পর্ব/৪
কয়েকদিন থেকেই লাবন্যর কথা খুব মনে পড়ছিল কুসুমের। বিশেষ করে আজ সকালে ঘুম থেকে উঠেই মনে হলো লাবন্যকে একবার দেখতে না দেখতে গেলেই নয়। মাঝে মাঝেই কারো কারো সাথে দেখা করার ইচ্ছেটা এতো প্রবল হয়ে ওঠে তখন দেখা না হওয়া পর্যন্ত চারপাশের সবকিছু অসহনীয় লাগতে থাকে। আজো তেমনি একটা অনুভূতি কুসুমকে পেয়ে বসেছিল। অথচ লাবন্যর সাথে পরিচয় বা জানা শোনা তেমন বেশী দিনের নয়।
মাস তিনেক আগে গেণ্ডারিয়ায় একটা স্কুলের সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় বিচারক হয়ে যেতে হয়েছিল। সেখানেই ওর সাথে প্রথম দেখা। ছোটদের নাচ-গান-আবৃত্তির প্রতিযোগিতায় যা হয় আরকি! সবাই খুব ভালো করছিল। কাকে রেখে কাকে পুরস্কার দেয়া যায় এ নিয়ে ভীষণ দ্বিধায় ছিল কুসুম। সবাইকেই পুরস্কার দিতে পারলেই সে বোধহয় সবচেয়ে খুশী হতো।
এদের মধ্যেই বিশেষ করে চোখে পড়ে গিয়েছিল লাবন্য। চমৎকার গানের গলা আর মিষ্টি চেহারার ছোট্ট মেয়েটা এক মুহূর্তেই কুসুমকে তার ছোট বেলায় ফিরিয়ে নিয়ে যায়।
যতোদিন কুসুম স্কুলে ছিল তাকে ছাড়া কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন সম্পূর্ণ হয়নি। অথচ যতোদূর মনে পড়ে কোথাও সে কোনোদিন গান শেখেনি! তালসোন গ্রামে আব্দুল বাসেত মুন্সীর বাড়িতে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান শেখার কথা কেউ ভাবতেও পারতোনা। তারপরেও গান গেয়েছে কুসুম।
আল্লা রসুলের নামে প্রশস্তি গাথা, আব্বাস উদ্দিনের ইসলামী গান। নানা দিয়ানত আলী খন্দকার ঘুরে ফিরে শুনতে চাইতেন... ‘রোজ হাশরে আল্লা আমার করো না বিচার...। ’ কোথায় শিখেছিল এইসব গান! ভাবতে গেলে একটা কলের গানের কথা মনে পড়ে। চাকা লাগানো গাড়ির উপর লম্বা চোঙ্গাওয়ালা কলের গান বাজিয়ে চুড়ি-ফিতা-আলতা-চিরুণী-সুগন্ধী সাবান সহ কতকিছু ফেরী করতো একটা লোক। বছর পাঁচেক বয়সে একবার গান শোনার নেশায় সেই কলের গানের পেছনে হাঁটতে হাঁটতে হারিয়ে গিয়েছিল কুসুম।
চোঙ্গাওয়ালা কলের গানে একের পর এক বেজে চলেছে...ওকি ও বন্ধু কাজল ভোমরা রে... কোনদিন আসিবেন বন্ধু....’ সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গোসল খাওয়া ভুলে তালসোন থেকে হেঁটে যখন বীর কেদার পর্যন্ত পৌঁছে গেছে তখন দুপুরের রোদের তাপ কমতে শুরু করেছে।
বাড়িতে একটা হুলুস্থুল পড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু আশ্চর্য ঠাণ্ডা মাথায় পরিস্থিতি সামলে নিয়েছিলেন ছোট দাদী। মকবুল আর জোনাব আলী দু’জন দুদিকে সাইকেল নিয়ে খুঁজতে বেরিয়ে গিয়েছিল। তাঁতী পাড়া, খুলু পাড়া, ভেলুর চক সহ কাছাকাছি সব জায়গা খইরকে সঙ্গে করে ঘুরে এসেছেন ছোট দাদী নিজেই।
কুসুমের মা দ্বিতীয় পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়ে, এবারে আর আর পাকুড়গাছায় নয়Ñ তালসোনেই আতুঁড় ঘরে একরকম বিচ্ছিন্ন জীবন কাটাচ্ছিলেন। বিকেলে কুসুম ফিরে আসার আগে জানতে পারেননি কিছুই। কিন্তু সন্ধ্যায় সব শুনে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থেকে আব্দুল বাসেত মুন্সী বলেছিলেন,
‘কুসুমেরতো কুনু দোষ নাই, যার রক্তের মধ্যে বাইরের দুনিয়ার নেশাÑ তার মোন ঘরত থাকে! অর এক মামা গানের নেশাত ঘর ছাড়িচে। কলের গান শুনা কুসুম না হেরালে আর কে হেরাবি!’
কাউকে কিছু না জানিয়ে হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে যাবার ইচ্ছেটা তাহলে কুসুমের রক্তের ভেতরেই ছিল! যদিও এই আকাক্সক্ষা কখনোই পুরোপুরি পূর্ণ হয়নি কিন্তু সারাটা জীবন ধরেই বোধহয় এই অপূর্ণ ইচ্ছেটা সে লালন করে চলেছে। মেজমামা সাদেকুল বাশার কুসুমের ছোটবেলাতেই মাঝে মাঝে নিরুদ্দেশ হয়ে যেতেন।
শেষবার নিখোঁজ হয়ে গেছেন তাও প্রায় পঁচিশ ত্রিশ বছর আগে। বীনু খালার বিয়ের পরপরই মেজোমামা কোথায় যেনো চলে গেলেন আর ফিরে আসেননি। তার এই নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়াÑ সেকি শুধু গান অথবা থিয়েটারের নেশায়, নাকি এর পেছনে অন্য কোনো কারণ ছিল সে রহস্যের সমাধান হয়নি আজও। বহু বছর পরে, কুসুমের দৌলতপুরের বাসায় একদিন হঠাৎ করেই এসে হাজির হয়েছিলেন মেজোমামা। কোথায় কেমন করে ঠিকানা পেয়েছেন, এতোদিন কোথায় কেমন ছিলেনÑ কোনোকিছু জানার আগে যেমন এসেছিলেন তেমনি আবার চলে গেছেন।
দীর্ঘদিন পরে একজন প্রায় অপরিচিত মানুষের অসংলগ্ন কথা বার্তা থেকে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব নয়, তবুও পরিণত বয়সের বুদ্ধি বিবেচনা দিয়ে কুসুম অনুমান করেছিলÑ মেজোমামার নিরুদ্দেশ হবার ব্যাপারটি বীনু খালার সাথে সম্পর্কযুক্ত।
পাকুড়গাছা থেকে সেবার ফিরে আসার সময় বীনু খালা সঙ্গে এসেছিল। নিজের কষ্ট হবে জেনেও নানীজান বীনু খালাকে মেয়ের সাথে পাঠিয়েছিলেন। শোক এবং শরীরের ধকল সামলে উঠতে বেশ কিছুদিন পেরিয়ে গেছে, তবুও পুরোপুরি সুস্থ হননি জাহানারা। গরুর গাড়িতে পুরোটা পথ শুয়ে শুয়ে এসেছেন।
পেছন দিকে ছইয়ের সাথে হেলান দিয়ে বসেছিল বীনু খালা আর গাড়ির পেছনে পেছনে ধীরে ধীরে সাইকেল চালিয়ে আসছিলেন মেজমামা। আলোহালির পুলের উপরে উঠে একটা টমটমকে রাস্তা দেবার জন্যে গাড়ি দাঁড় করিয়েছিল গাড়োয়ান। সেই সময় মেজমামার হঠাৎ করেই কি একটা জরুরী কাজের কথা মনে পড়ে গেলো। মাকে বললেন,
‘আমার এ্যানা হাট শহর যাওয়া খুব দরকারÑ আমি যাই বুবু। ’
মা’র মনের অবস্থা ভালো ছিলনা।
তারপরেও তালসোনে পৌঁছে দিয়ে মেজোমামাকে অন্তত একদিনের জন্য থেকে যেতে বলেছিলেন। ‘আর একদিন অ্যাসা সগলির সাথে দেখা ক্যরা যামো হিনি’ বলে সাইকেল ঘুরিয়ে মেজোমামা উল্টো দিকে চলে গেলেন।
গরুর গাড়িটা পুলের উপর থেকে ঢালুতে গড়গড়িয়ে নামার সময় কুসুম বীনু খালার কোলে মাথা রেখে পা’টা ছইয়ের ভেতরে ছড়িয়ে দিল। সামনে এগিয়ে চলা গাড়ির পেছন দিকের ছইয়ের উপর দিয়ে তখন সিনেমার পর্দার মতো ভেসে যাচ্ছে দৃশ্যের পর দৃশ্য। পাতায় ছাওয়া বট পাকুড়ের ডাল, প্রথম ফাল্গুনের নীল আকাশ, সারি বেধে উড়ে যাওয়া একদল পাখি, কোমরে দড়ি বেধে রাস্তার পাশের লম্বা খেজুর গাছে হাঁড়ি লাগাচ্ছে গাছি।
একের পর এক নতুন নতুন দৃশ্য কেবলই পিছিয়ে যাচ্ছে। নিজের আবিস্কার করা এই নতুন খেলায় মগ্ন হয়েছিল কুসুম। হঠাৎ করেই তার গলার কাছে এসে পড়লো এক ফোঁটা পানি। পরপরই আরো এক ফোঁটা। প্রথমে মনে হয়েছিলো বৃষ্টি নয়তো! বীনু খালার মুখের দিকে তাকাতেই ভুল ভাঙ্গলো।
এতোক্ষণ নিঃশব্দে কাঁদছিল বীনু খালা। ! ছোট মানুষ কুসুমের কাছে ধরা পড়ে একটু হেসে মুখটা মুছে নিল। সেই নিঃশব্দ কান্নার যেমন কোনো কারণ জানা যায়নি, তেমনি মেজোমামার সাথেও সেই ছিল কুসুমের শেষ দেখা।
বাড়ির প্রথম নাতি হবার সংবাদ আব্দুল বাসেত মুন্সীও অনেক দেরীতেই পেয়েছিলেন। তিনি অবশ্য নাতিকে দেখতে পাকুড়গাছা যাবার কথা ভাবেননি।
ভেবেছিলেন ওরা ফিরে এলে খুব ধুমধাম করে আকিকার ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু শেষ খবর যখন পেলেন তখন তার আর কিছুই করার ছিলনা। কুসুমের বাবা খবর পাবার সঙ্গে সঙ্গেই রওনা হয়ে গিয়েছিলেন। পাকুড়গাছা পৌঁছেও গিয়েছিলেন সময় মতো। সেই প্রথম একজন বয়স্ক মানুষকে হু হু করে কাঁদতে দেখেছিল কুসুম।
পরবর্তী জীবনে সেদিনের সেই দৃশ্যের সাথে প্রচণ্ড প্রতাপশালী, অযৌক্তিক একরোখা ও ভয়ঙ্কর রাগী আব্দুর রহমান মুন্সীকে আর কখনোই সে মেলাতে পারেনি। এখনকার কথা অবশ্য ভিন্ন। বাবার কথা ভাবলে বয়সের আগেই বয়সের ভারে ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত একজন অসহায় বৃদ্ধের কথাই মনে পড়ে। তার ভেতরের পরিবর্তনটা সূচিত হয়েছিল
আরো বছর কয়েক আগে। ছোট ছেলে আবুল কালামকে বগুড়া পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটে ভর্তি করে দিয়েছিলেন।
হঠাৎ করেই একদিন কাউকে কিছু না জানিয়ে সে উধাও হয়ে গেল। নিরুদ্দেশ পুত্রের সন্ধানে বিভিন্ন যায়গায় ঘুরে আব্দুর রহমান মুন্সী যখন মানিকগঞ্জে বড় মেয়ের বাড়িতে এসে হাজির হলেন কুসুম অবাক হয়ে দেখেছিল ক্রোধের পরিবর্তে বাবার চোখ মুখে ফুটে উঠেছে হতাশা।
নিরুদ্দেশ হয়ে যাবার ব্যাপারটা হয়তো কারো কারো রক্তের মধ্যেই থেকে যায়। মেজমামার মতো একেবারে নিখোঁজ না হয়ে গেলেও মাঝে মধ্যেই ছয় মাস অথবা সারা বছরই কালামের কোনো খবর থাকেনা। আর কুসুমের মধ্যে নিরুদ্দেশ হয়ে যাবার আকাক্সক্ষা কেবলই ডালপালা মেলে বাড়তে থাকে।
বহু বছর ধরে ভেতরে ভেতরে মনে হয় এই একটি মাত্র ইচ্ছেই সে বহন করে চলেছে। তাই স্বপ্নে জাগরণে, চেতনায় ও অবচেতনে বহুবার ঘুরে এসেছে দেখা অদেখা নদী মাঠ বনভূমি, সাগরের তীর পাহাড়ের চূড়া নগর বন্দর। নিজের পরিচিত জগত, গ্রামের পথ-ঘাট, গাড়ি-পুকুর, রেল স্টেশন স্কুল আর স্কুলের সঙ্গী সাথীদের বাড়ি ঘর প্রায় প্রতিদিনই একবার ঘুরে আসে। কিন্তু বাস্তবে নিরুদ্দেশ হয়ে যাবার পথে পায়ে পায়ে বাধা। একেবারে একাকী হয়তো আর কখনোই কোথাও যাওয়া হবেনা।
কিছু না হলেও একজন সঙ্গীর সার্বক্ষণিক অস্তিত্ব মেনে নিয়ে নিরুদ্দিষ্ট হবার কোনো মানে হয়না। তবুও জীবনে প্রথমবার পরিকল্পিত ভাবে হারিয়ে যাবার সময়েও একজন সঙ্গী খুঁজে বের করতে হয়েছিল। কলের গানের পেছনে পেছনে হেঁটে নিখোঁজ হয়ে যাবার সময় গানের সুর ও সঙ্গীতের আকর্ষণ ছাড়া অন্য কোনো বোধ ভেতরে কাজ করেনি। কিন্তু চৈত্রের দুপুরে স্কুল পালিয়ে ঘন বন জঙ্গলে ঘেরা এক অজানা জলাভূমি আবিস্কারের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল রহস্য রোমাঞ্চের প্রতি সহজাত আকর্ষণ আর হারিয়ে যাবার ইচ্ছা।
কুজাইল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় বাড়ি থেকে প্রায় দু মাইলের হাঁটা পথ।
গ্রাম পেরোলেই ধুধু প্রান্তরের মাঝখান দিয়ে আঁকা বাঁকা আইল। তারপর খানিকটা জঙ্গলে ছাওয়া জলাভূমির ওপারে কয়েক ঘর জেলে তাঁতী মিলিয়ে ছোট্ট একটা পাড়া। আবারো ছোট এক গ্রাম রাইকালি, বাধানো পুকুর ঘাটের পাশ দিয়ে ভাঙ্গাচোরা পায়ে চলার রাস্তা আর ছোট্ট গোটা দুই দোকান ঘর ছাড়িয়ে এক টুকরো ইট বিছানো সড়ক। হাড় পাঁজর বের করা এই রাস্তাই সোজা বড় রাস্তায় পড়েছে। তালসোন গাঁয়ের শেষ প্রান্তে মুন্সীপাড়া থেকে বেরিয়ে মাঠের মধ্যে এসে দাঁড়ালে অনেক দূরে সান্তাহার বগুড়া সড়কে বাস ট্রাক অথবা দু একটা ছোট মোটর গাড়ি দেখা যায়।
ধুলা উড়িয়ে চলে যাওয়া লক্কর ঝক্কর বাস ট্রাকগুলো দূরে থেকে খেলনা বলে মনে হয়। প্রতিদিন স্কুলে আসা যাওয়ার পথে এইসব দৃশ্য কুসুমের কাছে কখনোই পুরোনো হয়নি।
পরবর্তী পর্ব: আগামী শুক্রবার...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।