মাঝে মাঝে বৃষ্টি দেখে হাত বাড়ানোর ইচ্ছে জাগে... ভেতর ভেতর যাই পুড়ে যাই, কেউ জানেনা আমার আগে...
১.
আমজাদ সাহেব ভয়ে 'লাবড়া' হয়ে আছেন।
তার মনে হচ্ছে তিনি ঠিকভাবে কিছু চিন্তা করতে পারছেন না। তার মাথা জুড়ে অজস্র চিন্তা গিজগিজ করছে, কিন্তু তিনি কোনটাই আলাদা করতে পারছেন না। নিজের মগজকে মনে হচ্ছে লাবড়া জাতীয় পদার্থ। লাউ, মিষ্টি কুমড়া, পেপে, বেগুন, আলু, ঝিঙে, পটল সব একসাথে দলাইমলাই করে রান্নার নাম লাবড়া।
রান্নার পরে প্লেটে এই জিনিসের ভেতর থেকে কোনটা লাউ আর কোনটা ঝিঙে তা আর আলাদা করা যায় না। আমজাদ সাহেবর মগজও তালগোল পাকিয়ে লাবড়া হয়ে আছে। তিনি আলাদাভাবে কোন কিছু চিন্তা করতে পারছেন না।
জাদুঘরের এই ভোল্টের নিরাপত্তারক্ষী একরাম হোসেন চিন্তিত মুখে জিজ্ঞেস করলো, 'স্যার, ঘটনা ক্যামনে ঘটলো?'
এই প্রশ্নে আমজাদ হোসেনের লাবড়া ভাব কিছুটা কেটে গেলো। তিনি বিনা দ্বিধায় একরাম হোসেনের গালে কষিয়ে চড় বসালেন ।
একরাম হোসেনের পাটকাঠি শরীর মুহূর্তে ছিটকে গিয়ে পড়লো দরজার সামনে। সে আধশোয়া ভঙ্গীতে হতভম্ব হয়ে আমজাদ সাহেবের দিকে তাকিয়ে রইলো, 'ঘটনা ক্যামনে ঘটলো!'
চড় দিয়েই আমজাদ সাহেব বুঝলেন, কাজটা তিনি ঠিক করেন নি। বড় ধরনের অন্যায় করে ফেলেছেন। তিনি জাদুঘরের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা, কিন্তু তাই বলে দায়ীত্বরত নিরাপত্তারক্ষীকে চড় মারার অধিকার তার নেই। তিনি একরাম হোসেনের হাত ধরে টেনে বসালেন।
তারপর নরম গলায় বললেন, 'কাল রাতে এইখানে ডিউটিতে কে ছিল?'
-'আমি আর আলমগীর, স্যার'।
- 'আমি কই ছিলাম?'
- 'আপনে স্যার বাসায় ছিলেন'।
- 'তাহলে, ঘটনা ক্যামনে ঘটলো, সেটা আমি জানবো না তুমি জানবা?'
- 'জ্বে স্যার, আমি জানবো'।
- 'বলো, ঘটনা ক্যামনে ঘটলো?'
- 'স্যার, আমরা ছিলাম সত্য, কিন্তু ঘটনা ক্যামনে ঘটলো ঠাওর পাই নাই। হীরাটা কাচের বাক্সের ভিতরেই ছিল।
যখন গেট বন্ধ করা হইছে, তখনও ছিল। কিন্তু সকালে গেট খোলার পর দেখা গেল হীরা নাই'।
- 'তুমি জানো, এই হীরা মুল্য কত? এই হীরা এক হাজার বছরের পুরানো। পৃথিবীর আর কোন জাদুঘরে এর কোন রেপ্লিকা নাই। এটার বাজার মূল্য তুমি আন্দাজ করতে পারো? কয়েক হাজার কোটি টাকা!'
একরাম হোসেনের পাশে এসে বসেছে আলমগীর।
দুইজনই নির্বিকার ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। তাদের দেখে মনে হচ্ছে না গুরুতর কিছু ঘটেছে। হীরা চুরি নিয়ে তাদের ভয়ের কিছু নেই। কারণ গেট বন্ধ হবার পর তাদের গেটের ভেতর ঢোকার কোন সুযোগ নেই। তারা গেটের বাইরে বসে থাকে।
চাবি থাকে মূল নিরাপত্তা অধিদপ্তরের অফিসে। গতরাতে যখন গেট বন্ধ করা হয়েছে, তখন বড়স্যার আমজাদ হোসেন নিজে উপস্থিত ছিলেন, হীরাটা তখনও যথাস্থানেই ছিল। সুতরাং এই বিষয়ে তাদের চিন্তার কিছু নেই। তাদের চিন্তার বিষয় বরং অন্য। এতো দামী হীরার পাহারা দেয় তারা, আর তাদের বেতন কিনা সাকুল্যে ঊনচল্লিশ'শ টাকা! কি নিদারুণ অবিচার!!
খবর চাউর হয়ে গেছে।
বাইরে টিভি ক্যামেরা আর সাংবাদিকদের ঘোরাঘুরি দেখা যাচ্ছে। আমজাদ সাহেবের মাথার লাবড়া ফুটতে শুরু করেছে। তিনি দরদর করে ঘামছেন। বুক ধরফর করছে। তলপেটে চাপ বাড়ছে।
তিনি এখন প্রেসের সামনে কি বলবেন! কয়দিন আগে তার হার্টের বাইপাস হয়েছে। তার মনে হচ্ছে, বাইপাস-ছাইপাসের কাহিনী এবার ফুরোলো । নটে গাছটিও মুরোলো। তার হার্টের হার্ট শেষ। তিনি কয়েক মিনিটের মধ্যে মারা যাচ্ছেন।
ঘণ্টাখানেকের মধ্যে দেশের সকল টেলিভিশন চ্যানেলের স্ক্রলে ব্রেকিং নিউজ দেখা যেতে লাগলো, 'জাতীয় জাদুঘর থেকে হাজার বছরের পুরনো ঐতিহাসিক পার্সিয়ান হীরে উধাও। হীরা উদ্ধারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর ৪৮ ঘণ্টা সময়। '
৪০ ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। হীরা উদ্ধার হয় নি। বরং আবিস্কার করা গেছে, শুধু এই হীরাই নয়, সাথে আরও কিছু জিনিস চুরি গেছে।
তবে হীরা চুরির সাথে যুক্ত চক্রকে চিহ্নিত করা গেছে। শহরের দক্ষিণ দিক ঘেঁসে গহীন বন, ধারণা করা হচ্ছে, চোরাচালানী চক্র এই বনে আত্মগোপন করে আছে। পুলিশের চিরুনি অভিযান চলছে।
২
আমজাদ সাহেব চূড়ান্ত বিরক্ত।
সকালে জাদুঘর থেকে সোজা হাসপাতালে।
তারপর বিকেলে বাসায়। কিন্তু সন্ধ্যার পর আর এখানে ইলেক্ট্রিসিটি থাকে না। ছোট মেয়েটার সামনে এইচএসসি পরীক্ষা। এই সময়ে ইলেক্ট্রিসিটির এই অবস্থা! তারওপর তিনি বাড়ি করেছেন শহরের একদম দক্ষিণ দিক ঘেঁসে। এদিকে ঘন বন।
তার বাড়ী সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ভেতরে না হলেও শহর থেকে বেশ দূরে। কিন্তু এখানেও চারপাশে গাছগাছালিতে অন্ধকার হয়ে আছে। আর ইলেক্ট্রিসিটি না থাকলেতো মশার যন্ত্রণায় টেকা দায়। তারওপর চোর-বাটপারের উৎপাত।
তিনি চেঁচিয়ে বড় মেয়েকে ডাকলেন, যদি এক কাপ চা পাওয়া যায়।
তার স্ত্রী রানুর ক্যান্সার। সে সারাদিন ভেতরের ঘরে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকে। চেষ্টা করলে হয়তো রানুর ক্যান্সার এখনো সাড়ে, কিন্তু যে পরিমাণ টাকা তাতে দরকার, আমজাদ সাহেবের তা নেই। শহরের বাইরে এই জঙ্গলের ভেতর বাড়ী করতেই তার হা পিত্যেশ অবস্থা। ব্যাংকের কাছে বিস্তর লোন হয়ে আছে।
কিভাবে শোধ করবেন জানেন না। এদিকে অফিসের অবস্থাও ভালো না। চাকরীটা আজ বোধ হয় গেলই!
সুমি বাবার ডাকে সাড়া দিল না। চায়েরও কোন খবর নেই। তিনি তার এই বড় মেয়েকে নিয়ে চিন্তিত।
ছেলে মেয়েদের বখে যাওয়া সবার আগে টের পায় বাবা মা। তিনিও টের পাচ্ছেন। কিন্তু কিভাবে সামলাবেন বুঝতে পারছেন না। আসলে, মেয়েদের সামলানোটা বাবার কাজ না, এইটা মায়ের কাজ। তিনি চেষ্টা করছেন, পারছেন না।
এই মেয়ের নিত্য নতুন শখ। এই শখ মেটাতে তার নাভিশ্বাস উঠছে। তারওপর এখন সে নতুন বায়না ধরেছে, সিনেমা নিয়ে পড়তে যাবে বিদেশে।
সজল দুম করে বিকট শব্দে দরজা খুলে ঘরে ঢুকল। আমজাদ সাহেব ভ্রু কুঁচকে ছেলের দিকে তাকালেন।
মাস্টার্স পাশ করে বছর তিনেক ধরে চাকুরি খুঁজছে সে, কিন্তু মনের মত মিলছে না। এখন বায়না ধরেছে ব্যাবসা করবে। সুপার শপের ব্যাবসা। কয়েক কোটি টাকা মূলধনের বিষয়। আমজাদ সাহেব এই নিয়ে কথা বলেন না।
আদার ব্যাপারীর জাহাজের খবর নেওয়ার কি দরকার! তবে ডিঙ্গি নৌকার নিজেকে জাহাজ মনে হলে ভীন্ন কথা। সজলের অবস্থা এখন তাই। সে নিজেকে ভাবছে বিরাট বড় শিপ।
- ‘আব্বা, শুনছো, জঙ্গলে পুলিশ ঢুকছে?’
- ‘হু শুনছি। ‘
- ‘মজার কাণ্ড কি জানো? চোর নাকি চুরির জিনিসপত্র সব জঙ্গলের ভিতর এইখানে সেইখানে ছড়াই ছিটাই দিছে’।
- ‘মানে কি!’ আমজাদ সাহেব ছেলের উপর চরম বিরক্ত। এই ছেলের বুদ্ধিসুদ্ধি বলতে যে এক বস্তু, তা তার মাথায় নাই’।
- ‘হ্যা, চোর বিশাল ধরনের কাবিল লোক’।
- ‘কাবিল আবার কি জিনিস?’
- ‘ওস্তাদ লোক। আবার সেন্স অফ হিউমারও ভালো।
চুরির জিনিস নিয়া যখন ভাগতেই পারলো না, তো আর কি! খা বাবা পুলিশ। একটু কষ্ট কইরা খা’।
সজল খা খা করে শরীর দুলিয়ে হাসছে।
- 'কেন? এটা কেন করছে?' আমজাদ সাহেবের মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে যাচ্ছে। মেজাজ কন্ট্রোলে রাখা দরকার।
তিনি পারছেন না। ইচ্ছে হচ্ছে সকালে একরামের মতন কষিয়ে সজলের গালে একটা চড় মারতে।
- 'আসলে ওরা সব জিনিস একটা বাক্সে ভরে নিছিল, কিন্তু এখন সেগুলা জঙ্গলে ছড়াই ছিটাই রাখছে যাতে পুলিশ এখন এইগুলা খুজতেই ব্যাস্ত হয়। এই সুজগে ওরা পালাবে। পরে কখনো সুজোগ বুঝে ফিরে এসে কিছু যদি খুঁজে পায়।
লোকটা চরম না আব্বা?'
- 'আজকাল চোর-ডাকাতওতো দেখি সব গাধা! চুরি করার আগে প্লান-পরিকল্পনা থাকবে না! এইটা কোন কথা হোল'?
আমজাদ সাহেব চরম বিরক্তি নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। অন্ধকারে বিস্তৃত বন দেখলে কালো নিশ্চুপ এক সমুদ্র মনে হয়। বনের ভেতর একটা পিচঢালা সরু রাস্তা ঢুকেছে। ঠিক বারান্দার গা ঘেঁসে গেছে রাস্তাটা। খানিক পরপর ল্যাম্পপোস্ট।
সেই ল্যাম্পপোস্টের আবছা আমজাদ সাহেব তাকিয়ে রইলেন। বারান্দার ডান পাশে হাত বিশেক দূরে একটা ঝোপের মতন জায়গা। গাঁড় অন্ধকার। সেই অন্ধকারে তাকিয়ে আমজাদ সাহেব মুহূর্তে জমে গেলেন। ল্যাম্পপোস্টের তেরছা আলোয় চকচক করছে হীরাটা! হাজার বছরের পুরানো সেই ঐতিহাসিক পার্সিয়ান হীরা! যারা বাজার মূল্য কয়েকশ' হাজার কোটি টাকা! চোরটা তাহলে সত্যি সত্যিই চুরির জিনিষপত্র জঙ্গলের ভেতর ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখে গেছে! আমজাদ সাহেব যেন নড়তে ভুলে গেছেন।
তিনি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছেন।
- 'সজল, সজল!'
গলা থেকে যেন শব্দ বেরুচ্ছে না। আমজাদ সাহেব আবারো সজলকে ডাকলেন। সজল হাফহাতা গেঞ্জিটা গায়ে চড়াতে চড়াতে বাবার পাশে এসে দাঁড়ালো। আমজাদ সাহেব ফিসফিস করে কি বললেন, তা বোঝা গেলো না।
কিন্তু তার হাতের ইশারায় সজল জমে গেল। হীরা! হীরা গোলাকার হয় সে জানে। কিন্তু গাড় অন্ধকারে প্রায় বর্গাকৃতির যে হীরাটা ল্যাম্পপোস্টের আলোর প্রতিফলনে ঝকমক করছে তা তাকে সম্মোহিত করে ফেলেছে। সে ফিসফিস করে ডাকল, ‘আব্বা! আব্বা! দেখছ!’
সজল দ্রুত বারান্দা থেকে বেড়িয়ে দুই বোন রুমি, সুমি, এমনকি অসুস্থ মা'কেও ডেকে আনলো।
-' বাবা, আমরা কি হীরাটা পুলিশকে দিয়ে দিব?' রুমি আমজাদ সাহেবের গা ঘেষে দাড়িয়ে ফিসফিস করে বলল।
আমজাদ সাহেব জবাব দিলেন না।
কিন্তু সজল মৃদু স্বরে ধমকে উঠলো, 'ওই গাধা, পুলিশকে ফেরত দিব ক্যান, হ্যা? এই সুযোগ জীবনে কয়বার আসবো? কয়বার আসবো? আব্বা কথা বল না ক্যান? কি বলো আব্বা?'
আমজাদ সাহেব অবাক হয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। কি বলছে সজল! সজল বাবার পাশে এসে দাঁড়ালো। তারপর দুই হাতে আমজাদ সাহেবের কাঁধ চেপে ধরে বলল, ‘আব্বা, এইটা একটা চান্স। এই একটাই চান্স।
লাস্ট চান্স আব্বা’।
আমজাদ সাহেব কিছু বুঝে উঠতে পারেন না। তার কি যেন হয়, তিনি বিড়বিড় করে বলেন, 'এইটা কি ঠিক হবে?'
- 'ঠিক বেঠিক বুঝি না আব্বা। এই জিনিস আমি ফেরত দিব না। মইরা গেলেও না।
- 'কিন্তু সজল...'
- 'কোন কিন্তু না আব্বা। চিন্তা করে দেখ, আম্মার চিকিৎসা হবে, সুমি'র কানাডা যাওয়া হবে, রুমির ভর্তি আর পড়াশোনা নিয়া তোমার আর চিন্তা লাগবে না। তাছাড়া, এই বাড়ীর লোন কেমনে শোধ করবা? তোমার চাকরিটাওতো গেল বলে! আর আমার কথা একবার ভাবো, আমি এইটা পেলে...। '
আমজাদ সাহেব কিছু বলেন না। অনেকক্ষণ চুপ করে থাকেন।
অন্ধকারেই যেন তিনি প্রতিটি মুখ দেখতে পান। সেখানে রানুর জরাগ্রস্ত মুখ। সেই মুখ আর শরীর জুড়ে যে মৃত্যু আতঙ্ক ঘাপটি মেরে বসে আছে, তার ভেতর থেকেও যেন কি এক নব সম্ভাবনায় নতুন জীবন উঁকি দিয়ে যাচ্ছে। রুমি? রুমির চোখ জুড়ে যেন ঝলমলে এক ভবিষ্যতের হাতছানি। সুমি, যে পারতপক্ষে বাবার সাথে কখনো কথাই বলে না, সেই বেড়ালের মতো নিঃশব্দে বাবার কাঁধে হাত রাখে।
তারপর মাথাটা বাবার বুকের সাথে চেপে ধরে ফিসফিস করে কাঁদে, 'প্লিজ আব্বা, প্লিজ... আর কোনদিন কিছু চাইবো না, কোনদিন না!'
সজল তৃষ্ণার্তের মতো তাকিয়ে আছে আমজাদ সাহেবের দিকে। গত দু বছরে কতবার যে সুইসাইড করতে চেয়েছে ছেলেটা! একটা ভালো চাকরির জন্য। মানুষ ছেলে-মেয়েদের জন্য কত কিছুই না করে। অথচ, আমজাদ সাহেবের সাধ্য নেই, ছেলেকে একটা ভালো চাকরি জোগাড় করে দেয়ার, সাধ্য নেই ব্যাবসা করার টাকা দেয়ার।
এই গাড় অন্ধকারেও আমজাদ সাহেব যেন চার জোড়া চোখের ভাষা স্পষ্ট পড়তে পারেন।
তার চিন্তা এলোমেলো হয়ে যায়। বাড়ীর লোনের কথা মনে পড়ে। চাকুরির কথা মনে পড়ে! তার মাথা আবার সেই লাবড়া হয়ে যাচ্ছে।
তিনি ফিসফিস করে বলেন, - 'কিন্তু পুলিশ যদি আমাদের বাসায় আসে? আর তাছাড়া এই জিনিসতো ঘরে রেখে লাভ নাই। বেচতে হবে।
আমরাতো এই জিনিস বেচতেও পারবো না। ধরা পড়ে যাব!'
- 'আব্বা, এইটা নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবে না। ওই চিন্তা আমার। আমার এক বন্ধু আছে, ওর সাথে এইসব জিনিস কেনে এমন পার্টির সাথে কানেকশন আছে। তাছাড়া পুলিশ আমাদের বাড়ির দিকে আসার আগেই আমরা এইটা সরাই ফেলব।
'
আমজাদ সাহেব কথা বলেন না। তার বুকটা চিনচিন করে ব্যাথা করছে। একদিনের জন্য অনেক বেশী প্রেশার নিয়ে ফেলেছেন। সজল আর বাবার মতামতের অপেক্ষা করে না। সে বারান্দা টপকে নামতে যাবে, এই মুহূর্তে আমজাদ সাহেব তার হাত চেপে ধরেন।
আঙুল ইশারায় ফিসফিস করে বলেন, 'পুলিশের গাড়ি ওইখানে। ওই যে বা পাশের রাস্তা দিয়া আসতেছে। এখন না, একটু পরে যা। '
তীব্র সাইরেনে একেরপর এক পুলিশের গাড়ি ঢুকতে থাকে সরু রাস্তা দিয়ে। বারান্দার কার্নিশ ধরে দাড়িয়ে আছে পাঁচ জোড়া তৃষ্ণার্ত চোখ।
রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা। অনাগত স্বপ্ন। ক্যান্সার জয় করে মৃত্যুকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ফিরে আসবে রানু। রুমি আর সুমি প্রজাপতির মত উড়ে বেড়াবে এক স্বপ্নের পৃথিবীতে। সজল সুপার শপটা কোথায় দেবে? একটাই দিবে? নাকি কয়েকটা ব্রাঞ্চ থাকবে? ব্রাঞ্চ থাকলেই ভালো।
প্রচার বেশী হবে। প্রচারেই প্রসার। আহ! সেই স্বপ্ন! সেই স্বপ্ন!!
আমজাদ সাহেবের বুকের ভেতর হঠাৎ কি এক বাতাস বয়ে যায়। একটু স্বপ্ন। একটু স্বস্তি।
এই এতগুলো হাসি মুখ! আমজাদ সাহেবের মনে হতে থাকে তার ব্যাথাটা যেন ক্রমশই উধাও হয়ে যাচ্ছে। তিনি আরও বড় করে একটা বাড়ী বানাবেন। বারান্দা থাকবে ফুটবল মাঠের মত খোলা। সেই বারান্দায় বসে আরামে কফির কাপে চুমুক দিবেন তিনি। চাইলে শহরেও একটা বাড়ী করা যাবে।
এটাও থাকবে, অবসর কাটাতে দিন কয়েক এসে প্রকৃতির কাছে এসে তখন না হয় থেকে যাবেন। অনেকেরতো এমন বাগানবাড়ী থাকেই! তখন রানু নিশ্চয়ি আবার আগের মতো হাসবে, গুনগুন করে গান গাইবে। রাত দুপুরে ঘুম থেকে ডেকে বলবে, 'তুমি বলছিলা, প্লেনে করে মালদ্বিপ নিয়া যাইবা, কিন্তু এতদিনেতো এয়ারপোর্টেই নিলা না, মরলে কি লাশ প্লেনে কইরা গোরস্তানে নিবা?'
আমজাদ সাহেবের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। আহা। সুদিন এলো বলে।
ফজরের আজান হয়েছে। পুলিশের গাড়িগুলোও কেন যেন চলে গেল। পশ্চিম আকাশ ফর্শা হতে শুরু করেছে। নির্ঘুম পাঁচজোড়া চোখ এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজেদের ইশারার ভাষা বুঝে নিল। সন্ত্রস্ত কিন্তু দ্রুত পায়ে ছুটে গেল হাত বিশেক দূরে সেই অন্ধকার ছোট ঝোপটার কাছে।
সেই ঝোপ। সেখানে নাম না জানা জংলী ফুল। অজস্র লতা পাতার জঞ্জাল। চোখগুলো ক্ষুধার্ত শিশুর মতো ঝাপিয়ে পড়ে যেন। লতাপাতায় পেঁচান ঘন জঞ্জাল।
সেই জঞ্জালের ভেতর পড়ে আছে পরিত্যাক্ত একটা সিগারেটের প্যাকেট। প্যাকেটটা ছেড়া।
সিগারেটের ছেড়া প্যাকেটের ভেতর থেকে বের হয়ে আছে চকচকে শক্ত একটুকরো ঝকমকে কাগজ!
-----------------------------------------------
প্রাগৈতিহাসিক/সাদাত হোসাইন
২৫.১০.২০১৩
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।