ঢাকা সিএমএম কোর্ট থেকে ডিবির গাড়িতে আমরা রওনা দিলাম নাজিমউদ্দিন রোডে অবস্থিত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। গাড়ির সামনে-পিছে এবং দুই পাশ সাংবাদিকদের গাড়ি ক্যামেরা নিয়ে ছুটছিল। কিছু সাংবাদিক মোটরসাইকেলে করে অনুসরণ করছিলেন। কোনো রাস্তায় ট্রাফিক জ্যামের কারণে গাড়ি থামলেই তারা হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন ছবি তোলার জন্য। যদিও কালো গ্লাসের কারণে তারা আমাকে দেখতে পাচ্ছিলেন না। কিন্তু আমি তাদের সব কিছুই দেখছিলাম। বেশির ভাগ সাংবাদিক ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত হওয়ার কারণে তারা জোরে জোরে রনি ভাই রনি ভাই বলে চিৎকার করে তাদের ক্যামেরার দিকে তাকানোর জন্য অনুরোধ করছিলেন। আমার মনে হলো এরা কেন্দ্রীয় কারাগারের ফটক পর্যন্ত আমার সঙ্গে যাবেন।
আমাদের গাড়ি যখন ইংলিশ রোড অতিক্রম করছিল তখন রাস্তার দুই পাশে শত শত লোক দাঁড়িয়ে এমপি সাব এমপি সাব বা স্যার স্যার বলে চিৎকার করছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম না তারা কারা? ডিবি কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসা করলাম। তারা বললেন সম্ভবত আমার নির্বাচনী এলাকার মানুষ। এ এলাকার দোকানগুলোয় আমার এলাকার অনেক লোক কাজ করেন তা আমি জানতাম কিন্তু ঘটনার আকস্মিকতায় সম্ভবত তা ভুলে গিয়েছিলাম। কর্মকর্তাদের অনুমতি নিয়ে আমি গাড়ির গ্লাস নামিয়ে তাদের উদ্দেশে হাত নাড়ালাম। তারা পাগলের মতো ছুটে এলো এবং আমার হাতে চুমো খেয়ে কাঁদতে লাগল। তাদের সান্ত্বনা দেওয়ার কোনো ভাষা ছিল না। তথাপি মনে একটু হলেও শক্তি ফিরে পেলাম এই তো আমার ভোটাররা আমাকে ভালোবাসে। ইংলিশ রোড পেরিয়ে আমরা বংশাল রোডে প্রবেশ করলাম। সেখানেও একই দৃশ্য। রাস্তার দুই পাশে শত শত মানুষ দাঁড়িয়ে আমার উদ্দেশে হাত নাড়ছিল আর রনি ভাই রনি ভাই বলে চিৎকার করছিল। গাড়িতে আমার সঙ্গী ডিবি কর্মকর্তারা এই অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখে ভারি আশ্চর্য হয়ে গেলেন।
অনেক কসরৎ আর অনাহূত ঝামেলা পোহানোর পর আনুমানিক ৪টার দিকে আমাদের গাড়ি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের গেটে পেঁৗছল। কারারক্ষীদের কাছে আমাকে হস্তান্তরের পর ডিবির কর্মকর্তারা প্রথমে হ্যান্ডশেক এবং পরে কোলাকুলি করে আমার কাছ থেকে বিদায় নিল। তারা আমার অনেক প্রশংসা করল এবং আমি যাতে তাড়াতাড়ি বিপদমুক্ত হতে পারি সে দোয়া করল। তাদের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার পর আমি কারাগারের মধ্যে ঢুকলাম। আমার মন তখন দ্বৈরথে চড়ে বেড়াচ্ছিল। আমি একদিকে যেমন ছিলাম শঙ্কিত তদ্রূপ রোমাঞ্চিত ছিলাম বহু কারণে। সে ঘটনার ইতিবৃত্ত সংক্ষেপে বলছি।
ঢাকা শহরে আছি বহু বছর। অনেকবার কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে দিয়ে পুরান ঢাকার চকবাজারে গিয়েছি। চকবাজার এবং আশপাশের কয়েকটি ব্যবসায়িক এলাকার নামকরা আমদানি কারকের সঙ্গে আমার ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল। পুরান ঢাকার এসব এলাকায় গাড়ি নিয়ে যাওয়া অসম্ভব। রিকশাই একমাত্র বাহন। কিন্তু মাঝে-মধ্যে এমন রিকশাজ্যাম লাগত যে, পায়ে হেঁটেই গন্তব্যে যেতে হতো। এভাবে বহুবার কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে দিয়ে রিকশায় করে বা পায়ে হেঁটে আমি অতিক্রম করেছি। জেলখানা সম্পর্কে আমার অস্বাভাবিক ভয় ছিল। বহু কল্পকাহিনী শুনতাম জেলজীবন নিয়ে। সেখানে ভয়ানক সন্ত্রাসীরা সিন্ডিকেট করে থাকে এসব লোকদের হুকুমেই নাকি জেল চলে। নতুন কোনো আসামি জেলে ঢুকলে এসব সিন্ডিকেট প্রাথমিকভাবে নাকি নানারকম হয়রানি করে। এ ছাড়া বিভিন্ন চলচ্চিত্রেও এসব দৃশ্য দেখেছি একাধিকবার। ফলে জেলের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আল্লার কাছে প্রায়ই দোয়া করতাম, 'হে আল্লাহ তুমি আমাকে এমনভাবে হেফাজত কর, যেন কোনোদিন জেলখানায় না আসতে হয়।'
অন্যদিকে রোমাঞ্চিত হওয়ার আরও কারণ ছিল। এমপি হওয়ার পর আমার সহকর্মীরা প্রায়ই জিজ্ঞাসা করত_ কিরে ব্যাটা জেল খেটেছিস কয়বার। আমি বলতাম, একবারও না। ওরা বলত বলিস কিরে পোলাও খাওয়া মজনু। এটা আবার কেমন কথা, পোলা খাওয়া মজনু হলাম কিভাবে। আমার উত্তর শুনে তারা আমাকে বোকা গোবেচারা ভাবতো এবং বলত জেল না খাটলে সত্যিকার রাজনীতিবিদ হওয়া যায় না। ওদের কথা শোনার পর মাঝে-মধ্যে মনে হতো অন্তত একবার জেলে গেলে মন্দ হয় না। কিন্তু কিভাবে যাব? উপায় খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আজ যে কোনো উছিলায় জেলখানায় ঢোকার সুযোগ পেলাম, ভাবতেই বেশ রোমাঞ্চিত বোধ করছিলাম।
আমাদের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারটি বহু পুরনো এবং ধারণ ক্ষমতার চেয়ে কযেকগুণ আসামি ধারণ করছে। কাজেই ভেতরে নানা অব্যস্থাপনা দেখব, এটাই স্বাভাবিক। এ ছাড়া এর আগে ব্রিগেডিয়ার জাকির হাসান যখন আইজি প্রিজন এবং মেজর শামসুল হায়দার চৌধুরী ডিআইজি ছিলেন, তখন তাদের সম্পর্কে অনেক ভালো ভালো কথা শোনা যেত। তারা নাকি দেশের কারাগারগুলোতে অনেক পরিবর্তন এনেছিলেন এবং বন্দীদের অশেষ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা অর্জন করেছিলেন। অন্যদিকে বর্তমান আইজি এবং ঢাকার জেলার সম্পর্কে বহু বাজে কথা শোনা যায়। তাদের নিয়োগ শতভাগ দলীয় বিবেচনায় হয়েছে এবং তাদের চলাচলনেও তারা সেই বাহাদুরি জাহির করে চলে। তার নমুনা পেলাম জেলে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে। কারারক্ষীরা যে যার মতো চ্যাগর-ব্যাগর করে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হচ্ছে না, তারা কোনো সুশৃঙ্খল বাহিনীর সদস্য।
মূল ফটক বা সিংহ দরজা পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উৎকট গন্ধ নাকে এলো। এটা কি কাছ দিয়ে বয়ে যাওয়া ময়লার ড্রেন থেকে আসা গুয়ের গন্ধ, নাকি চ্যাগর ব্যাগরভাবে দাঁড়িয়ে থাকা কারারক্ষীদের ত্যাগ করা বায়ুর গন্ধ! গন্ধের ধরন বুঝতে না পারার জন্য বেশ ভালোই লাগছিল। কারণ এখানে অনুভূতি যত ভোঁতা হবে ততই ভালো। কারারক্ষীরা আমাকে হুকুম করল ডানদিকে অগ্রসর হওয়ার জন্য। আমি সুবোধ বালকের মতো তাদের অনুসরণ করলাম। ২/৩টা রুম পার হাওয়ার পর একটি বড়সড় রুমে ঢুকলাম। উপরে টিনের চালা এবং চালার নিচে স্টিলের ফ্রেমের সঙ্গে লাগানো কয়েকটি ফ্যান খট খট করে ঘুরছিল বিকট আওয়াজ করে। আর ফ্যানগুলো যে বাতাস উৎপন্ন করছিল তা ছিল মরুভূমির লু হাওয়ার মতো উত্তপ্ত। সঙ্গে বোনাস হিসেবে আগেকার বর্ণিত দুর্গন্ধ তো ছিলই।
রুমটিতে জনা বিশেক লোক দাঁড়িয়ে ছিল ৩/৪টি টেবিলের সামনে। টেবিল নিয়ে যারা বসেছিলেন তারা সবাই ডিপুটি জেলার পদ মর্যাদার। কোর্ট থেকে কোনো আসামি এলে প্রথমে এই রুমে আনা হয়। এরপর কাগজপত্র পরীক্ষা করে আসামির দেহ ও মাল-সামানা তল্লাশি করা হয়। এরপর সে কত নম্বর সেলে থাকবে তার নম্বর বসানো হয়। পরিশেষে একজন জমাদ্দার বা সুবেদারের তত্ত্বাবধানে আসামিকে কারা অভ্যন্তরের সংশ্লিষ্ট সেলে পাঠানো হয়। প্রায় ৫/৬ মিনিট দাঁড়িয়ে থেকে আমি এসব দৃশ্য দেখলাম এবং তাদের কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা পেলাম। আমার দিকে কারও খেয়ালই ছিল না। আমাকে বহনকারী জমাদ্দার লোকটা আমার মতো ক্যাবলা প্রকৃতির ছিল। ডিপুটি জেলারদের সে সম্ভবত বাঘের মতো ভয় করে। কাজেই তাদের সামনে যে একজন সরকারি দলের অসহায় এমপি জাতীয় আসামি দাঁড়িয়ে আছে সেই কথাটি জমাদ্দার সাহেব ডিপুটি জেলারদের বলতে সাহস পেল না। আশপাশের আসামিরা বাঁকা চোখে আমাকে দেখছিল। তারা বুঝতে পারছিল না, আমি কি আসামি না জেলের কোনো নতুন কেরানি। আমি বোকার মতো ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম এবং আবোল-তাবোল চিন্তাভাবনা করতে লাগলাম।
আমার এই বিব্রতকর অবস্থায় জনৈক ডেপুটি জেলার এগিয়ে এলেন। তরুণ বয়সী এবং তিনি আমাকে চিনতেন। তার বাড়ি নাকি আমার নির্বাচনী এলাকার পাশের থানায় অর্থাৎ বাউফলে। তিনি দয়া করে আমার জন্য প্লাস্টিকের একটি চেয়ারের ব্যবস্থা করলেন এবং যত দ্রুত সম্ভব আমার কাগজপত্র ঠিক করার কাজে লেগে গেলেন। অবশেষে জেলের ভেতরে যাওয়ার অনুমতি মিলল। আমার একটি মাত্র ছোট হ্যান্ড ব্যাগ ছিল। কারারক্ষীরা তন্ন তন্ন করে তা খুঁজে দেখল। আমার পকেটে কোনো টাকা আছে কিনা তা জিজ্ঞাসা করল। আমি বললাম ৯৫০০ টাকা আছে। টাকাগুলো কারা গেটে জমা দিতে হলো। জেলের নিয়মমতো কোনো টাকা পয়সা ভেতরে নেওয়া যাবে না। আমার জমাকৃত অর্থ পিসি নামক একটি ফান্ডে জমা থাকবে যা কিনা পরবর্তী সময়ে বের হওয়ার সময় ফেরত দেওয়া হবে। অন্যদিকে জেলের ভেতরে কিছু কিনতে চাইলে পিসির ফান্ড থেকে তা ব্যয় করা যাবে।
কারারক্ষীর সঙ্গে জেল থানার ভেতরে ঢুকলাম। প্রথমেই দেখলাম ৩০/৪০ জন হিজড়াকে বসিয়ে রাখা হয়েছে। তাদের উদ্দেশে ২/৩ জন কারারক্ষী যেন কি সব বক্তৃতা দিচ্ছিল। হিজড়ারা সবাই আমার দিকে তাকাল। আমি রীতিমতো অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়লাম। ভয়ও পাচ্ছিলাম। হিজড়রা রাস্তায় খুব উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করে। তারা দলবেঁধে চলে এবং পথচারীদের বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেয়। পুলিশও তাদের ভয় পায়। আমি রাস্তায় চলতে গিয়ে হিজড়াদের দেখলে সব সময় কয়েকশ গজ দূরে থাকি, মূলত একটি ঘটনা শোনার পর। এক ভদ্রলোক বাজার করতে এসেছেন গাউছিয়া মার্কেটে। প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে লোকজনের ধাক্কা-ধাক্কিতে ভদ্রলোকটি একটি হিজড়ার সঙ্গে ধাক্কা খান। অনিচ্ছাকৃতভাবে ভদ্রলোকের হাত হিজড়াটির বুকের ওপর পড়ে। আর যায় কোথায়। মহাবীর হিজড়া ভদ্রলোকের হাতটি চেপে ধরল। তারপর বলল এখানে হাত দিস কেন? আয় তোকে আসল জায়গা দেখিয়ে দেই। বলেই ভদ্রলোকের হাতটি টেনে নিয়ে হিজরাটির লজ্জাস্থানে কয়েকবার ঘষে দিল। ভদ্রলোকের তখন মরিমরি অবস্থা। উপস্থিত জনতা কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে এলো না। বরং দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দাঁত বের করে হাসতে হাসতে তামাশাটি প্রাণভরে উপভোগ করল।
যথাসম্ভব দ্রুততার সঙ্গে হিজড়াদের ভিড় এড়িয়ে গন্তব্যে রওনা করলাম। জীবনের প্রথম জেল- তাও আবার ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার। শত শত লোক বিভিন্ন ওয়ার্ডের সামনে পায়চারি করছে। অনেকে আবার দলে দলে বসে কিসব যেন শুনছে। আশ্বর্য ব্যাপার হলো_ উপস্থিত শত শত বন্দী প্রায় সবাই আমাকে চিনল। অনেকে, রনি ভাই বলে চিৎকার শুরু করল। কেউ কেউ এগিয়ে এসে হ্যান্ডশেক করল এবং আমার প্রতি সহমর্মিতা জানাল। আমি যে আজ জেলখানায় আসব তারা নাকি তা পত্রপত্রিকার মাধ্যমে আগেই জেনেছিল। আমি অবশ্য এতসব জানতাম না। গ্রেফতারের আগে কয়েকদিনের মানসিক চাপও ব্যস্ততার কারণে ঠিকমতো পেপার পড়া হয়নি।
সিটিং এমপি হিসেবে আমাকে কারাগারে ডিভিশন প্রদান করা হয়েছিল। ২৬ নং সেলই হলো ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ঐতিহাসিক ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দীদের থাকার স্থান। সাম্প্রতিককালে সেলটির নামকরণ করা হয়েছে চম্পাকলি। আমাকে চম্পাকলিতে নিয়ে যাওয়া হলো। ব্রিটিশ বা তারও আগের পুরনো একতলা একটি জরাজীর্ণ বিল্ডিং। বেশ কয়েকটি রুম খালি ছিল। আমাকে ১ নং বা ২ নং রুমে রাখার প্রস্তাব হলো। ডিভিশন সেলে তখন সাত জন বন্দী ছিলেন। অভিনেত্রী শম্পা রেজার ভাই আজম রেজা, এনএসআইয়ের সাবেক দুই ডিজি, ১/১১ এর সময় আলোচিত প্রধান বন কর্মকর্তা আবদুল গনি, সাবেক মন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, জনৈক ডাক্তার এবং আরও একজন। সবাই আমাকে স্বাগত জানালেন বেশ আন্তরিকতার সঙ্গে। তারা আমার সম্পর্কে পূর্ব থেকেই জানতেন এবং তাদের কথাবার্তায় মনে হলো তারা আমার জন্য বিপদের কারণ হবেন না। সবাই মিলে আমাকে সাত নম্বর রুমে থাকার পরামর্শ দিলেন। সাত নম্বর রুমে নাকি দীর্ঘদিন দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী থাকতেন। ৭ নম্বর রুমটি যথেষ্ট অপরিচ্ছন্ন ছিল। দুজন সেবক খুব দ্রুততার সঙ্গে তা পরিষ্কার করতে শুরু করল। আবদুস সালাম পিন্টু সাহেব তার রুম থেকে স্যাভলনের বোতল বের করে দিলেন এবং সেবকদের নির্দেশ দিলেন পুরো রুম স্যাভলন দিয়ে পরিষ্কার করার জন্য। আমি পিন্টু ভাইয়ের আন্তরিকতায় মুগ্ধ হলাম। রুম পরিষ্কার হওয়ার পর আমি ভেতরে ঢুকলাম। ছোট একটি চিলেকোঠা। এক কোণায় এটি চৌকি, একটি পড়ার টেবিল এবং সংলগ্ন একটি বাথরুম। রুমের দেয়াল থেকে প্লাস্টার খসে পড়ছিল। তাই পলিথিন দিয়ে ওয়ালটি ঢেকে রাখা হয়েছিল। রুমে একটি লাইট এবং বাথরুমে একটি লাইট। ওসবের দিকে তাকানোর সময় ছিল না। কারণ সারা শরীর ঘামে এবং ঘামের দুর্গন্ধে একাকার হয়ে গিয়েছিল। কাজেই গোসল করাটা তখন ছিল সবচেয়ে জরুরি। বাথরুমে গিয়ে আচ্ছামতো শাওয়ার ছেড়ে অনেকক্ষণ ধরে গোসল করলাম। এরপর রুমের সামনের বারান্দায় বসলাম। আসরের নামাজের ওয়াক্ত হয়ে গিয়েছিল। পিন্টু ভাই আমাকে একজোড়া স্পঞ্জের স্যান্ডেল এবং একটি টুপি দিলেন। আমরা জামাতে আসরের নামাজ পড়ে গল্প করতে বসলাম। আলোচনার শুরুতেই আমরা একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হয়ে নিলাম। সবাই তাদের গ্রেফতার হওয়ার কারণ এবং সরকারের জুলুম ও নির্যাতন নিয়ে নানান কথা বললেন। বিশেষত এনএসআই-এর সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী কথা বলতে বলতে অঝোরে চোখের পানি ফেললেন। তারপর আমার প্রসঙ্গ টেনে সরকারের আরেক দফা সমালোচনা করলেন। আমি কেবল শুনে যাচ্ছিলাম এবং ক্লান্তিতে বারবার হাই তুলছিলাম। আজম রেজা বললেন, চলেন রনি ভাই সামনে দিয়ে একটু ঘুরে আসি- আপনার ক্লান্তি দূর হবে। চম্পাকলি সেলের সামনে দিয়ে হাঁটার জন্য ওয়াক ওয়ে রয়েছে। সেলের সামনেই একটি রান্নাঘর যেখানে ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দীদের রান্না একসঙ্গে হয় এবং প্রতিটি সেলে সময়মতো পেঁৗছে দেওয়া হয়। আজম রেজার মতে খাবার দাবার একেবারে মন্দ না। মোটামুটি চলে। তবে পিসি থেকে মাঝে মধ্যে পছন্দের জিনিস কিনে আনলে বাবুর্চি রান্না করে দেয়। আমি সেই দিনের ইফতারির আয়োজন দেখলাম। পিয়াজু, বুট, মুড়ি ইত্যাদি।
আজম রেজার সঙ্গে প্রায় ৩০ মিনিট হাঁটলাম। তার কষ্টের কথা জানলাম। আমি জিজ্ঞাসা করিনি। সেই বলল তার দাম্পত্য কলহের সময় হঠাৎ করেই ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাটির কথা। লেখাপড়ায় তাদের পুরো পরিবারটিরই যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। সে নিজেও দেশের বাইরে থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েছেন এবং বাংলাদেশে আমেরিকান এঙ্প্রেস ব্যাংকে উঁচু পদে চাকরি করতেন। বাংলাদেশের পরিচিত এক অভিনেত্রীর সঙ্গে তার সম্পর্কের বিষয়টি পত্রপত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছিল। আমি সে ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন করা সংগত মনে করলাম না। আমরা বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর পুনরায় গল্প করতে বসলাম। আমি ছিলাম নতুন অতিথি। কাজেই সবারই ছিল আমাকে নিয়ে ব্যাপক কৌতূহল। সবাই আমার সঙ্গে অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু এরই
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।