আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শাহীন দিল রিয়াজের ‘লোহাখোর’, দাসত্বপ্রথা আর রক্ত-ঘামের দলিল

সময়, কবিতা, ছোটগল্প, দেশ, দেশাচার

মিউনিখে প্রতিবছরের নানা সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের মাঝে আন্তর্জাতিক ডকুমেন্টারী ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল একটি বড় ছাঁচের অনুষ্ঠান। সপ্তাহব্যাপী এ অনুষ্ঠানে পৃথিবীর নানা দেশ থেকে সমসাময়িক আঙ্গিকে সাজানো প্রামান্য চিত্র বেশ ঘটা করে শহরের বিভিন্ন সিনেমা হলে প্রদর্শিত হয়। চলচিত্র ও শিল্পানুরাগীরা মহাসমারোষে ভীড় জমান। এবারের অনুষ্ঠান মে মাসের ৩ তারিখ শুরু হয়ে শেষ হয়েছে ১১ই মে। বাংলাদেশের একটি ছবিও স্থান পেয়েছে এবারকার অনুষ্ঠানে।

বার্লিনে ফিল্ম নিয়ে পড়াশোনা করেছেন শাহীন দিল রিয়াজ। তারই ফলশ্রুতিতে এবারকার অনুষ্ঠানে তার এই উত্তরণ। চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড এলাকায় জাহাজ কাটা শ্রমিকদের অতি কাছাকাছি ছ’মাস থেকে অক্লান্ত পরিশ্রমে তাদের কর্মক্ষেত্র ও তাদেরকে নিয়ে তৈরী করা প্রামান্য চিত্রে তাদের প্রতিদিনের জীবনকে তুলে ধরেছেন। শাহীন দিল রিয়াজ ছবিটির নাম দিয়েছেন লোহাখোর। জীবনের তাড়নায়, অভাবে আক্রান্ত মানুষ তাদের শারীরিক সুস্থতা ও জীবন বিপন্ন করে এই আধুনিক প্রযুক্তির পৃথিবীতে একটি পুরোনো জাহাজ শুধুমাত্র আসুরিক শক্তির জোরে যে ভাবে ভেঙ্গে লোহার পাতে পরিনত করেন, তা সামনে রেখে এই নামকরণ অবশ্যই স্বার্থক।

প্রতিবছরই বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে খরায় মঙ্গাকবলিত হয় ওখানকার খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। নিজেদের ক্ষুধার জ্বালায়, অনাহারী শিশু সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে পুরুষরা তাদের প্রিয়জন ছেড়ে পাড়ি জমান দক্ষিনে, এই জাহাজ ভাঙ্গার কারখানায়। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর পুরোনো, বাতিল হয়ে যাওয়া, নোংরা ও বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থে পরিপূর্ন বড় বড় জাহাজের সমাধিস্থল তৃতীয় বিশ্বের বাংলাদেশের এসব কারখানা। অক্লান্ত পরিশ্রমে নিজেদের জীবন বাজি রেখে জাহাজ কেটে লোহার পাতে পরিনত করেন এসব শ্রমিক। এই লোহার উপর ভিত্তি গড়ে বড় বড় শহরের বিশাল ইমারত।

বিদেশেও রপ্তানী হয় । টাকায় ভারী হয় কিছু লোকের পকেট। কিন্তু এসব শ্রমিকের ভাগে কি জোটে? মাথায় হেলমেট নেই, পায়ে জুতো নেই, যারা ওয়েল্ডিং করেন, তাদের কোন নিরাপত্তা নেই। ডাক্তার নেই, স্ট্রেচার নেই। বিষাক্ত গ্যসের মাঝে কাজ করতে হলেও কোন মুখোশ থাকে না তাদের।

ভারবাহী পশুর মতো লোহার ভারী ভারী রশি টেনেটেনে জাহাজে বাঁধেন এসব শ্রমিক। সারাদিনের বেতন আশি টাকা। প্রতিদিন কাজের নিশ্চয়তা নেই, এমনকি কাজের শেষে পারিশ্রমিকের নিশ্চয়তাও নেই । কিন্তু কাজ থেমে থাকলেও ক্ষুধা থেমে থাকে না। তাতে যা খরচ হয়, সেটা হিসেব করে অনেক শ্রমিককেই মৌসুমের শেষে খালি হাতে বাড়ী ফিরতে হয়।

তাছাড়া মালিক ও তাদের মোসাহেব ও পাতি মোসাহেবদের অর্থলালসার শিকার হয়ে প্রাপ্য পাওনাও মেটেনা তাদের, এমন কি বাড়ী ফেরার ভাড়াও থাকেনা তাদের। স্থানীয় এলাকার শ্রমিকদের চেয়েও আরো বেশী কঠিন আবস্থা দেশের উত্তরাঞ্চলের শ্রমিকদের। সবচেয়ে কঠিন ও বিপদজনক কাজগুলো তাদের ভাগেই পড়ে। কারখানার মালিকদের গালভরা বুলি থাকলেও শোষক চরিত্রের নগ্নতা দর্শকদের সামনে স্পষ্ট প্রকাশিত। এখানে আবহ নির্মানে শাহীন দিল রিয়াজ স্বার্থক।

তাকে মালিকদের কথা তুলে কোন কথা, সমালোচনা করতে হয়নি। শ্রমিকদের বিপদজনক প্রতিটি দিন, তাদের প্রতি অমানবিক ব্যবহার ও তার পাশাপাশি মালিকের বড় বড় বক্তৃতা দর্শকদের সামনে মালিককেই অবিশ্বাসযোগ্য ও হাস্যকর চরিত্র হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। তাদের সুরতী ও আলখাল্লা টুপী পড়া স্বর্গীয় চেহারা দর্শকদের ভেতরে সামান্যতমও বিশ্বাস জাগাতে সক্ষম হয়নি। ছবির বিষয়বস্তু আকর্ষনীয় ও সময়োপযোগী হওয়ায় দর্শকপরিপূর্ণ হলে প্রদর্শিত হয় শাহীন দিল রিয়াজের লোহাখোর। নির্মানে মুন্সীয়ানা ও পরিবেশনে আন্তরিকতা দর্শকদের মন ছুঁয়েছে।

ছবি শেষে পর্দার সামনে দাঁড়ানো পরিকালকের সাথে আগ্রহী ও প্রানবত্ত আলোচনায় অংশ নিয়েছেন অনেক দর্শক। ছবি তৈরী ও সামাজিক আবহের খুটিনাটি বিষয় নিয়ে দর্শকদের এই আগ্রহ পরিচালকের সাফল্যের প্রমান। শাহীন দিল রিয়াজের এ ছবিটি এই জাহাজ কাটা শ্রমিকদের প্রতিদিনের জীবন, জীবিকাকে আলোকপাত করেছে। কিন্তু এই জাহাজকাটা কারখানার প্রভাবে এই এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশের যে ভয়াবহ ক্ষতি, তার উপর তীর্যক কোন আলোকপাত করে নি। এ বিষয়ে দর্শকদের প্রশ্নের উত্তরে শাহীন জানান, সমস্যাকে একটি বিষয়ে জোরালো কেন্দ্রীভুত করার জন্যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই এ টি করা হয়েছে।

পারিবেশিক চিন্তার আঙ্গিকে এ সমস্যাকে ঘিরেই আরেকটি ছবি করবেন বলে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন পরিচালক। বাংলাদেশের প্রচারমাধ্যমে এ ছবিটির প্রদর্শন জনসাধারণের সচেতনতাকে বাড়িয়ে তোলার প্রয়াসে একটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হিসবে কাজে লাগানো যেতে পারে। মিউনিখের এই ফেস্টিভ্যালের এক সপ্তাহ পরই ছবিটি ফ্রাংকফুর্টের কাছাকাছি আর্নোল্ডসহাইন নামক এক শহরে উনিশতম আন্তর্জাতিক প্রামান্যচিত্র প্রতিযোগীতায় প্রদর্শিত হয়। সেখানে পরিচালক হিসেবে ওখানকার প্রদেশীয় সরকারের পক্ষ থেকে প্রথম পুরস্কান অর্জন করেন শাহীন দিল রিয়াজ। লোহাখোর নির্মানে সহপরিচালক হিসেবে শাহীন দিল রিয়াজকে সহযোগীতা করেছেন শবনম ফেরদৌসী।

যেহেতু শাহীন নিজেই পরিচালনার পাশাপাশি ক্যমেরার কাজ করে থাকেন, তাই দ্বিতীয় ইউনিট ক্যমেরার দ্বায়িত্বে ছিলেন লরেন্স অপু রোজারিও। শব্দগ্রহন করেছেন আবদুস সাত্তার রিপন তার সঙ্গী মেজবাহউদ্দীন ফিরোজের সহযোগীতায়।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.