আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দাঁড়াতে হবে , এবং দায় নিয়েই



মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা সংলাপে বেরিয়েছেন। আজ ২০ জুলাই ২০০৮ রোববার তিনি সিলেট সফর করেছেন। বলেছেন , ভোট দিতে হবে ভেদ বিচার করে। জনগণকে দায় নিতে হবে। এদিকে বিবেচিত দুর্নীতিবাজরা একে একে জামিন পাচ্ছে।

সরে গেছেন এটর্নী জেনারেল । এসেছে নতুন মুখ। সবই যেনো কুয়াশায় ঢাকা। কি হবে? কি হতে যাচ্ছে ? তাহলে কি ১/১১ এর পূর্বেই ফিরে যাচ্ছে স্বদেশ ? উপদেষ্টারা এ বিষয়ে বলছেন না কিছুই। অন্যদিকে বাংলাদেশে ভেতরে ভেতরে সংগঠিত হচ্ছে সেই পরাজিত রাজাকার-আলবদর চক্র।

তাদের সামনে লক্ষ্য একটিই, একাত্তরে পরাজয়ের বদলা নেয়া। এদের কর্ম ও মানসিকতা দেখলে হতবাক হতে হয়। ভেবে অবাক লাগে, বেশকিছু মুখোশধারী ব্যক্তি এদের ইন জুগিয়ে যাচ্ছেন। এদের পুনর্বাসনে সাহায্য করছেন। দেশে ‘জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা পরিষদ’ নামে একটি সংগঠন জন্ম নিয়েছে।

সে সংবাদ অনেকেই জানেন না। জানার কথাও নয়। সম্প্রতি এই সংগঠনের একটি সমাবেশে গিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী আমান। তিনি ঢাকায় রংমিস্ত্রির কাজ করেন। কিন্তু সমাবেশে গিয়ে তিনি যখন দেখতে পান, সেখানে যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসনের ব্যর্থ প্রচেষ্টা হচ্ছে, তখনই গর্জে ওঠেন তিনি।

বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী যখন একটি টিভি চ্যানেলের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তখনই তার ওপর হামলে পড়ে একাত্তরের হায়েনার উত্তরসূরিরা। তাকে অপদস্ত করা হয় খুব অমানবিকভাবে। সে ছবি দেখেছি আমরা পত্রিকায়। কি জঘন্য মানসিকতা। কত চরম ধৃষ্টতা! যে ব্যক্তি জীবন বাজি রেখে এই দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছিলেন, তাকে সেই স্বাধীন দেশে আক্রমণ করছে হায়েনারা।

এই ছবিটি দেখে আমি ঘুমাতে পারিনি দু’রাত। ভেবেছি ভীষণভাবে। কোথায় চলেছে স্বদেশ? এই দেশে এভাবে রাজাকার-আলবদররা পেশিশক্তি দেখাবে? ‘জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা পরিষদ’­ কারা করেছে? কি তাদের উদ্দেশ্য? দেশের কোন কোন বিশিষ্ট (?) ব্যক্তি সেই সমাবেশে গিয়েছিলেন? সে সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করা দরকার। সাবেক প্রধান বিচারপতি জে আর মোদাচ্ছির হোসেন সেখানে প্রধান অতিথি হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি ‘মিলেমিশে’ দেশ গড়ার বাণীও শুনিয়েছেন জাতিকে।

আমাদের জানা হয়ে গেল, সাবেক প্রধান বিচারপতি তার খোলস থেকে বেরিয়ে এসেছেন। তার প্রকৃত চেহারা উন্মোচিত হয়েছে জাতির কাছে। দেশবাসী, গোটা বিশ্বে অবস্খানরত বাঙালি সমাজ জানতে পেরেছে এতদিন কাদের স্বার্থরক্ষার কবচ হৃদয়ে পোষণ করে আসছিলেন। সেই সমাবেশে জোট সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টা মাহমুদুর রহমান, বিএনপির মার্কামারা সাংবাদিক রেজওয়ান সিদ্দিকী, চারদলীয় জোট সমর্থক সাংবাদিক নেতা রুহুল আমিন গাজীসহ জামায়াত সমর্থক বেশকিছু ব্যক্তি উপস্খিত ছিলেন। আমি ভেবে খুবই অবাক হয়েছি, সেখানে উইং কমান্ডার (অব.) হামিদুল্লাহ খানের উপস্খিতি দেখে।

তাহলে কি তারও মানসিক স্খলন ঘটল? হামিদুল্লাহ খান; জনকণ্ঠ সম্পাদক আতিকুল্লাহ খানের সহোদর। আতিকুল্লাহ খান মাসুদ বর্তমানে বিভিন্ন অভিযোগে কারাবন্দি আছেন। হামিদুল্লাহ খান কোন স্বার্থ রক্ষার জন্য জামায়াত-রাজাকার চক্রের সঙ্গে হাত মেলাতে গেলেন তা বড় প্রশ্নবোধক হয়েই থেকে গেছে দেশবাসীর কাছে। এটা বাঙালি জাতি জানে এবং বোঝে­ একজন রাজাকার সবসময়ই রাজাকার। কিন্তু একজন মুক্তিযোদ্ধা সবসময় মুক্তিযোদ্ধা নন।

নামি-দামি মুক্তিযোদ্ধাদের কক্ষচ্যুতি অতীতেও লক্ষ্য করেছে এই জাতি। তা নতুন কিছু নয়। কিছু কথা হচ্ছে ওয়ান-ইলেভেনের পটপরিবর্তনের পর যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে, দুর্নীতিবাজ, মুখোশধারী, মিথ্যা প্রচারণাকারী এবং জাতির প্রতি নিমকহারাম একটি চক্র মাঠে নেমেছে কোন স্বার্থে? মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী আমান নিগৃহীত হওয়ার ঘটনাটি দেশে-বিদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। কিন্তু দু:খজনক হলেও সত্য বাংলাদেশের বড় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ এর প্রত্যাশিত জোর প্রতিবাদ করেনি। প্রতিবাদ-সমাবেশ বিক্ষোভ যা করেছে আমাদের কাছে সেটা দায়সারা গোছের বলেই মনে হয়েছে।

কেন তারা এত দুর্বল ভূমিকা পালন করল­ তা সত্যিই পীড়াদায়ক। আওয়ামী লীগ এখন ব্যস্ত সিটি ও পৌর নির্বাচন নিয়ে। খুলনা, বরিশাল, সিলেট তিনটি সিটিতে প্রার্থী দিয়েছে আওয়ামী লীগ। যদিও সেখানে বিদ্রোহী প্রার্থীও রয়েছেন। রাজশাহীতে প্রথমে চৌদ্দ দল মনোনীত প্রার্থী হিসেবে ওয়ার্কার্স পার্টি নেতা ফজলে হোসেন বাদশাকে মনোনয়ন দিয়েছিল।

কিন্তু ১৪ দল পেরে ওঠেনি আওয়ামী লীগের স্খানীয় নেতা খায়রুজ্জামান লিটনের সঙ্গে। তিনি নাগরিক কমিটির ব্যানারে অনড় থাকেন তার প্রার্থিতায়। আওয়ামী লীগ যে তাদের বিদ্রোহী প্রার্থীদের ওপর কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে পারছে না তা প্রামাণিত হয়েছে বাদশার প্রার্থিতা প্রত্যাহারের মধ্য দিয়ে। শেষ পর্যন্ত ‘বিদ্রোহ’-ই জয়ী হয়েছে রাজশাহীতে। প্রশ্ন হচ্ছে­ তাহলে আওয়ামী লীগের দলীয় শৃঙ্খলা বা কেন্দ্রীয় ‘চেইন অফ কমান্ড’ কতটা কাজ করছে? কে মানছে তাদের নির্দেশনা? একই অবস্খা সিলেটেও।

বর্তমান মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরান কারাগারে। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে চার্জশিট দেয়ার প্রক্রিয়াও চলছে বলে শোনা যাচ্ছে। তারপরও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ কামরানকেই সমর্থন দিয়েছে। সিলেটে কি আওয়ামী লীগের আর কোন নেতা নেই? তাহলে এই বিতর্কে যাওয়ার কি প্রয়োজন ছিল? একজনকে বারবার মেয়র হতেই হবে কেন? আমরা অতীতেও দেখেছি, সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ স্বৈরাচারী মনোভাব দেখায় সবসময়ই। এমন কি শরিকদের সঙ্গেও।

এই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকই চুক্তিতে সই করেছিলেন কয়েকটি ধর্মীয় মৌলবাদী দলের সঙ্গে। আরও স্পষ্ট করে যদি বলি, আজ এই বাংলাদেশে মোহাম্মদ আলীর মতো মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকার দোসরদের হাতে লাঞ্ছিত হওয়ার দায় কি এড়াতে পারবে আওয়ামী লীগ? আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে বারবার কথা দিয়েছে জাতিকে। তারা শহীদ জননী জাহানারা ইমামের মঞ্চে বসে ‘ওয়াদা’ করেছিল এই বাংলায় বিচার হবেই। আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রাজ্জাক ছায়াসঙ্গী ছিলেন সবসময় শহীদ জননীর। কিন্তু আমরা দেখলাম আবদুর রাজ্জাক মন্ত্রী হওয়ার পর একটিবারও সংসদে দাঁড়িয়ে কথা বললেন না।

বদরুল হায়দারকে প্রেসিডেন্ট বানাতে আওয়ামী লীগ প্রতিনিধি পাঠিয়েছিল জামায়াতের গোলাম আযমের বাসায়। তৎকালীন সিনিয়র নেতা আবদুস সামাদ আজাদ ছিলেন জামায়াতের সঙ্গে অন্যতম লিয়াজোঁ রক্ষাকারী। তারপরও বাংলার মানুষ বারবার দাঁড়াতে চেয়েছে আওয়ামী লীগের পতাকাতলে। কিন্তু আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব জনস্বার্থ সংরক্ষণের চেয়ে দলীয় নেতাদের মনোরঞ্জনের দিকেই নজর দিয়েছে বেশি। দলে অগণিত কৃতী নেতা থাকার পরও জরুরি মন্ত্রিত্বের দু’দুটি পদ আঁকড়ে থেকেছেন একই ব্যক্তি।

এসব অভ্যন্তরীণ স্বৈরাচারী মনোভাব সাধারণ মানুষকে তিক্ত-বিরক্ত করে তুলেছে বারবার। এখনও দেশের সিংহভাগ মানুষ মনে করেন বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হওয়া প্রয়োজন। আর এ জন্য রাজনৈতিক ঐক্য দরকার। একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল হিসেবে মহান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদানকারী দল হিসেবে তাই সেই দায়িত্বটিও আওয়ামী লীগকে নিতে হবে। ক্ষমতার প্রতি মমতা নয়, জাতীয় ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসতে হবে সাহসের সঙ্গে।

মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী থানায় জিডি করেছেন। দেশের বুদ্ধিজীবী-ছাত্র-শিক্ষকসহ অনেকেই এই ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ করেছেন। যুদ্ধাপরাধীদের এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ আক্রমণ প্রতিহত করতে হবে। সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম এ ঘটনার সুবিচার দাবি করেছে। তা না হলে কঠিন কর্মসূচি দেয়ার ঘোষণাও দিয়েছে।

এসব কর্মসূচিকে সমর্থন দেয়া প্রয়োজন গোটা দেশবাসীর। মাননীয় সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদ বারবার মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। আমি আশা করব, তিনি মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলীর প্রতি নির্লজ্জ আক্রমণকারীকে যথাশিগগির সম্ভব বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করবেন। আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের তাদের প্রাপ্য কিছুই দিতে পারিনি। কিন্তু তাই বলে তারা রাজাকার-দোসরদের হাতে নিগৃহীত হবেন­ তা কোন সভ্য মানুষই মেনে নেবে না।

‘জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা পরিষদ’-এর নামে যারা আলবদরদের সমর্থন-সহযোগিতা করেছে, এদের রাজনৈতিক, সামাজিকভাবে প্রতিহত করতেই হবে। আর সেটাই মহান মুক্তিযুদ্ধের অসম্পূর্ণ অধ্যায়।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.