ধুলো থেকে আগমন আবার ধুলোতেই প্রত্যাবর্তন
নিজের দেশকে কে না ভালবাসে? নিরেট মূর্খ থেকে নিয়ে শুরু করে উঁচুতলার শিক্ষিত সবাই ভালবাসে নিজ নিজ মাতৃভুমি। তাইতো এই দেশ নিয়ে রচিত হয়েছে কত শত গান , কবিতা আর ভালবাসাময় সকল সাতকাহন। অনেকেই অনেক কিছু দিয়ে ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন, অনেকে আবার সব দিয়েই সময়ের দাবীতে মুক্ত করেছেন নিজ দেশের সোনার চেয়ে দামী মাটিকে। মুক্তির দাবীতে পঙ্গুত্ব বরণ করে নেয়া সেই অর্ধেক মানুষেরাও অন্যের কাঁধে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে " আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি" গাইতে গিয়ে চোখের পবিত্র জলে ভিজেছেন। এতটাই মমতা এই দেশটির জন্য আমাদের।
আমরা যেন সব সহ্য করে নিতে পারি কিন্তু মাতৃভুমির অপমান সহ্য করতে পারিনা, প্রয়োজনে জান দেব তবু মান দেবনা!
এইতো গেল মুদ্রার একপিঠ; কিন্তু অপর পিঠে কি রয়েছে তা বোধকরি সবারই জানা-
সব কিছু সহ্য করে নিতে গিয়ে আমরা সহ্য করে যাচ্ছি বিষাক্ত সীসায় ভারি হয়ে যাওয়া বাতাস,বসবাস করছি পৃথিবীর গ্যাস চেম্বারে! সইতে হচ্ছে কালো ধোঁয়া, দূষিত পানি। অসহনীয় ট্রাফিক জ্যামও আমরা সহ্য করে যাচ্ছি দিনের পর দিন! যত্রতত্র আবর্জনার স্তুপ যেন আমাদের চোখ সওয়া হয়ে গিয়েছে, রাস্তায় উপচে পড়া ডাস্টবিন না দেখলেই যেন মনের অজান্তে কুঁচকে যায় ভুড়ু। এটিইকি আমার সেই চির পরিচিত গলি নাকি অন্য কোথাও এসে পড়লাম!- এই হল আমার দেশের নিত্যদিনের সামান্য রুপের ঝলক! সোনার বাংলা ধীরে ধীরে পরিনত হচ্ছে তামার বাংলায় আমাদেরই চোখের সামনে, কিন্তু সবাই যেন কেমন করে সব কিছু সহ্য করে যাচ্ছি! মনুষ্য প্রজাতীতে জন্ম গ্রহণ করেও নিজেদের নামিয়ে আনছি তেলাপোকার মত সর্বভূকের প্রজাতীতে! বিষাক্ত বাতাস সেবন আর দূষিত পানি পান করেও দিব্যি বেঁচে থাকছি ৫০ বছর- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার এক বিস্ময়কর বিস্ময় হয়ে! সৃষ্টিকর্তা যেন অপরিসীম রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দিয়ে আমাদের এদেশে পাঠিয়েছেন! টানতে টানতে আমাদের যতই টানা হচ্ছেনা কেন আমরা ছিঁড়ে যাচ্ছিনা - আমাদের ইলাস্টেসিটি এতই বেশি! সামান্য নড়ে চড়ে জেগে উঠার ভয়ে এই সব নষ্ট দিনরাত্রী যাপন করছি আমরা, দেশপ্রেমিকেরা! যতটুকু সময় আমরা নিজেরা কাজে লাগাতে পারতাম সেটুকুও হারিয়ে ফেলছি সরকারের দোষ দিতে গিয়ে; আবার সেই সরকারকেই প্রতি পাঁচ বছর পর পর নির্বাচিত করে প্রতারিত হচ্ছি নিজের দ্বারা নিজেই, প্রতারণার স্বাক্ষর পার্মানেন্ট কালি হাতে নিয়ে মনের সুখে গান গাইতে গাইতে ফিরে আসছি বাড়ি- ফুলের মত চরিত্রের কাউকে রাজাকীয় আসনে আসীন করেছি! ঘরে ফিরে এসে হিসেবের টাকায় মোটা চালের ভাত গলা দিয়ে নামতে চায়না! নিকৃষ্টমানের চালের দামও ২৬ টাকা কেজি। শায়েস্তা খান সাহেব বেঁচে থাকলে হার্ট আ্যটাক করতেন!
কিন্তু এভাবে আর কতকাল চলবে? এখনও কি আমাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়নি, এখনওকি আমাদের ঘুম ভাঙ্গার সময় হয়নি?
একটা ব্যাপার আমরা ভুলে যাই বারবার, সব কিছুর দায় দায়িত্ব সরকারের হাতে না দিলেওতো চলে। আমরা নিজেরাই পারি নেজেদের জীবন যাত্রাকে কিছুটা হলেও আনন্দদায়ক করতে ।
যেমন,আমরা নিজেরাই পারি নিজেদের এলাকা পরিষ্কারের দায়ীত্ব নিতে যেটা নিয়েছে কলাবাগান বাসীরা। একবার বিদেশী একদল তরুন ঢাকার রাজপথে গীটার বাজিয়ে গান গেয়ে গেয়ে ঢাকাবাসিকে সজাগ করতে চলেছিল আবর্জনা পরিষ্কারের ব্যাপারে । এসব দেখেও আমাদের নিজ দেশের তরুনদের লজ্জা হয়নি। ওরা আগের মতই নিশ্চুপ রয়ে গিয়েছে। তারা মশাদের গান শুনতেই বেশি আগ্রহী! সেনাকর্মকর্তা কেন কলার চেপে ধরেছে এজন্য অচল করে দিয়েছে সারা দেশ! কিন্তু সেই শক্তি, সেই বলের সামান্য একটা অংশও ব্যায় করতে পারেনা নিজ এলাকার ময়লা পরিষ্কারের জন্য।
কি করেছি আমরা এই প্রানপ্রিয় বাংলার জন্য? এখনও কি আমাদের সাজে নিজ নিজ দলের লেজুড়বৃত্তি করা, নিজেকে দেশপ্রেমিক হিসেবে পরিচিতি দেবার হাস্যকর চেষ্টা করা?
অসহনীয় ট্রাফিক জ্যামের প্রধান কারণ- অনিয়ন্ত্রীত ভাবে একই পথে সকল গতির যানবাহন চলাচল। যেখানে চলছে ঘোড়ার গাড়ি সেই পথেই চলছে বাস! যেখানে চলছে মানব চালিত রিক্সা সেই একই পথে চলছে লেক্সাস! চলছে একজনের আগে অন্যের সামনে যাবার রতি, কিন্তু থেমে গিয়েছে দেশেটির প্রগতির গতি। একবার সদরঘাট থেকে গুলিস্তান আসতে আমার সাড়ে তিন ঘন্টা লেগেছিল! তখন মনে মনে ভেবেছিলাম আমাদের পাঠ্যপুস্তক থেকে "সময়ের মূল্য" রচনাটি কেন উঠিয়ে দেয়া হয়না - বেঁচে যেত কয়েক লক্ষ কাগজ আর কয়েক গ্যালন কালি; আর আমাদের ছাত্ররাও বাঁচত সময়ের মূল্যের মত মূল্যহীন রচনার জন্জাল থেকে! একজনকে দেখলাম গাড়ির ভেতর বসে "আ্যলাইস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড" পড়ছে। সে হারিয়ে গিয়েছে আ্যালাইসের সাথে; জ্যাম তাকে স্পর্শ করছেনা। সে মেনে নিয়েছে! জ্যামের কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল ওয়াসার পাইপলাইন ঠিক করা হচ্ছে মাটি খুঁড়ে।
প্রতিদিনই এই মাটি খোঁড়া খুঁড়ির কাজ চলে, প্রতিদিনই জ্যাম লাগে, প্রতিনিয়তই আমরা মেনে নিই! প্রতিদিনই পুলিশকে দুই টাকা ঘুষ দিয়ে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করি দেশকে পেছনে ফেলে, আর প্রতিদিনই চিত্কার করি নিজেকে দেশপ্রেমিক সাজাতে!
কালোবাজার আর মজুতদারি সমাজের গভীরে এমনভাবে প্রবেশ করেছে যে এখন সেটাকে বিজনেসের অংশ হিসেবেই দেখা হয়! আমার দেশের শিশুরা ভোগে অপুষ্টিতে, খেতে পায়না ওরা। একটু ভাল খাবারের আশায় রোদের মাঝে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকে। কারও মন চাইলে দুটো টাকা পায় আর কারও না চাইলে পায়না। আমার বাবা বলতেন, "ওদেরকে কখনও টাকা দিবিনা; টাকা পেয়ে লোভ হয়ে গেলে ওরা ভাবতে থাকবে - পথের মাঝেই আনন্দ, রাস্তা থেকেইতো পয়সা আসছে তাহলে অন্য পথে কেন চেষ্টা চালাবো, সারা জীবন ওরা রাস্তায়ই থেকে যাবে। " বাবাতো একটা দিক তুলে ধরলেন কিন্তু তিনি কি আসলেই গভীরে গিয়ে ভেবেছেন যে , ওদেরকে দরীদ্র করে তুলছে কারা? কারা বেশি মুনাফা লাভের আশায় সিন্ডিকেট তৈরী করে জিনিসপত্রের দাম নিম্নবিত্তের নাগালের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে, কারা মজুতদারি করে পথকলিদের হক মেরে খেয়ে নিজের উদরপূর্তি করছে! মজুতদারেরাতো ডায়নিং টেবিলে বসে মনোরম সব খাবার গিলছেন বড় আয়েশ করে; ঘরময় স্প্লিট এসির ১৮ ডিগ্রী সেলসীয়াস শীতলতা! ওদিকে আমার দেশের অর্ধেক মানুষ না খেয়ে ক্ষুধার যন্ত্রনায় ভোগে।
আমি তাদের সাহায্য করতে দলবদ্ধ হইনা, আমি সাহায্য করি কালোবাজারীকে - যখন কাঁচা মরিচের কেজি ৩০০ টাকা তখনই যেন আমার কাঁচা মরিচ খাবার ধুম পড়ে যায়, বাজার থেকে উধাও হয়ে যায় সেই ৩০০ টাকা দামের মরিচই। আরে এতে করে কি সাহায্য করা হচ্ছেনা সেই অর্থলোভীকেই যে বেশি মুনাফা লাভের আশায় বাজারের এহেন অবস্থা করেছে? সেই কাঁচামরিচ কিছুদিন না খেলে কি জাত চলে যাবে? যাবেনা, কিন্তু তারপরও আমরা হুড়োহুড়ি করি সেটা কিনে নেবার জন্য। একবারের জন্যও ভাবিনা , কিছুদিনের জন্য ওটা বর্জন করলেই পঁচনশীল কাঁচা সব্জীর দাম পড়ে যেতে বাধ্য। না , তা না করে আমাদের কাঁচামরিচ খেতেই হবে আর নিজের ঝালমাখা মুখের ঝাল ঝাল ভাষন দিয়ে প্রমান করতেই হবে - আমি দেশপ্রেমিক!
এভাবেই চলছি প্রতিনিয়ত, অনিয়ন্ত্রীত, এলোমেলো, নিয়মকানুনের কোনো বালই ছাড়া। এটা কি আমাদেরই দোষ নাকি আমার এই দেশটির মাটির দোষ! নইলে দেশের বাইরে গিয়েতো ঠিকই নিয়ম মানছি,আপনি কেন সাহস করেননা সবুজ বাতি না পড়া পর্যন্ত রাস্তা যতই ফাঁকা থাকনা কেন সময় বাঁচানোর জন্য কেন দৌড় দিতে? আপনিকি সাহস করবেন সুইজারল্যান্ড গিয়ে সিগারেটের বাট যত্রতত্র ফেলতে? পারবেন কানাডাতে গিয়ে রাস্তার ধারে প্রস্রাব করতে? দেখেছেন কোথাও বড় করে লিখা ব্যানার, "এখানে প্রস্রাব করা নিষেধ"!!! আপনিকি টোকিওতে উচ্চ শব্দে মাইক বাজিয়ে গান শুনতে পারবেন? আপনি কি সাহস করবেন সিডনীতে স্পীড লিমিট অতিক্রম করে গাড়ি চালাতে? আপনার কি সাহস হবে ফিনল্যান্ড গিয়ে কাউকে ঘুষ সাধার? আপনি কি পারবেন লন্ডনের ফুটপাথে দোকান খুলে বসার? আপনি কি একবারও চিন্তা করেন নি্উইয়র্কের কোনো পথে যেখানে সেখানে গাড়ি পার্ক করার? নাহ, পারবেননা।
কিন্তু দেশের মাটিতে পা দেয়ার সাথে সাথে আমরা সব নিয়ম কানুন ভুলে যাই; মনের ভেতর পোষন করি, " যশ্মিন দেশে যদাচার। " একই মানুষ আপনি, আমি, আমরাইতো বিদেশে গিয়ে লয়্যাল সিটিজেন হতে পারছি; সেটা এই দেশটিতে হতে সমস্যা কোথায়? দেশে প্রবেশ করার সাথে সাথে এই মাটিকে নোংরা করার জন্য হাত নিশপিশ করতে থাকে , হাতে রাখা অপ্রয়োজনীয় প্যাকেট খানা যেখানে সেখানে ছুড়ে ফেলে দিয়ে তবেই যেন তৃপ্তি! একটু হেঁটে গিয়ে ডাস্টবিনে চকলেটের প্যাকেট খানা ফেলতে চাইনা কিন্তু নিজেকে দেশপ্রেমিক প্রমান করতে গিয়ে বহুদূর যেতে চাই! দেশীয় পন্যে আমাদের অম্বল হয় কিন্তু দেশপ্রেমিক খ্যাতির জন্য গরীবের রক্ত চুষে খেতেও রুচিতে বাধেনা!
এইসব দেশপ্রেমিকদের জন্যই কি তবে সেইসব দেশপ্রেমিকেরা প্রান দিয়েছিলো, ওরা কি তবে এই জন্যই বরণ করেছে পঙ্গুত্ব? তাঁরা কি একবারও ভেবেছিলেন এইরকম একটা চিত্র হবে সোনার বাংলার? ৩৫ বছরে কি আমাদের কিছুই করার ছিলনা? দেশ দেশ করে বাঁচার জন্য মরে যাচ্ছি কিন্তু দেশের জন্য কাজের কাজ কিছুই হলনা ! এই যদি হয় দেশপ্রেম তবে -
আমি বিদ্রোহী হতে চাই,
আমি একজন সাধারণ নাগরিক হয়েই থাকতে চাই,
আমি দেশপ্রেমিকেরও ফাঁসী চাই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।