আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কুসুম ও কীট নাশক

পর্ব/৩ পুব দুয়ারি ঘরের মাঝ বরাবর পেতে রাখা বড় খাটে বালিশে হেলান দিয়ে বসেছিলেন জাহানারা খাতুন। মেয়েকে দেখে মায়ের ম্লান চোখে একটু হাসি ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেলো। পশ্চিমের জানালা দিয়ে শেষ বিকেলের একফালি রোদ এসে পড়েছে ছোট্ট ভাইটার মুখে। অনেক কাঁথা কাপড়ের মাঝ থেকে তার লাল টুকটুকে মুখটাই চোখে পড়ে। কুসুম তার ছোট ভাইকে কোলে নেবার জন্যে ছুটে গিয়েছিল।

মা শুধু বললেন, ‘ভাইয়ের শরীর ভালো না মা, কাল সকালে কোলে নিস। ’ তালসোন থেকে আর কেউ এসেছে কিনা, না এসে থাকলে কুসুম কার সঙ্গে এসেছে অথবা কে কেমন আছে এসব কোনো কথাই জানতে চাইলেন না জাহানারা খাতুন। মেয়েকে কাছে টেনে নিয়ে একটু গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে একটু আদর করলেন। কুসুম বুঝতে পারছিল না ছোট ভাইটার মুখ এতো লাল কেন! সে যখন ভাইয়ের মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে পর্যবেক্ষণ করছে তখন ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে পশ্চিমের লাল আভা। ঘরের মধ্যে অন্ধকার জমাট বাধতে শুরু করেছে।

বারান্দা থেকে নানীজানের গলা শোনা গেল, ‘পোয়াতির ঘরত এখনো বাতি দেসনি বীনু! হারকিন ধ্যরা দিয়া ছল কোনার হাত মুখত পানি দিয়া আনেক। কুন সকালে বাড়িত থিনি বারাছে... মগরবের ওক্ত হ্যয়া গেল খিদা লাগেনি...’ নানীজানের কথা আর শুনতে পায়না কুসুম। একটু পরে বীনু খালা হেরিকেন নিয়ে ঘরে ঢুকতেই মা বললেন, ‘জানলাগুলা বন্ধ করে দে বীনু। ’ বীনু খালা যে মায়ের আপন বোন নয় সে কথা অনেকদিন পর্যন্ত জানতোনা কুসুম। জানবার প্রয়োজনও হয়নি কখনো।

বীনু খালা যদি আপন না হয় তাহলে আর কাকে আপন বলা যায়! আর কতোটা কর্তব্য করলে, কতোটা আন্তরিক হলে এবং নিজেকে নিঃস্বার্থ ভাবে আর কতোটা উজাড় করে দিলে আপন হওয়া যায় কুসুম বুঝতে পারেনা। দক্ষিণের দীর্ঘ বারান্দায় দিয়ানত আলী খন্দকারের খড়মের একটানা শব্দ অনেকটা সময় ধরে একটি নীরব সন্ধ্যাকে ভেঙ্গে ভেঙ্গে চারিপাশে ছড়িয়ে দিচ্ছে। মাগরেবের নামাজ শেষ করে হাতে তসবিহ্ নিয়ে বারান্দায় পায়চারি করছিলেন ধলা মিয়া। কী এক গভীর ভাবনার মধ্যে ডুবে থেকে অন্য মনস্কভাবে তার হাতের আঙ্গুল তসবিহ্র দানাগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছিল। বাহির বাড়িতে সাইকেলের বেল শুনে তার খড়মের শব্দ থমকে দাঁড়ালো।

কয়েক ধাপ সিঁড়ি ভেঙ্গে নীচে উঠানে নেমে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে নিজেই বেরিয়ে গেলেন। ছোট ছেলে খায়রুল বাশার এ বাড়ির আশ্রিত তালিব ইলিম মোতালেবকে কি যেনো নসিহত করছিল। ধলা মিয়া কাছে এসে ছেলেকে বললেন, ‘দুপচাঁচিয়াত থিনি সুধা ডাক্তারক একবার ডাকলে ভালো হলোনি...’ খায়রুল কোনো জবাব দেবার আগেই মোতালেব আগ বাড়িয়ে বললো, ‘হামি সাইকেল লিয়া যাই চাচমিয়া?’ খায়রুল আপত্তি করে, ‘সুধা ডাক্তার বুড়া মানুষ, রাতে তাঁঁই আর অ্যাসপার রাজি হবিনা। ক্যাল সকালে হামি লিজে য্যায়া লিয়া আসমো। ’ ‘ক্যাল সকাল পর্যন্ত কি সোময় পাওয়া যাবে!’ একটা বড় রকমের সংশয় প্রকাশ করে খড়মে শব্দ তুলে তসবিহ্ টিপতে টিপতে ভেতরে চলে গেলেন ধলা মিয়া।

সময় কিছুটা পাওয়া গিয়েছিল। দুপচাঁচিয়া থেকে ডাক্তার সুধাংশু মাধব দত্ত এল এম এফ পরদিন বেলা এগারোটা নাগাদ এসে দেখে গেছেন। কিন্তু কোনো আশ্বাস দিতে পারেননি। ডাক্তার চলে যাবার পরে পুব দিকের বারান্দার রোদে কুসুম যখন তার ভাইটাকে কোলে নিয়ে বসেছিল তখনো তাকে এতোটুকু অসুস্থ বলে মনে হয়নি। মুঠো করা ছোট্ট হাত দুটো উপরে তুলে আড়মোড়া ভেঙ্গে ফোলা ফোলা চোখে পিটপিট করে কুসুমের দিকে তাকাচ্ছিল।

একটা অজানা আনন্দে ভরে ওঠে কুসুমের মন। সেই সাথে ছোট দাদিকে সঙ্গে করে না নিয়ে আসায় আফসোসও হচ্ছিলো। এই মুহূর্তে যদি সবাইকে ডেকে দেখানো যেতো! ভাইয়ের মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতে থাকতেই কুসুমের মনে হয় সকালের আলোয় লাল মুখটা যেনো ধীরে ধীরে প্রথমে সবুজ এবং সবুজ থেকে ক্রমশ নীল হয়ে যাচ্ছে। দুপুরের দিকে নানীজান একবার জোর করে তুলে নিয়ে গিয়ে নিজে হাতে ভাত মাখিয়ে খাইয়ে দিয়েছিলেন। পুকুরে গোসল করতে যাবার সময় বীনু খালা চেষ্টা করেছিল কুসুমকেও সঙ্গে নিয়ে যেতে।

এমনিতেই শীতের দিনে গোসল করার ব্যাপারে কুসুমের ঘোর আপত্তি। পুকুরের নতুন পানিতে হঠাৎ করে ঠাণ্ডা লেগে যেতে পারে বলে নানীজানও মানা করলেন। কাজেই একটা অনাকাক্সিক্ষত ঝামেলা থেকে বেঁচে গেলো কুসুম। দুপুরের দিকে সে যখন আবার ভাইয়ের কাছে এসে বসলো তখন তার মনে হলো সকালের নীল রংটা পরিবর্তিত হতে হতে হলুদ হয়ে আবার লাল হয়ে যাচ্ছে। রং বদলের সাথে সাথে শ্বাস কষ্ট বাড়ছিলÑ একটা খিচুনির ভাব দেখা দিয়েছিল।

সারাক্ষণ ছটফট করে কারো কোলেই থাকতে চাইছিল না। বাইরের এই পরিবর্তনগুলো নিয়ে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লেও লাল- সবুজ- হলুদ ও নীলের বর্ণ বৈচিত্র্যের মাঝে একটি স্পষ্ট লাল নীল মৃত্যু হামাগুড়ি দিয়ে খুব কাছে এসে পড়েছিল তা হয়তো কারো চোখেই পড়েনি। বীনু খালার লেপের মধ্যে গুটিসুটি হয়ে ঘুমিয়েছিল কুসুম। মাঝরাতের দিকে কোনো এক সময় ঘুম ভেঙ্গে গেলে তার মনে হলো পাশে বীনু খালার জায়গাটা খালি। বারান্দায় এবং উঠানে অনেকের চলা ফেরার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।

কাছেই কেউ একজন ফিসফিস করে কথা বলছিল। কিন্তু সব ছাপিয়ে পুব দিকের বারান্দা থেকে ভেসে আসে মায়ের কান্নার শব্দ। বিছানা ছেড়ে উঠতে চেষ্টা করে কুসুম। আধো অন্ধকার আর শীতের কারণে সাহস পায়না। এক সময় নিজেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে।

বীনু খালা এসে ভালো করে চাদর জড়িয়ে কুসুমকে যখন মায়ের ঘরে নিয়ে গেলো তখন মায়ের কান্না থেমে গেছে। গালে হাত দিয়ে শূন্য দৃষ্টিতে কোথায় যে তাকিয়ে আছে বোঝাই যায় না। খাটের এক কোনায় বসে মেজমামা ভারী গলায় আস্তে আস্তে কথা বলছিলেন। ‘একটা মাসুম বাচ্চা... যার গায়ে পাপের কুন ুস্পর্শ লাগেনি... আল্লার ইচ্ছায় আমাকেরে এই পাপের পৃথিবীতে জন্মো গ্রহণের সাতদিনের মদ্যে তাঁই তার বেহেশতের বাগিচায় ফিরা গেছে। মনক বুঝদে বুবু... আল্লার অপার মহিমার কথা কে কবার পারে... হয়তো এই অবুঝ শিশুই তোর বেহেশতের কাণ্ডারি হ্যয়া দেখা দিবে...’ কুসুমের মেজো মামা সাদেকুল বাশার মাঝে মাঝে নিরুদ্দেশ হয়ে যান।

কোথায় যান, কি করেন কেউই সঠিক বলতে পারেনা। এবারেও প্রায় দিন পনেরো আগে বেরিয়ে ফিরে এসেছেন আজই মাঝরাতে। সবাই ঘুমিয়েছিল। বীনু খালার ঘুম খুব পাতলা। দরজায় সামান্য টোকার শব্দ শুনে উঠে পড়েছিল।

দরজা খুলে দিয়ে বীনু যখন ফিরে আসছে তখনই পুব দুয়ারি ঘর থেকে ভেসে এসেছিল বুক ভাঙ্গা একটা আর্ত চিৎকার। বড় বোনের কান্না শুনে সাদেক সেই যে তার ঘরে ঢুকে খাটের উপর উঠে বসেছিলেন ফজরের নামাজের আযান পর্যন্ত আর একবারও ওঠেননি। কুসুম কিছুই বুঝতে পারেনি। ঘুম ভাঙ্গা চোখে ফ্যালফ্যাল করে মা এবং মেজমামার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিল। সাদা কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে রাখা ছোট ভাইটাকেও একবার দেখতে ইচ্ছে করছিল।

কিন্তু কাউকে কিছু না বলে বীনু খালার কোলের মধ্যেই আবার কখন ঘুমিয়ে পড়েছে নিজেই জানেনা। সকালে নানীজান যখন কুসুমকে ঘুম থেকে তুলে এনে বারান্দায় দাঁড়ালেন তখন কুয়াশা কাটিয়ে উঠানে এক চিলতে রোদ এসে পড়েছে। পুবের বারান্দায় খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসে আছেন জাহানারা। নানীজানকে দেখে কুসুমের মা একবার শুধু বললেন, ‘এই শীতের সকালে অরাযে ছলটাক গোসল করাবার লিয়া যাচ্ছে, অর ঠাণ্ডা লাগবি না মা?’ পরবর্তী পর্ব: আগামী শুক্রবার ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।