অন্তরের আলোয় দেখেছি যারে - ৪
কৃত্রিম ব্যস্ততা আর চটকদার বিজ্ঞাপণের ঠুনকো চাকচিক্যে মোড়া এই শহর থেকে ছুটি মিলেছে বেশ কদিনের জন্য। উত্তরবঙ্গের হিম হিম ঠান্ডায় ভোরে খেজুড়ের রস, দিনভর কুয়াশার আড়াল, সূর্যের ইতস্ততঃ লুকোচুরি, ইচ্ছেমত দেরী করে ঘুম থেকে ওঠা, গরম কাপড়ের মাঝে মৃদু উষ্ণতা খুঁজে পাওয়া, ধুমায়িত ভাপা পিঠা, ঘন দুধের পায়েস আর টাটকা শাক-শব্জি। এছাড়াও বাড়তি পাওনা হিসেবে উৎসবমুখর আয়োজনে আত্মীয়-পরিজন ও বন্ধু-স্বজনদের সাথে একসাথে মিলিত হওয়া। প্রায় ভুলতে বসা সেই সব আলো ঝলমলে দিনের কাছে আবার ফিরে যাওয়া। এই সবকিছুর মাঝে যা কিছু আনন্দের, যা কিছু সুখের, যা কিছু আর্শীবাদের তার খানিকটা তোলা রইলো এক মানবীর জন্য।
আমার আঁজলাভরা আবেগ আর মন কেমন করা অনুভবের সামান্য ছোঁয়া রেখে দিলাম কেউ গ্রহণ করবে সেই আশায়।
আজকাল যেখানেই যাই, যেভাবেই থাকি মন খারাপ করা অনুভূতিটা সব সময়ই জেগে থাকে। শহুরে জীবনের আবেগবর্জিত যান্ত্রিক নিষ্পেষনে মনটা কেমন থিতিয়ে থাকে। মানুষের সাথে মিশতে গিয়ে দেখি কোথাও নেই আমার সেই আরাধ্য পটভূমি। তাই যতটা পারা যায় ভদ্রতাসূচক মেলামেশার একটা স্তর বেঁধে দেই, বেঁধে দেই মানসিক দূরত্বের একটা অদৃশ্য সীমারেখা।
সেই সীমারেখার একদিকে আমি একা পরে থাকি। ঈশ্বরের মতই নিজেকে তখন একা মনে হয়। আগে যেমন খারাপ লাগতো এখন আর লাগেনা। বরং নিজের এই একাকীত্বটুকু উপভোগ করি একান্তই নিজের মত করে। কোন চাওয়া নেই, পাওয়া নেই, নেই কোন দাবিদাওয়া, নেই স্বার্থের লেনদেন- শুধুই অবাক শূন্যতা।
এই শূন্যতায় নিজেকে ঠিক কাগজের নৌকার মতো ভাসিয়ে দেই মনের মত করে সাজিয়ে।
জীবনকে বুঝতে শিখি অতীতের ফেলে আসা ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো পরখ করে। নিজের জানা অজানা ভুল-ত্রুটিগুলোর হিসেব কষি। যা হবার কথা ছিল- তা কেন হলোনা, কোন মুহূর্তের ভুলে বা কোন কারণে তা হলোনা তাই নিয়ে ভাবি। ভাবি কোথায় যাব, কোথায় যেয়ে শেষ হয়েছে আমার অনিশ্চিত গন্তব্য, কোথায় কোন সরোবরে আমার জন্য অপেক্ষা করছে কাঙ্ক্ষিত সেই নীলপদ্ম কিংবা আদৌ কেউ অপেক্ষা করছে কিনা- কল্পনায় ভাবতে থাকি সেসব কথা।
চলে যাওয়া সময়ের জন্য ছিপছিপে হাহাকার কখনো যে মনে জেগে ওঠে না, তা নয়। তবে কিছু পাওয়ার আশায় মন সবসময়ই উন্মুখ থাকে। মানুষের বেঁচে থাকার রহস্যটা হয়তো সেখানেই।
তবে এখন বুঝতে পারি নিজের একাকিত্বের সাথে হাহাকার মেশালে জীবনের রঙ কেমন যেন ফিকে হয়ে যায়, অনেক বেশী বিবর্ণ হয়ে যায়। তাই সযতনে পাশ কাটিয়ে চলি জমানো কষ্টের তীব্রতাকে।
মাঝে মাঝে সুখের ক্ষণস্থায়ী বুদ্বুদগুলো হতাশায় ফেটে পরে, কিছু আকাঙ্ক্ষা বানের জলের মত ভেসে আসতে চায় কচুরীপানার মত, বাঁধ ভাঙ্গা স্রোতের মত এলোমেলো করে দিতে চায় আমার কাঙ্খিত বাসনাকে, জাগিয়ে দিতে চায় হৃদয়ে লালিত সুখের পায়রাকে। তখন নতুন করে লড়াই করতে ইচ্ছে হয়। এ যেন নিজের সাথে নিজেরই এক অসম লড়াই। সুখ ও একাকিত্বের লড়াই। এ লড়াইয়ে কোন রক্তক্ষয় নেই, নেই কোন হারজিতের বালাই।
নিজের কাছে নিজের হারা বা জয়ী হওয়ায় কোন গৌরব বা আত্মগ্লানি খুঁজে পাইনা। এখানে কেউ জয়ের মুকুট কেউ পড়াতে আসবে, আসবেনা কাঁটার মুকুট পরাতে। একদিকে বিষন্নতার আর্তনাদ, অন্যদিকে মানিয়ে নেয়ার প্রবল চীৎকার। মাঝে মাঝে হেরে যাই, দিশেহারা হই, ক্লান্তি পেয়ে বসে। তবুও চেষ্টা করি, কোনকিছু পাত্তা না দিতে।
অপেক্ষা করি সহ্য ও ধারণের, সময়ের প্রলেপ পরার। এভাবে কতশত প্রলেপ দিয়ে ঢাকতে হয় হৃদয়ের অবিরাম রক্তক্ষরণ- কে রাখে তার হিসেব?
দিনের এলোমেলো ভাবনাগুলো রাত গভীরে থিতু হয়ে আসে। চারিদিকে যখন নিস্তব্ধতা নেমে আসে, রাতের শূন্য আকাশের কোল জুড়ে জেগে থাকে কিছু নির্ঘুম নক্ষত্র। পৃথিবী তার সকল কোলাহল আর কষ্ট বুকে নিয়ে একাকী নীরবে পালন করে যায় নিজ দায়িত্ব। ঠিক তখনি হঠাৎ বুকের গোপন কোণ থেকে বেরিয়ে আসে একটা অতৃপ্তির দীর্ঘ নিঃশ্বাস, একটা নির্বাক হাহাকার।
কেমন যেন মন খারাপ করা অনুভূতির ঢেউ। মনে হয় কোথায় যেন রয়ে গেল বিরাট এক শূন্যতা, কোথায় যেন বাকি রয়ে গেল অনেক কিছু।
চলবে-
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।