সোহানার জীবনে একটা রহস্য আছে। এই নিয়ে আমরা কখনও কোনো কথা বলি না।
দু’দিন পর সোহানার বিয়ে। আজ ওর গায়ে হলুদ ছিলো। বরপক্ষ বিদায় হয়েছে।
উফ্ বাঁচা গেছে। বত্রিশ পাটির দাঁত দেখিয়ে কথা বলতে বলতে আমাদের গাল ব্যথা হয়ে যাচ্ছিলো। অবশ্য সারাক্ষণই যে হাসাহাসি চলছিলো তা না, হাতাহাতিও প্রায় হবার যো হয়েছিলো। কিছুই না, বরপক্ষের মান্যগণ্য জঘন্য কোন খালাকে নাকি আমরা অপমান করেছি। হ্যাঁ, আমাদের তো আর খেয়েদেয়ে কাজ নাই।
আরে বাবা, হলুদ দিতে আসছো সুন্দর মতো দিয়ে উঠে পড়। তা না উনি যেন ঘর লেপতে বসলেন। কপালে, দুই গালে তো দিলেনই–পারলে মিষ্টির বদলে মুখের ভিতরেও হলুদ ঠুসে দেন। এই যখন চলছিলো তখন আমরা বন্ধুরা শুধু চাওয়াচাওয়ি করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলাম। কিন্তু সেই বিশালদেহী মহিলা যখন একটা পুরো চমচম সোহানার গালের ভিতর ঢোকাবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলেন তখন আর নাজনিন চুপ করে থাকতে পারলো না।
ওর স্বভাবের বাইরে গিয়ে নরম করে বললো, ‘আন্টি এতো বড়টা ও খেতে পারবে না। ’
তো সেই কথায় আমাদের আন্টি ভ্রুক্ষেপও করলেন না। তিনি যথারীতি তার কসরত চালিয়ে যেতে লাগলেন। তখনই শুধু নাজনিন ওর স্বভাব মতো বললো, ‘আন্টি ওর মুখের সাইজ দেখেন আর চমচমটার সাইজ দেখেন, এই চমচম কি ওর মুখের ভিতর ঢোকানো ঠিক হবে?’
আর এতেই তিনি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। আমরা তার আঙুলের সমান হয়ে এতো বড় অপমান করলাম, ইত্যাদি ইত্যাদি।
শেষমেশ সোহানার মামার মধ্যস্থতায় ব্যাপারটার মীমাংসা হলো এবং আমাদের মাথা নত করে আন্টিমণির কাছে সরি বলতে হলো। এইসব নাটকের পর যখন এরা উঠলো–আমরা হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম।
আর এখন আমরা বন্ধুরা ওকে ঘিরে জমিয়ে বসে আড্ডা দিচ্ছি। আমাদের বন্ধুদের মধ্যে প্রথম দলছুট হবে একজন। কিন্তু তাতে কারও কোনো দুঃখ হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না।
এমনকি হোসানাকেও দেখে মনে হচ্ছে না ওর কোনো দুঃখ হচ্ছে। দিব্যি সব বন্ধুদের সাথে সেও ক্যালাচ্ছে। তাই দেখে পিয়া ফোঁড়ন কাটলো, ‘এতো হাসিস না দাঁত পইড়া পা কাটবে। ’
আমরা হাসতে হাসতে আরও পা কাটার ব্যবস্থা করলাম। আমাদের সাজের বহরও দেখার মতো হয়েছে।
এর মধ্যে নীলারই একটু উসখুস আর মন খারাপ অবস্থা। শাড়ির সাথে ম্যাচ করে বহু খুঁজে-পেতে যাও বা একটা আংটি যোগাড় করেছিলো তাও ঠিক বের হবার মুহূর্তে পরে আসতে ভুলে গেছে। সেই খেদ ওর এখনো যায়নি। হলুদের অনুষ্ঠান প্রায় শেষ–তবুও না। একই প্যাঁচাল তখন থেকে পাড়ছে।
শেষে অতিষ্ঠ হয়ে নাজনিন বলেই ফেললো, ‘এই একটা আংটির জন্য মরাকান্না কাঁদিস না তো। আংটিটা পরলেও তোকে এখন যা লাগছে তাই লাগতো–শাকচুন্নি। ’
এই কথায় কই আমরা একটু প্রতিবাদ করবো তা না সবাই নাজনিনের কথায় সায় দিয়ে উঠলাম। বেচারা নীলাটা এখন মুখ ভার করে আছে। অবশ্য বেশিক্ষণ থাকতে পারবে না।
একটু পরেই আবার মরাকান্না জুড়বে। সব সময়ই কিছু না কিছু নিয়ে তার কমপ্লেন করতেই হবে। অসহ্য।
আরে, সোহানাকে তো আজ শাড়িটায় খুব মিষ্টি লাগছে। যদিও আমরা ছেলের বাড়ির সব জিনিসের মধ্যেই খুঁত ধরার আপ্রাণ চেষ্টা করেছি।
কিছুই আমাদের পছন্দ হয়নি। বিশেষ করে শাড়িটা। হলুদের শাড়ি হলুদ তো হবেই তাতে আমাদের কোনো আপত্তি নাই, কিন্তু এমন বাজে হলুদ এর আগে আমরা আর কখনও দেখি নাই। তানিয়া বললো, ‘নেহায়েত আমরা সুন্দরী নইলে এই শাড়িতে আজকে খবর ছিলো। ’
এদিকে সোহানার এক কাজিন এসেছে বিদেশ থেকে।
বেচারা এতোগুলো মেয়ে দেখে আর অন্য কোথাও যেতে পারছে না। এদিকেই কেমন আঠার মতো লেপ্টে আছে। তাকে নিয়ে আমরা বেশ মজা করছি। বেচারা আমাদের মাঝখানে পড়ে ভোদাই বনে গেছে।
তানিয়ার মতে, চোখ ট্যারা হয়ে গেছে।
তাই শুনে নাজনিন বললো, ‘চোখ ট্যারা হবে না–একই সঙ্গে বাপধন এতোগুলা সুন্দরী এবং মুসলমান মেয়ে কই পাবে। ’
আমরা সবাই আবার একচোট হাসলাম। সবচেয়ে জোরে হাসলো সোহানা নিজেই।
আমাদের মধ্যে নাজনিনের একটু মুরুব্বি মুরুব্বি ভাব। খুব বিরক্ত হলো সে।
‘তুই এতো খ্যাক খ্যাক করে হাসছিস কী মনে করে? তোর না আজকে বিয়ে। আজকে অন্তত একটু লজ্জা শরম রাখ। ’
‘হ্যাঁ, দয়া করে দাঁতগুলা মুখের ভিতরেই রাখেন ম্যাডাম। ’ আমি বললাম।
‘একি তোদের সামনেও হাসতে পারবো না? তোরা তো আমার বন্ধু।
’
‘বন্ধু বলে কি আমরা মানুষ না। ’
নীলা মন খারাপ ভাবটা আর বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারলো না। ফিক করে হেসে দিয়ে বললো, ‘দ্যাখ দ্যাখ, আমাদের বিদেশী ভাইয়া নাজনিনের দিকে কেমন ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে। চোখ দু’টা তো কোটর থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। ’
‘একটা বাটি হাতে দিয়ে আয়।
পড়লেই যেন টুপ করে ধরতে পারে। এই বাজারে চোখ হারালে চোখ কই পাবে। ’ খুব গম্ভীর হয়ে পিয়া বললো। আর নীলা বেশ সহজ ভাবে উঠে গেলো।
‘এই, ও কি সত্যি সত্যি বাটি আনতে গেলো নাকি?’ আমি জিগ্যেস করেই বুঝলাম এই প্রশ্নের কোনো মানেই হয় না।
অবশ্যই বাটি আনতে গেছে। খালা মানে সোহানার মা এসে আমাদের সবার সামনে বিশাল তেহেরির ডিশ ধরিয়ে দিয়ে গেলো; আমরা নাকি ঠিক মতো কেউ খাইনি আগে। সোহানা বললো, ‘এই আমাকে তোরা কেউ একটু খাইয়ে দে না। খুব খিদা লেগেছে। ’
‘এখন তো ছেলের পক্ষের কেউ নাই, এখন নিজে খা।
’ নাজনিন বললো।
‘এখন নিজে খা মানে, ও তো সারাক্ষণ খাচ্ছিলোই। ’ আমি বললাম।
‘হ্যাঁ, খাচ্ছিলাম, কিন্তু যা খেতে চাচ্ছিলাম সেটা কেউ দিচ্ছিলো না। আর তোরা এতো মিন কেন? আমার মনে হয় আমার তোদের আগে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে বলে তোরা হিংসায় মরে যাচ্ছিস।
’
ঠিক এই সময় আমাদের নীলাটা একটা বাটি হাতে ফিরে এলো আর আমরা মজা দেখার জন্য সবাই চুপ করে গেলাম। নীলা খুবই গোবেচারা ভঙ্গিতে বাটিটা বিদেশী ভাইয়ার দিকে বাড়িয়ে দিলো।
‘আমার বোল লাগবে না, থ্যাঙ্কস। ’
‘না, না, বাটিটা হাতে ধরে থাকেন–কখন কাজে লাগে বলা তো যায় না। ’
এই কথায় আমরা সবাই হাসতে হাসতে শেষ।
এবার সোহানা আর ভাইয়ের পক্ষ না নিয়ে পারলো না। ‘তোরা থাম তো! শাহরিয়ার ভাইয়া আসো, আমার পাশে এসে বসো। ’
‘ইটস অকে। আমি ইনজয় করছি। ’
আমরা সবাই তখন বেশ মজা করে সেই বিশাল ডিশে হাত ডুবিয়েছি।
নাজনিন সোহানাকে দাবড়ানি দিলেও এখন ঠিকই খাইয়ে দিচ্ছে।
‘এই পিয়া কই যাস?’ নাজনিন জিজ্ঞাসা করে।
‘পানি আনতে। ’
‘কয়েকটা কাঁচামরিচ নিয়ে আয় না। ’
‘আম্মা, সালাদ কি শেষ হয়ে গেছে? ইশ সালাদ হলে খুব জম্পেশ করে খাওয়া যেতো।
’
‘বেশি জম্পেশ করে খাওয়ার দরকার নাই। ধুমসি তো হচ্ছেন দিনকে দিন। ’ আমি বললাম, বলেই বুঝলাম কী ভুল করলাম। ভিমরুলের চাকে ঢিল মারলাম। ‘এই তুই আমাকে কথাটা বললি, তাই না? আচ্ছা, আমাকে কি আজকে বেশি মোটা লাগছে, বল না, বল না? এই শাড়িটা একটু ফোলা ফোলা তাই না?’
‘নীলা, আর একবার ঘ্যান ঘ্যান করবি তো সিরিয়াস মার খাবি।
’ তানিয়ার কড়া ধমক খেয়ে নীলার গলার আওয়াজ মিন মিন হয়ে গেলো। আমাদের বিদেশী ভাইয়া দেখি বাটিটাকে এরই মধ্যে কাজে লাগিয়েছেন। বাটিতে বেশ আরাম করে তেহারি খাচ্ছেন আর কায়দা করে এমনভাবে চেয়ার ঘুরিয়ে বসেছেন যেন নাজনিনকে ভালোভাবে গিলতে পারেন। ভদ্রলোকের দেখি কঠিন পছন্দ হয়েছে নাজনিনকে। সোহানাকে খাওয়ানো শেষ করুক তারপর ওকে নিয়ে পড়া যাবে।
‘কে কে বোরহানি খেতে চাও?’ এক হাতে বোরহানির জগ উঁচু করে ধরে খালা জানতে চাইলেন। আমরা সবাই সমস্বরে খেতে চাইলাম।
খাওয়া দাওয়া চুকলো। একে একে সবাই বিদায় নেয়ার জন্য তৈরি হলো। আগামীকাল অনেক কাজ।
ছেলের বাড়িতে হলুদ। আমরা সবাই যাবো। আজ আমরা পরিছিলাম গঙ্গা যমুনা শাড়ি। কাল পরবো কাঁথা স্টিচ। বন্ধুদের মধ্যে শুধু আমি থেকে গেলাম সোহানার সাথে।
ওরা চলে যেতেই ছোট্ট ফ্ল্যাটটার উপর ক্লান্তি নেমে এলো। বিদেশী ভাইয়া উঠে গেলেন, খালা আমাদের কাপড় বদলাতে তাড়া দিলেন। কিন্তু আমার আর সোহানার কিছুই করতে ইচ্ছা করছিলো না। তারপর এক সময় ওর বেণীবাঁধা চুল আলগা করতে শুরু করলাম। ফুলের গয়না খুললাম, কাঁচের চুড়ি, কানের দুল।
এই নিষ্পাপ হুল্লোড় আর অযথা পচানো তাহলে শেষ হচ্ছে। এই দুই জীবন আর কখনও মুখোমুখি হবে না এই উপলব্ধি সোহানাকে কিছুক্ষণ ম্লান করে রাখলো।
আবারও এক চোট বকা খেয়ে আমরা বিছানা করতে উঠলাম। বকার অবশ্য সিংহভাগ আমিই খেলাম। বিয়ের দু’দিন আগে খালা মেয়েকে প্রাণেধরে আর বেশি কিছু বলতে পারলেন না।
মেঝেতে বিছানা পাতলাম, মশারি টাঙ্গালাম তারপর সোহানাকে বললাম, ‘শুতে আয়। ’
‘শীলা?’
‘হু?’
‘ঘুমিয়ে পড়েছিস?’
‘হুম। ’
‘বাচ্চাটা বেঁচে থাকলে কার মতো হতো দেখতে?’
এই প্রশ্নে রাত আরও গভীর হয়ে নামলো। জানালা গলে একফালি চাঁদ মশারি অগ্রাহ্য করে হুঁটোপুটি খেলো মেঝের বিছানায়। আমরা শুয়ে থাকলাম।
সোহানার কথা জানি না। ওর পিঠ আমার দিকে ফেরানো। শুধু আমার চোখ থেকে পানি পড়ছিলো অকারণে।
[সূত্রঃবিডিনিউজ24].....
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।