গাঁয়ের সেই ছোট্ট মেয়েটি কুসুম যার নাম তার ভেতর যে এত প্রতিভা লুকিয়ে ছিল তা কে জানতো? অথচ সালেহা বেগম একে একে তিনটি কন্যা সন্তান জন্ম দিয়ে চতুর্থ বারও যখন সে ধারা অব্যাহত রাখলেন মানে তার কোল জুড়ে এল কুসুম তখন কী গঞ্জণাটাই না তাকে সইতে হয়েছিল। আল্লাহর কাছে নামায রোযা করে সালেহা বেগম কত কেঁদেছেন, ও আল্লাহ এইবার আমার একটা ছেলে দাও। শাশুড়ি তো তাকে আগেই ঘোষণা করে দিয়েছেন, এইবারও যদি মাইয়া হয়, তোরে তো ঘরে রাখুমই না, তোর মাইয়াও ফালাইয়া দিমু। তারপর পোলারে আবার বিয়া দিমু। সদ্য প্রসূত সন্তান দেখে সব মা-ই তার দীর্ঘ গর্ভধারণের কষ্ট ভুলে যান।
আর সালেহা বেগম! দাইয়ের কাছে যেই না শুনেছেন তার মেয়ে হয়েছে ভয়েই সঙ্গে সঙ্গে মূর্ছা যান। যেই সালেহা দাঁতে দাঁত চেপে প্রসব যন্ত্রণা সহ্য করেছেন, শেষাবধি মেয়ে হওয়ার খবর শুনেই তিনি জ্ঞান হারালেন। এই হল কুসুম জন্ম বিত্তান্ত। এসব কথা কুসুম তার মায়ের কাছে শুনেছে। জেনেছে, তার তিনবছর বয়েস পর্যন্ত কী রোগাই না সে ছিল।
একেবারে হাড় লিকলিকে, অসুখ-বিসুখ লেগেই থাকত। তাছাড়া পরের বছর কুসুমের একটি ভাই জন্ম নেয়ায় সবাই বংশের প্রদীপের যতœ-আত্মি নিয়ে এতটাই ব্যস্ত থাকত যে কুসুমের কথা সবাই একরকম ভুলেই গিয়েছিল। গৃহস্থের পাঁচজনের সংসার। সুতরাং সালেহা বেগমকে ভোর তক রাত অব্দি কাজে ব্যস্ত থাকতে হত। কুসুম বলা যায় একরকম তার বুবুদের কাছেই মানুষ।
অন্যদিকে তার এক বছরের ছোট ভাইটির যেন মাটিতে পা-ই পড়ত না, সবার কোলে-কাখে থেকে থেকে, ভাল খেয়েদেয়ে একেবারে নাদুসনুদুস অবস্থা আর পাশাপাশি কুসুম ছিল ভয়ানক রোগা একটি মেয়ে। হবে না? ছয়টা মাসও মায়ের দুধ সে ঠিকমতো পায়নি বা বলা যায় খোদার প্রতি অভিমান হেতু সালেহা বেগম মা হয়েও তাকে উপেক্ষা করেছেন। সেই এইটুকুন বয়সেই কুসুম বুঝে গিয়েছিল তার ছোট ভাইটি যখন যা আবদার করবে তাই পাবে, বাবা তার জন্য বাজার থেকে ফি দিন একটা করে আমিত্তি এনে দেবে, বিকেল হলেই দাদি তাকে কোলে নিয়ে পাড়া বেড়িয়ে আসবেÑমানুষকে দেখিয়ে বলবে, আমার নাতিরে দ্যাখো। অথচ দাদির পিছন পিছন কুসুমও যেত কিন্তু কুসুম যেন কেউ না। কী যে খারাপ লাগত তখন ওর।
খাওয়ার বেলায় ছোট ভাইটি খেয়েদেয়ে কিছু বাকি থাকলে তবে তা কুসুম ও তার বুবুদের কপালে জুটত। এমনকি দেখা যেত কোন পুষ্টিকর ভাল খাবার যা ভাইটি কিছুতেই আর খেতে চাইছে না, কুসুম তখন সেটি চাইলেই মা-দাদি খেকিয়ে উঠতেন, ছেমরি তো এক্কেরে রাক্ষস হইছে। পোলাডা না খাইতে খাইতে একেবারে রোগা হইয়া গেল আর অর খালি খাই খাই। উৎসব-আনন্দে প্রতিটি ক্ষেত্রেই কুসুম দেখত তার ভাইটির কী কদর! এসব দেখে দেখে মেয়েটি লুকিয়ে চোখের পানি মুছত আর আল্লাহকে অভিযোগ জানাত, কেন তুমি আমাকে ছেলে বানালে না, কী দোষ করেছি আমি? সেই ছোটবেলা থেকেই অবহেলা পেতে পেতে কুসুম তার নিজের ভেতরেই একটা জগৎ তৈরি করে নিয়েছিল। তার বয়েসি মেয়েরা যেখানে একটু দম ফেলার সময় পেলেই দল বেধে হুটোপুটি করত আর কুসুম বেশিরভাগ সময়ই একা একা ঘুরে বেড়াত।
ফুলের সঙ্গে কথা বলত, পাখির সঙ্গে আলাপ জমাত, মাটিতে আঁকিবুঁকি করত। খুব অল্প বয়সেই একটা গাম্ভীর্য চলে এসেছিল ওর চোখেমুখে।
কুসুমকে আর তার ভাইকে এক সঙ্গেই স্কুলে ভর্তি করা হয়। কুসুমের গুরুদায়িত্ব দাঁড়াল স্কুলে যাওয়া থেকে শুরু করে বাড়ি ফেরা পর্যন্ত প্রতি মুহূর্তে ছোট ভাইটিকে পাখির ছানার মতো আগলে রাখা। ভাইবোন একই কাসে আর পড়াশুনায় যেহেতু ভাইটির মন নেই, অতএব নিজের পড়া বাদ দিয়ে ভাইকে পড়া বুঝিয়ে দাও, তার হোমওয়ার্ক করে দাওÑ বড় বোন হিসেবে তো এটা কুসুমের কর্তব্য।
ভাইটা ছোট মানুষ এখনো বুঝ হয়নি তাই পড়াশুনা বাদ দিয়ে সারাদিন খেলে বেড়ায়। স্কুলে পরীক্ষার সময় আসলে কুসুমের কাজ হয় ভাইকে পাশে বসিয়ে খুঁটিনাটি বলে দেয়া। ভাইকে সাহায্য করতে গিয়ে নিজের লেখার সময় হারালেও তা করতে হবে। নইলে আদরের ভাই ধন বাড়িতে এসে বিচার দেবে, আমারে পরীক্ষায় কিচ্ছু বলে দেয় নাই। এইভাবে কুসুম প্রাইমারি পর্যন্ত প্রতিটি পরীক্ষায় প্রথম হয়েছে আর ভাইকেও পাস করিয়েছে।
কুসুম যে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পাবে এ একরকম শিক্ষকরা ধরেই নিয়েছিলেন। হয়েছেও তাই। যাহোক, হাইস্কুলে এসে ভাইবোনকে অবশেষে আলাদা হতে হল কারণ সেখানে ছেলেমেয়ে শিফট আলাদা। এখানে তো আর পরীক্ষায় এক সঙ্গে বসার সুযোগ নেই, অতএব পরীক্ষার ফলাফলে দেখা গেল কুসুম ঠিকই তার প্রথম হওয়ার ধারাবাহিকতা অক্ষুণœ রেখেছে আর ছোট ভাইটি কোনরকমে টেনে হিচঁড়ে পাস করেছে।
বাড়িতে বিয়ের বাদ্য বাজা শুরু হয়।
কুসুমের বড় বুুবুর স্কুল পাসের আগেই বিয়ে হয়ে যায়। তার ছয় মাসের মধ্যে মেজ বুবুরও। দেখতে সময় চলে যায়। সামনে কুসুমের মেট্রিক পরীক্ষা। শিক্ষকদের তার ওপর অগাধ বিশ্বাস সে বোর্ড স্ট্যান্ড করবেই।
ফাইভে এইটে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পাওয়া ছাত্রী, যে সে মেয়ে তো নয়। আর কুসুমের সেই ছোট ভাইটি তার খবর কী? সে তো এখন এলাকায় প্রায় বখাটে খেতাব পেয়ে গেছে। প্রতি বছর এক-দুই বিষয়ে ফেল করে বিশেষ বিবেচনায় টেন পর্যন্ত এসেছে। কিন্তু টেস্ট পরীক্ষায় তিন বিষয়ে ফেল, কতৃপক্ষ কিছুতেই তাকে পরীক্ষা দিতে দেবে না। ছেলের জন্য কুসুমের মা-বাবা হেডমাস্টারের হাতেপায়ে ধরেন, তাতেও কাজ হয় না।
শেষপর্যন্ত কুসুমকে হেডমাস্টারের কাছে বলতে বাধ্য করা হয়, ভাইকে পরীক্ষা না দিতে দিলে বাড়িতে আমাকে পরীক্ষা দিতে দেবে না। যা প্রত্যাশিত ছিল তাই হলÑ কুসুম বোর্ড স্ট্যান্ড আর তার গুণধর ভাইটি ফেল। ইন্টারমিডিয়েটেও কুসুম ভাল ফলাফল করল। এরপর? এবার তো ঢাকায় যেতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হবে। কুসুমের অনেক দিনের স্বপ্ন।
মেয়ে মানুষের এত পড়ার কাম কী? এইবার বিয়া দেও। কুসুমের দাদি নাতনিকে কিছুতেই আর পড়তে দিতে নারাজ। কুসুমের বাবাও এতে নিমরাজি, ঢাকা শহরে মেয়েকে একা পাঠানো যায় না। বিয়েশাদি দিয়ে দিলে স্বামী চাইলে পড়বে নাইলে না। এসময় এগিয়ে এলেন কুসুমের স্কুলের সেই হেডমাস্টার, তার ছেলের জন্য মিষ্টি এই মেয়েটিকে তিনি মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলেন।
ছেলে তার ঢাকার এক কলেজের শিক্ষক। বিয়ে হলে অন্তত কুসুম উচ্চশিক্ষা থেকে তো হবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পরপরই কুসুমের বিয়ে হয়ে যায়। তারপর একসময় তার কোল জুড়ে আসে সন্তান। কিন্তু পড়াশুনা ঠিকই চালিয়ে যায় কুসুম।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকে গেলে বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নেয়। এবং ম্যাজিস্ট্রেট। এর পরের চিত্রপট এরকম : কুসুমের বাবা সেকান্দার আলী হাট থেকে বাজার নিয়ে বাড়ি যাচ্ছেন। একটি দোকান বসা এক লোক তাকে দেখিয়ে পাশের জনকে বলছে, দ্যাখো, অমুকের মেয়ে ম্যাজিস্ট্রেট হইছে। কথাটা আস্তে হলেও কুসুমের বাবার কানে পৌঁছায়।
গর্বে বুকটা তখন তার দশ হাত ফুলে যায়। তবে ভেতরে ভেতরে এক ধরনের অপরাধবোধও তিনি অনুভব করেন। কুসুমের আজকের এই অবস্থানের তার কী অবদান। মেয়ের পড়ার জন্য তিনি একটা টাকাও কি খরচ করেছেন। ওর বৃত্তির টাকাই বরং সংসারে দিয়েছে।
অথচ মেয়ে বলে ওকে শুধু তিনি অবহেলাই করেছেন। মেয়ে পড়াশুনা করে চাকরি করলে বাপকে তো আর টাকা দেবে না, স্বামীর সংসারেরই খরচ করবেÑএই ছিল তার ধারণা। আর আজ এই মেয়েই তাকে প্রতি মাসে টাকা পাঠায়। আর তার গুণধর ছেলেটা? কিছুই করতে পারলো না। অবশেষে মুদি দোকানদার।
এই হল কুসুম বিত্তান্ত। বাংলাদেশের ৬৮ হাজার গ্রামের চিত্র এরকমই। দেশে শিক্ষার হার বাড়লেও মানুষের কুসংস্কার, পুরনো ধ্যান-ধারনা ভাঙ্গেনি। গ্রামাঞ্চলের অশিক্ষিত পিতামাতার কথা না হয় বাদই দিলাম, দুঃখের বিষয় শহরের অনেক শিক্ষিত পিতামাতাও ছেলে ও মেয়েকে সমান সুযোগ-সুবিধা দিয়ে বড় করেন না। কারণ তাদের ধারণা, ছেলে হল সম্পদ আর মেয়ে নিজের কাছে রাখা পরের গচ্ছিত ধন।
আজ সেকান্দার আলী হয়তো জীবনের শেষভাগে এসে তার ভুল বুছতে পেরেছেন। কিন্তু সবাই তো কুসুমের মতো অদম্য মেধাবী নয় যে একসময়কে চোখে আঙুল দিয়ে সেকান্দার আলীদের বুঝিয়ে দেবে। এজন্য চাই সুযোগ, ছেলের পাশাপাশি মেয়েকেও সমান সুযোগ দেয়া। আজ ৩০ সেপ্টেম্বর, কন্যা শিশু দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য হলÑ‘সুযোগ চাই বাধা নয়, করব আমি বিশ্বজয়’।
আজকের দিবসে আমাদেরও প্রার্থনা ছেলেমেয়েতে বিভেদ নয়। কন্যা শিশুকে আর অবহেলা নয়। সুযোগ পেলে আমাদের এই কুসুমরা তাহলে একদিন বিশ্বও জয় করতে পারবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।