলেও এখন খুব অনুভব করে একটা বাচ্চার।
তাই ইদানিং বেশ ডাক্তারের শরণাপন্ন হচ্ছে। দুজেনেরই বেশ কিছু টেস্ট করানো হয়েছে কিন্তু কোন কিছু ধরা পরেনি। কেন বাচ্চা হচ্ছেনা সেটা বোঝা যাচ্ছেনা।
ডাক্তার সুমা ওদের পরিচিত । এদিকে সুমা উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশ যাচ্ছে।
তখন নিজে থেকেই বলল কিছু মনে করো না তোমারা অন্য কাউকে দেখাও। আমার পরিচিত বড় একজন ডাক্তার আছেন। আমি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। লোনা মন খারাপ করল। সুমা লোনা কে বুঝাল।
মন খারাপ করোনা লোনা। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি আসলে তোমাদের কোন প্রব্লেম দেখছিনা। তারপরও যেহেতু আমি দেশে থাকছিনা তানাহলে আমিই সব কিছু আরো ভালো করে দেখতাম। আমি চাই তোমারা আরো চিকিৎসা করো।
মন খারাপ করে চিকিৎসা বন্ধ করে দেয়ার কোন মানে হয় না।
২।
আজ বিকেল বেলায় রঞ্জু আর লোনা ডাক্তারের কাছে গেল। সুমাই সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। তাই প্রব্লেম হলনা ডাক্তারের সাথে দেখা করতে।
ডাক্তার সব কিছু দেখে কিছু টেস্ট দিল দুজনেরই। ডাক্তার দেখানো শেষ হলে রঞ্জু বলছিল লোনাকে চল আজ ফাস্ট ফুডে কিছু খাই। লোনা মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। ওরা ফাস্ট ফুডের একটা দোকানে বসল। খাবারের অর্ডার দিল।
লোনা বলল তোমার কি মনে হয় এবার আমরা আশার আলো দেখব। রঞ্জু একটু চুপ থেকে বলল অবশ্যই। তুমি শোনো নাই সুমা কি বলেছিল? আমাদেরতো কোন সমস্যা নেই। ডাক্তার ঔষধ ঠিক মত দিলেই দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে। মন খারাপ করো নাতো?
খাবার চলে আসল।
ওরা খেতে লাগল। খাওয়ার ঠিক শেষ মুহুর্তে একটা ছেলে রঞ্জুর কাছে এসে বলল
- আরে রঞ্জুনা? কেমন আছিস? সাথে ভাবী নাকি?
- রঞ্জু তাকিয়ে দেখে ওর কলেজের বন্ধু আনিস। দেখেই মুখটা
কেমন জানি ফ্যাঁকাসে হয়ে গেল। কেমন আছিস আনিস?
-হুম ভালতো। অনেকদিন পর দেখা।
তোরতো কোন খোঁজই পাচ্ছিলাম না। হটাৎ করেই হারিয়ে গেলি। আর খুজে পেলাম না। একেই বলে ভাগ্য। ভাগ্যে থাকলে দেখা হবেই।
কি বলিস?
রঞ্জু একটু শুকনো হাসি দিল। লোনার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল আনিসের।
-রঞ্জু তোর নাম্বারটা দে। এক্ষুনি দে। পড়ে আবার হারিয়ে যাবি।
আর হারাতে পারবিনা দোস্ত। এখন কি করিস তুই? কোথায় আছিস?
রঞ্জু পকেট থেকে কার্ড বের করে দিল। বলল এটা আমার নাম্বার। আর কি করি সেটাও লেখা আছে। রঞ্জু বিল চুকিয়ে দিয়ে বলল আজ
অনেক তাড়া আছেরে, আজ উঠি ।
পড়ে আবার কথা হবে বলেই লোনা কে তাগাদা দিল উঠার। লোনা কিছুটা অবাক হল। কারন কোন তারা ওদের ছিল না।
-এখনি উঠবি আচ্ছা। আমি ফোন দিব।
ভালো থাকিস। ভালো থাকবেন ভাবি।
লোনা বিদায় নেয়ার সময় বলল ভাই বাসায় বেড়াতে আসবেন। আর এ কোথা শুনে রঞ্জু কটমট করে তাকাল লোনার দিকে।
বাইরে এসে লোনা জিজ্ঞেস করল রঞ্জুকে কি হয়েছে তোমার? এতো তাড়াহুড়ো করছ কেন? উচ্চস্বরে বলল রঞ্জু কোথায় তাড়াহুড়ো করলাম? আর আমার একটা কাজের কথা মনে পড়েছে।
লোনাকে সিএনজি ভাড়া করে উঠিয়ে দিল । লোনা বলল তুমি যাবেনা? বললাম না আমার কাজ আছে তুমি যাও পরে আসছি। লোনা আর কথা বাড়ালনা।
৩।
কয়দিনের জন্য লোনা বাবার বাড়ি গেল।
একা একা রঞ্জু বাসায়। রাতে বাসায় এসেই রান্না করে খেল রঞ্জু। ঘুমানোর জন্য বিছানায় গেল আর ওমনি লোনার ফোন।
-হ্যালো রঞ্জু বাসায় এসেছ?
-হুম আসছি।
-কি খেলে?
- ভুনা খিচুড়ি আর ডিম ভাজি।
-আচ্ছা।
-লোনা আমি খুব ক্লান্ত আমি এখন ফোনটা রাখব। তুমি খেয়ে ঘুমাও। কাল কথা হবে ওকে?
লোনার মন খারাপ হল। বলল আচ্ছা ঠিকাছে।
এভাবে কখনো রঞ্জু কথা বলেনা কিন্তু আজ এমন কেন বলল?
বাবা আমাকে বাঁচাও বাবা.........। আমাকে কি তুমি মেরে ফেলবে? তুমি কেমন বাবা? কেমনা বাবা তুমি? আমাকে বাঁচাতে পারো না? এই বলে শিশুটি কাঁদতে লাগল। সেই কান্নার আওয়াজ এতটাই মর্মান্তিক যে পাথর হৃদয়ও গলে যাবে কান্নাটা শুনলে।
রঞ্জুর ঘুম ভেঙ্গে গেল। কানে বার বার কান্নার আওয়াজটা বাজতে ছিল।
আমাকে বাঁচাও .........বাবা......... আমাকে মেরো না.........।
রঞ্জু কান দু হাত দিয়ে চেপে ধরল। না না এটা কার কন্ঠ? কে কাঁদে? বন্ধ করো প্লিজ তোমরা কান্না বন্ধ করো। হটাৎ ঘড়ির ঢং ঢং আওয়াজ হল। তাকিয়ে দেখল রঞ্জু ঠিক ২টা বাজে।
এখন আর শব্দটা শুনছেনা। উঠে গিয়ে পানি খেল। ঘেমে গেছে। আয়নায় নিজের চেহেরাটা দেখল। নিজেকে এতো অপরাধী লাগছে কেন? কেন? রাতে আর ঘুম হলনা।
বেলা বারটায় কর্মচারীর ফোনে ঘুম ভাঙল রঞ্জুর।
-স্যার আপনি আসবেন না আজ ?
- হুম আসব। একটু দেরি হবে মতিন সাহেব। আপনি একটু দেখবেন সবকিছু প্লিজ।
- জ্বি স্যার।
রঞ্জু উঠে ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে গেল। বাইরে এসে সিগারেট ধরাল। মাথাটা কেমন জানি ঝিম ঝিম করছে। একটুও শান্তি পাচ্ছেনা। একটা স্বপ্ন নিয়ে মন খারাপের কি আছে মন কে বুঝায় রঞ্জু কিন্তু মন বুঝেনা।
একটা স্বপ্ন রঞ্জুর অস্থিরতা বাড়িয়ে দিচ্ছে, তার মনটাকে বিষিয়ে দিচ্ছে। দিনের বাকি সময়ে কাজে মন বসাতে পারনা। দিন শেষে রাতে বাসায় ফিরে। সারাদিন লোনার সাথে যোগাযোগও হয়নি রঞ্জুর। কাল রাতে লোনার সাথে খারাপ আচরন করেছিল নিশ্চয়ই লোনা মন খারাপ করে আছে।
ফোন হাতে নিয়েও কেন জানি ফোন দিতে ইচ্ছে হল না রঞ্জুর।
রঞ্জুর ফোনটা হটাৎ বেজে উঠল।
-হ্যালো
- রঞ্জু আমি আনিস।
- ওও।
-কেমন আছিস রঞ্জু?
-এইতো আছিরে ভালো।
তুই কেমন আছিস?
- হুম ভালো। তোর কন্ঠ এমন শুনাচ্ছে কেন? তুই কি অসুস্থ?
-না, এমনি । তোর কথা বল। কি করিস?
-ব্যাংকে আছি। বিয়ে করেছি, এক বাচ্চার বাপ হয়ে গেছি।
হাহাহা
আনিসের হাসির শব্দটা রঞ্জুর কাছে একদম কাঁটার মত বিধল। মনে হল ওকে পরিহাস করে হাসছে আনিস। আনিস ওপাশ থেকে বলছিল
আমার ছেলেটা যা দুষ্ট । আমার ছেলেই এখন জীবন আমার। আমাদের সংসারে মধ্যমনি।
যাক, টু হটাৎ করেই হারিয়ে গেলি।
-সেই যে রেনু মারা যাওয়ার পর তুই হারিয়ে গেলি আর কোন
যোগাযোগ করলিনা। তোর নাম্বারে অনেক ফোন দিয়েছি। কিন্তু নাম্বার দেখি বন্ধ।
রেনুর নামটা শুনেই বুকের ভেতরটা রঞ্জুর কেমন করে উঠল।
মাথাটাও মনে হচ্ছে ঘুরছে। ফোনের ওপাশ থেকে আনিস কি বলছে রঞ্জুর মাথায় আর ঢুকছেনা। কোন উত্তর দিতে পারছেনা রঞ্জু। রঞ্জুর সাড়া শব্দ না পেয়ে আনিস হ্যালো হ্যালো করল অনেক্ষন।
৪।
রাতে আবারো সেই স্বপ্নটা দেখল রঞ্জু। ভীষণ ভয় পেল। ভয় পেয়েই লোনাকে ওত রাতেই ফোন দিল। লোনা লোনা বলে কাঁদল কিছুক্ষন।
লোনা বার বার জিজ্ঞেস করছিল কি হয়েছে।
কিন্তু রঞ্জু কিছু বলতে পারেনা। সকাল বেলায় লোনা এসে হাজির। অনেকক্ষন ধরে কলিং বেল বাজাল। লোনা ভয়ে শেষ হয়ে গেল। কি হল রঞ্জুর? রঞ্জুর ফোনে কল দিল তারপর রঞ্জু দরজা খুলল।
- কি হয়েছে রঞ্জু? কথা বলছ না কেন?
- আমি রাতে খারাপ স্বপ্ন দেখেছি।
- ও আচ্ছা। কি স্বপ্ন দেখেছ?
- লোনা ইদানিং একটা স্বপ্ন দেখি খুব বেশি। দেখি একটা ছোট বাচ্চা এসে আমাকে বাবা বাবা বলে ডাকে।
- ও এই কথা।
আসলে আমরা ইদানিং বাচ্চা নিয়ে বেশি ভাবছিতো তাই এমন হচ্ছে। চিন্তা করোনা। আমাদের একটা বাবু হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
রঞ্জু উত্তর দেয়
–না হবে না। কিচ্ছু ঠিক হবে না।
-কি বলছ এসব রঞ্জু? আমিতো কিছুই বুঝতেছিনা।
- না কিছু না লোনা। আমাকে এক কাপ চা করে দাও।
-আচ্ছা দিচ্ছি।
রঞ্জুর রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেল।
প্রতিদিন সে স্বপ্ন দেখতে লাগল। একি স্বপ্ন ঘুরে ফিরে বার বার দেখে। রঞ্জুর আচরনে অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়। লোনার সাথে ঠিকমত কথা বলেনা, খায় না। মানসিকভাবে খুবই বিপর্যস্ত।
-রঞ্জু তোমার কি হয়েছে? তুমি এমন আচরন কেন করছ?
- কি আচরন করছি? আমি ঠিক আছি। আমাকে নিয়ে তোমার ভাবতে হবেনা।
- ভাবতে হবেনা মানে কি? তোমার কি হয়েছে সেটা আমাকে বলো, দুজন মিলে সমাধান করি।
- কিছু হয়নি আমার।
- রঞ্জু তুমি কছু একটা লুকাচ্ছ আমার কাছ থেকে।
আমি ঠিক বুঝি বুঝছ? আমি তোমার জীবন সঙ্গী না? তবে আমাকে কেন কিছু বলছ না?
-প্লিজ লোনা আর কথা বাড়িও না, আমার ভালো লাগছেনা।
লোনা খুব টেনশনে পড়ে যায় রঞ্জুর আচরণে। লোনা ওর এক বান্ধবীর সাথে সব কিছু শেয়ার করে। ওর বান্ধবী মানসিক বিশেষজ্ঞ দেখাতে বলে। কিন্তু লোনা বুঝেনা কিভাবে বলবে রঞ্জুকে কথাটা।
রাতে খাবার টেবিলে রঞ্জুকে লোনা বলতে চেষ্টা করে।
- রঞ্জু কিছু কথা ছিল তোমার সাথে
- হুম বল
- রাগ করবেনাতো
- রাগের কথা হলেতো রাগ করবই তাইনা?
- তুমি এভাবে চেঁচিয়ে কথা বলছ কেন?
- কোথায় চেঁচিয়ে কথা বললাম?
- ওকে আমি যা বলতে চাচ্ছি তা হচ্ছে আমার মনে হয় তোমার মানসিক ডাক্তার দেখানো উচিত।
- হুয়াট? তোমার কি ধারনা আমি পাগল হয়ে গেছি?
- না আমি তা বলিনি?
- তাহলে?
- তুমি যেসব আচরন করতেছ তা মানসিক রোগির কাতারেই পড়ে। আমার সাথে তুমি এখন ভালো করে কথা বলনা, একসাথে খাও না, রাতে ঘুমাও না। তারপরও কি তুমি বলবে তুমি অসুস্থ না? তোমার কিছু হয়নি? সারা রাত তুমি ছাঁদে পায়চারী করো , সিগারেট খাও।
ভাবছ আমি কিছু বুঝিনা, দেখিনা?
এতো কিছু শুনে রঞ্জু চুপ হয়ে গেল। না খেয়েই উঠে গেল। আর লোনা বসে বসে কাঁদতে লাগল।
দুজনেই না খেয়ে শুয়ে পড়ল। রাতে আর লোনার ঘুম হল না।
অনেক রাতে রঞ্জু রেনু রেনু বলে চিৎকার করল ঘুমের ঘোরেই। সকাল বেলায় রঞ্জু ঘুম থেকে উঠার পর লোনা জিজ্ঞেস করল
- রেনু কে?
- কে মানে? কে আমি কি জানি?
- মিথ্যে বলবে না রঞ্জু। তুমি কাল রাতে ঘুমের ঘোরেই রেনু রেনু
বলে কেঁদেছ কিন্তু কেন? কে রেনু? তোমার বউ পাশে থাকা সত্ত্বেও তুমি অন্য একজন নারীর নাম ধরে ডাকছিলে?
- লোনা বস মাথা গরম করোনা প্লিজ।
- না আগে বল রেনু কে?
- বলছি সব বলছি। প্লিজ তুমি সোফাটায় আরাম করে বস।
লোনা তোমাকে বলা হয়নি কলেজ জীবনে আমার একটা মেয়ের সাথে প্রেম ছিল। ওর নাম রেনু ছিল। বিশ্বাস করো ওর বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর আমি ওকে ভুলে গিয়েছি। আমি এখন তোমাকেই ভালোবাসি। আমি জানিনা রাতে কি হয়েছে কিভাবে ওর নাম আমি বললাম, প্লিজ লোনা আমাকে মাফ করে দাও।
লোনা চুপ করে থাকে কিছু বলেনা।
৫।
হটাৎ সেদিন লোনার সাথে আনিস সাহেবের দেখা হয়ে যায়। আনিস তার বউ বাচ্চা নিয়ে লোনাদের বাসার কাছ দিয়েই যাচ্ছিলেন। তাই দেখে লোনা জোর করে বাসায় নিয়ে আসে।
বেশ আপ্যায়ন করে লোনা। এ কথা সে কথার পর আনিসের বউ লোনাকে খুব করে বলে একদিন তাদের বাসায় বেড়াতে যেতে । লোনা বলে আচ্ছা ফোন করে যাব। ওহ আনিস ভাই আপনার নাম্বারটাতো নেই, দিয়ে যান নাম্বারটা । ভাবির সাথে কথা বলতে পারব মাঝে মাঝে।
আনিস নাম্বারটা দিয়ে যায় লোনাকে।
রঞ্জুর স্বপ্ন দেখাটা বাড়তেই থাকে। রঞ্জুর সব শান্তি চলে গেছে। সে ভাবতে থাকে একটা বাচ্চা ছেলে বাবা বাবা বলে ডাকে তাকে। এত মায়া কেন লাগে? বাচ্চাটা এও বলে সেই নাকি বাচ্চাটাকে মেরে ফেলেছে।
নানা আমিতো মারিনি। তবে কেন এসব বলে সে? চিন্তা করে কোন কুল কিনারা খুজে পায়না রঞ্জু।
রাস্তায় কোন ছোট বাচ্চা দেখলে তার খুব আদর করতে ইচ্ছে করে। কোলে তুলে নিতে ইচ্ছে করে। তাহলে কি সে মানসিক ভারসাম্য হারাতে বসেছে? কেন তার মনের ভেতর এত যন্ত্রণা হয়।
কেন কোন কিছু ভালো লাগেনা তার? লোনার প্রতি আগের মত ভালবসাটা কাজ করেনা। ইদানিং খুব বেশি রেনুর কথা মনে পড়ে। রেনু আমাকে ক্ষমা করো, প্লিজ ক্ষমা করো। রঞ্জু কাঁদতে থাকে।
৬।
আলমারির পুরানো জিনিস গুছাচ্ছিল লোনা, রঞ্জুর কিছু প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছিল সেখানে। গুছানোর এক পর্যায় নীল রঙের একটা খাম দেখে লোনা। খামের ভেতর একটা চিঠি দেখতে পেল । কৌতূহলবশত লোনা চিঠিটা খুলে পড়তে শুরু করে –
প্রিয় রঞ্জু,
তোমাকে দেবার মত আর ভালোবাসা আমার নেই। আশা করি ভালই আছ।
ভালো না থাকলেও এখন থেকে ভালো থাকবে। আমি হয়ত ভিক্ষুক ছিলাম তোমার কাছে। নাহয় হলাম ভিক্ষুক, ভিক্ষা চেয়েছিলাম তোমার কাছে শুধুই ভালোবাসা। কত আকুলতা, এতো ব্যাকুলতা সবকিছুই তুচ্ছ তোমার কাছে । হয়ত আমাকে ভালবাসাটা ভিক্ষাও দেয়া যায় না।
ভিক্ষাতো চাইনি আমি। ভালোবেসেছিলাম দুজনেই। আর আজ আমি তবে কেন ভিখারিনী ? কি অদ্ভুত! তোমার বিন্দু পরিমান আফসোস নেই। কত কাছে এসেছিলে তুমি কিভাবে পারলে এতটা দূরে সরে যেতে?
এক দুপুরের নির্জনতাকে খুন করেছিলাম। রোদ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ছুটে যেতাম তুমি-আমি।
অদ্ভুত কোন বায়না ধরিনি তোমার কাছে কখনও। ছোট্ট চাওয়া ছিল সেটাও পূরন করতে পারনি তুমি। ঘাসের বুকে শিশির যখন পড়ে তখন তা বেশ চকচক করে। কিন্তু রোদ্দুরে সেই শিশির শুকিয়েও যায়। খনিকের শিশিরের মত তোমার কাছেও ভালবাসাটা ছিল ক্ষনিকের।
একটা বিশ্বাসের হাত ধরেই বদ্ধভূমিতে গিয়েছিলাম । আজ তামাম দুনিয়া আমাকে ছিঃ ছিঃ করবে। অথচ তুমি নেই আমার পাশে। খুব চেনা মানুষগুলো এভাবেই বদলে যায় হয়ে যায় অপরিচত, তাইনা?
তুমি কি মুক্তি পাবে আদৌ? পাবেনা , কোনদিন পাবে না। প্রকৃতির প্রতিশোধ আছে।
সে তার আপন নিয়মেই প্রতিশোধ নিবে। আমি মুক্তি দিলেও প্রকৃতি তোমায় মুক্তি দিবেনা কোনদিন মনে রেখো। সারাজীবনের জন্য তোমায় মুক্তি দিলাম। আর কোনদিন কেউ তোমার কাছে এসে বলবেনা স্বীকৃতি দাও আমাদের সন্তানের। একবুক ঘৃণা নিয়ে চলে যাচ্ছি।
আমার অনাগত সন্তান তোমাকে কোনদিন ক্ষমা করবেনা কোনদিন না রঞ্জু।
চিঠিটা এই পর্যন্ত পড়ে লোনার মাথা ঘুরাতে লাগল। একি পড়ছে সে? কিছুই বিশ্বাস হতে চায়ছে না। তারপরও চিঠিটা পড়তে হবে লোনার আবার শুরু করল.........।
কত ভালবেসেছিলাম তোমায়।
কত বিশ্বাস করেছিলাম। স্বপ্ন দেখেছিলাম সুন্দর একটা জীবনের , সুন্দর একটা সংসারের। তুমি আমার সন্তানকে হত্যা করতে চাও? তুমি পুরষ নামের কলঙ্ক। তুমি একটা কাপুরুষ। আমি তোমাকে ঘেন্না করি।
হ্যাঁ ঘেন্না করি। আমার বিশ্বাসের অমর্যাদা করেছ। এর শাস্তি তুমি পাবেই। অনেক বার তোমার কাছে হাত জোর করলাম , পায়ে পড়লাম, বিয়ে করলেনা। ভুল কি আমি একাই করেছি? তুমি করোনি? পাপী কি আমি একাই? তুমি পাপী নও? আমি তোমাকেই আমার স্বামী বলে গ্রহন করেছি।
রঞ্জু আমার বুকের ভেতরে কতটা যন্ত্রণা হচ্ছে তুমি বুঝবেনা। আমি এই ব্যথা সহ্য করতে আর পারছিনা। তোমার খারাপ আচরন আমি ভুলতে পারছিনা। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে তুমি সেই মানুষ একদিন যে আমাকে খুব ভালবাসতে। তুমি আসলে আমাকে ভালবাসোনি বেসেছ আমার শরীরটাকে।
ছিঃ! ঘেন্না লাগছে আমার। মানুষ অন্যায় করলে এর সাজা এই পৃথিবীতেই হয়। আমিও পাচ্ছি সাজা আর তুমিও পাবে একদিন। একদিন তোমারো ভুল ভাঙবে কিন্তু সেদিন আর কোন সুযোগ থাকবেনা তোমার। ক্ষমা হবেনা তোমার।
ক্ষমা হবেনা হে কাপুরুষ! হাহাহাহাহাহা..............................
আমি সেই রেনু
২২/০৫/২০০৯
লতা কি করবে কিছুই বুঝতে পারছিলনা । চিৎকার করে কাঁদল। তার স্বামী তাকে ঠকিয়েছে। এ কথা সে ভাবতেই পারেনা। হটাৎ আনিস ভাইয়ের কথা লোনার মনে পড়ল।
আনিস ভাইতো রঞ্জুর কলেজের বন্ধু। লোনা ফোন দিল আনিস কে।
- হ্যালো আনিস ভাই আমি লোনা
- হ্যা ভাবি কেমন আছেন?
- আনিস ভাই আপনার সাথে কিছু কথা আছে । আমি আপনার সাথে দেখা করতে চাই এখনি।
- আমিতো অফিসে সন্ধ্যায় ফ্রি হবো।
- আচ্ছা আমি ওই সময়ই আসব।
সন্ধ্যায় লোনা আনিসের সাথে দেখা করল।
-আনিস ভাই আমি কোন ভনিতা করতে পারবনা সরাসরি কথা বলতে চাচ্ছি।
-কি হয়েছে ভাবি? বলুন আপনি ভনিতা করা লাগবেনা। রঞ্জুর সাথে ঝগড়া হয়েছে?
- আনিস ভাই রেনু কে? আপনাদের বন্ধু ছিল নাকি?
প্রশ্নটা শুনেই মুখটা ফ্যাঁকাসে হয়ে গেল আনিসের।
এমন প্রশ্ন আশা করেনি আনিস। আনিস চুপ করে থাকল কিছুক্ষন।
-কিছু বলছেন না কেন আনিস ভাই?
আনিস উত্তর দিল- হুম বন্ধু ছিল।
-রঞ্জুর সাথে ওর কিসের সম্পর্ক ছিল?
- ওরা একে অপরকে ভালবাসাত।
- তারপর?
- তারপর আর কি?
- কেন ওদের মিল হলনা?
- জানিনা।
তবে...
- কি আনিস ভাই থামলেন ? রেনুর কি অন্য জায়গায় বিয়ে হয়ে গেছে? কিছু বলছেন না কেন? আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। এই উত্তরগুলো আমার জানা খুব জরুরী। ওর কি বিয়ে হয়ে গেছে?
- না
- তাহলে ও কোথায় আছে? প্লিজ আমাকে বলুন। রেনুকে আমার প্রয়োজন।
আনিস কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল
- ওকে খুঁজে আর কি লাভ বল? ওকে আর কোনদিনও খুজে পাওয়া যাবেনা।
- মানে? প্লিজ আনিস ভাই রহস্য করবেন না। আমি আর সইতে পারছিনা।
- আসল কথা শুনলে সইতে পারবেনা।
- মানে? রেনু কোথায় গেছে?
- রেনু আত্মহত্যা করেছ।
- ও মাই গড।
কি বলছেন এসব? লোনা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারেনা। ওর কাছে মনে হচ্ছিল পুরো দুনিয়াটা ঘুরছে।
- ভাবী ঠিক আছেনতো আপনি?
- লোনা নিজেকে সামলে নেয়। জ্বি ভাইয়া ঠিক আছি।
- আমরা কেউই জানিনা রেনু কেন আত্মহত্যা করল? তবে এটা জানি রঞ্জু এর জন্য দায়ী।
কারন রেনুর মৃত্যুর পর রঞ্জুকে আর খুজে পাওয়া যায়নি। একটা নীল খামে করে আমার কাছেই রেনু রঞ্জুকে চিঠি দিয়েছিল । সেটাই ছিল শেষ চিঠি। জানিনা সেই চিঠিটাতে কি লিখা ছিল।
- লোনা আর কিছু শুনতে চায় না।
বিদায় নিয়ে বাসায় চলে আসে। সারাটা পথ লোনা কাঁদতে কাঁদতে আসল। দুনিয়াটা ঘুরতে লাগল তার।
৭।
রাত ১০ টায় রঞ্জু বাসায় ফিরে।
বাসায় এসে দেখে লোনা ড্রয়িং রুমে বসে আছে সাথে লাগেজ । রঞ্জু কিছু বুঝে উঠতে পারেনা
- কি ব্যাপার লোনা? কোথায় যাও?
- আমি চলে যাচ্ছি। আর কোনদিন ফিরে আসবনা।
- কি বলছ এসব?
- হুম যা বলছি ঠিক বলছি। লজ্জা লাগেনা তুমি একটা মুখোশধারী
শয়তান, খুনী।
- কিসব বাজে কথা বলছ?
- অস্বীকার করতে পারো তুমি খুনী না?
- আমি কখন খুন করলাম? কি যাতা বলছ?
- আমি রেনুর চিঠিটা পরেছি। সব জেনেছি আমি। কেন সমস্যা না থাকার কারনে আমাদের বেবি হয়না এখন বুঝতে পারছি। তোমার পাপের কারনে। তুমি দুইটা জীবন খুন করেছ।
আমি তোমাকে ঘেন্না করি, ঘেন্না করি।
রঞ্জুর রেনুর কথাটা মনে পড়ে যায় । সেইম কথাটা রেনুও তাকে বলেছিল। রঞ্জু পাগলের মত হয়ে যাচ্ছে। কি বলবে লোনা কে? চারপাশ রঞ্জুর অন্ধকার হয়ে আসছে।
- লোনা প্লিজ তুমি চলে যেওনা আমি ভুল করেছিলাম তখন। আমি বুঝিনি।
-ভুল কিসের ভুল? একটা বার কি তুমি রেনুর কষ্টের কথা ভেবেছ? কি সময় পার করেছিল রেনু ভেবেছিলে? কতটা যন্ত্রণা বুকে নিয়ে সে আত্মহত্যা করেছে? তুমি মিথ্যুক। তুমি আমাকে মিথ্যা বলেছ। ভেবেছ আমি কোনদিন সত্য জানতে পারবনা? সত্য কখনো চাপা থাকেনা।
তুমি রেনুকে হত্যা করেছ। হ্যাঁ তুমিই। লোনার চোখ দিয়ে অশ্রুধারা বইতে থাকে। রঞ্জুও কাঁদতে থাকে।
- লোনা আমাকে ক্ষমা করো, ক্ষমা করো প্লিজ।
লোনা তার লাগেজ নিয়ে বের হয়ে আসে। রঞ্জু একবার লাগেজ টেনে ধরেছিল কিন্তু লোনা একটা ঝটকায় তা সরিয়ে নিয়ে আসে। বের হওয়ার আগের লোনা দরজায় দাঁড়ায় একটু চুপ করে থেকে রঞ্জুকে বলে
- ডিভোর্স লেটার শিগ্রই পেয়ে যাবে তুমি। টেনশন করোনা।
রঞ্জু লোনার চলে যাওয়ার পথে নির্বাক চেয়ে থাকে ।
চোখ বেয়ে অশ্রু বিন্দু পড়তে থাকে।
রাত গভীর হতে থাকে আর রঞ্জুর মনে হতে থাকে তাকে কেউ ডাকছে বাবা............ আমাকে বাচাও বাবা...............। । আমাকে মেরো না.........। ।
আমাকে বাচাও বাবা...............।
মানুষ যখন কোন অন্যায় করে, যখন কেউ কাউকে ঠকায়, মিথ্যে অভিনয় করে, মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে সেইসব মানুষের বিচার আল্লাহ নিশ্চয় করেন বা করবেন। মানুষ অন্যায় করে কখনো পার পায় কিনা জানিনা। তবে প্রকৃতি তার আপন নিয়মেই প্রতিশোধ নেয়। মিথ্যে অপবাদ দিয়ে আজ যারা খুশি হয়ত একদিন সেই অপবাদের সাজা নিশ্চয়ই তারা পাবে।
বিশ্বাসের অমর্যাদা করলে একদিন তাকে শাস্তি পেতে হবেই।
এই গল্পের মাধ্যমে ব্লগ থেকে আপাতত বিদায় নিচ্ছি। জানিনা আবার কবে আসব। তবে কিছুদিনের জন্য বিরতি চাচ্ছি ব্লগ থেকে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।