শেখ হাসিনা তার পিতার ধর্মনিরপেক্ষতার জায়গাটাকে কায়দা করে ওয়ার অন টেররের মডারেট ইসলামের সাথে জুড়ে দিতে সক্ষম হলেন। বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রায় পুরো সময়টা ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে নানা সুবিধা তৈরি করে দিয়ে আসতে থাকা বামপন্থিরা তো বটেই, বাংলাদেশে যারা নিজেদের নাস্তিক বলে প্রচার করতেন তারাও এই প্রথম ‘পিসফুল ইসলাম’-এর পক্ষে কথা বলে ‘টেরর ইসলামে’র বিরুদ্ধে দাড়িয়ে গেলেন। সন্ত্রাসবিরোধী অনন্ত যুদ্ধের সময়ে ইসলাম ও মুসলিম ডাকনামের বিপদ থেকে বাঁচতে শেখ মুজিবের ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র একুশ শতকের হাসিনা-সংস্করন এখন বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্তদের বেশ কাজে আসছে। যাদের জীবনধারা, নাগরিকতা, সামাজিক সম্পর্ক ও ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠার মধ্যে শেখ মুজিবই হয়ে উঠেছেন প্রকৃত নায়ক।
শেখ মুজিবকে নিয়ে এই সময়ের নির্মোহ এই বিশ্লেষণের মধ্যে রয়েছে অনেক বিস্ফোরক মন্তব্য...
আরব উপদ্বীপ থেকে এই অঞ্চলে এসেছিলেন শেখ মুজিবের পূর্বসুরিরা।
আরব বংশোদ্ভূত আশরাফ বাঙালি মুসলিম পরিবারের এই সন্তানটি জীবন ও মরণের মাঝখানের পঞ্চান্নটি বছরে পরিণত হয়েছেন বঙ্গবন্ধু’তে। নয়া-উপনিবেশি জমানায় সভিয়েত-চীন ও আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের ত্রিমুখী প্রভাববলয়ের মধ্যে দক্ষিন এশিয়ায় বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রটির গোড়াপত্তন হয় তার নেতৃত্বে, আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে, উনিশশো একাত্তর সালের ছাব্বিশে মার্চ। আর তিনি নিহত হয়েছিলেন, তার স্বাধীন দেশে, একাত্তরের ষোলো ডিসেম্বর স্বাধীনতার যুদ্ধে জয়ী হয়ে স্থাপিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাজধানীতেই- তার সেনাবাহীনির হাতেই।
নিহত হওয়ার পয়ত্রিশ বছর পরে এসে তাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যে, তাকে অস্বীকার করে দেশটির রাজনীতি চলতে পারছে না। একুশ শতকের সাম্রাজ্যবাদী বিন্যাসের অধীন দুনিয়াদারির অধীন বাংলাদেশ এখন তার দৃষ্টিভঙ্গির অধীনেই পুর্নগঠিত হচ্ছে।
তাকে অতীতে যারা চ্যালেঞ্জ করেছেন- সেই অভিজ্ঞতা, এবং ভবিষ্যতে করতে পারেন, সেই এমন সম্ভাবনার নিরিখে ভাগ্য নির্ধারিত হচ্ছে বাংলাদেশের বিগত ও বর্তমান ব্যক্তিত্বদের। তার দল আওয়ামী লীগের সব অনুসারী দাবি করেন তিনি বাঙালি জাতির জনক, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। ক্ষমতার দলীয় রাজনীতির জায়গা থেকে আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী দল এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর অনুসারীরা তাকে জাতির পিতা ও হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী হিসেবে মেনে না নিলেও দল দুটির সবাইকে শ্রদ্ধাভরে স্বীকার করতেই হয় যে, তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি।
সবমিলিয়ে মুজিবের রাজনৈতিক জীবন এখন এই সময়ের বাংলাদেশে সবচে অধিপতি জীবনাদর্শ হয়ে উঠেছে। অথচ মুজিবের জীব জীবনের অবসান ঘটেছে ৩৫ বছর আগের ১৫ আগস্ট।
বৃহত্তর ফরিদপুরের গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় কবর দেয়া হয়েছে তাকে। যেই ফরিদপুর বাংলাদেশের রাজনীতির কেন্দ্রে আলোচনার বাইরে থাকা নিষ্প্রভ এক অঞ্চল, যার মধ্যে টুঙ্গিপাড়া আরো বেশি নিষ্প্রভ। যেখানে ব্যক্তি মুজিব অস্থিমজ্জাসহ মাটিতে মিশে গেছেন।
আর এই ব্যক্তি মুজিব মৃত্যুর সময় শোকার্ত মানুষের সমুদ্রসমান অশ্রুধারায় সিক্ত হননি। তার মৃত্যুর দিনটি ১৯৯৬ সালে তার কন্যার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসার আগে কখনোই রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় পালিত হয়নি।
শেখ হাসিনা পিতার মৃত্যুর দিনটিকে জাতীয় শোক দিবস ঘোষণা করে সরকারি ছুটি ঘোষণা করেছিলেন। এর আগে তার খুনীরাই রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য পেয়েছিল। তাদের বীর হিসেবে বরণ করে নেয়া হয়েছিল। তার খুন হওয়ার দুর্ভাগ্যের প্রতি যতটা না পক্ষপাত ছিল বাংলাদেশের একাংশের মানুষের মধ্যে, তারও চেয়ে বেশি পক্ষপাত বরাদ্দ ছিল তাকে খুন করার ঘটনার প্রতি-যেই পক্ষপাতের প্রমাণ মেলে তার কন্যার ক্ষমতা হারানোর সঙ্গে সঙ্গেই জাতীয় শোক দিবস প্রত্যাহার ও রাষ্ট্রীয় ছুটি বাতিল করার মধ্য দিয়ে। এখন তার কন্যার আবারো ক্ষমতা গ্রহণের মধ্যে সেই রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ফিরে এসেছে।
ধারনা করতে কষ্ট হয় না, তার কন্যা আবারো ক্ষমতা হারালে এই রাষ্ট্রীয় মর্যাদা আবারো প্রত্যাহার হয়ে যেতে পারে।
কিন্তু, আগেই বলেছি মুজিব বিষয়ে পরিস্থিতি এখন নতুন। বাংলাদেশে মৃত শেখ মুজিবের জন্য- ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুর জন্য জাতীয় শোক দিবস অব্যাহত থাকুক আর নাই থাকুক-তাতে কিছুই যায় আসে না। রাজনৈতিক মুজিব এখন বাংলাদেশে যে কোন সময়ের চেয়ে অনেক বেশি জীবন্ত। বাংলাদেশের সংসদ, কোর্ট-কাচারি, আইন, ইতিহাসের অধিপতি বয়ান, সংবাদমাধ্যম, জ্ঞানভাষ্য, জনমত ও তারুণ্য সবই এখন মুজিবের পক্ষে একাট্টা।
যেই সেনাবাহিনীর হাতে খুন হন তিন, সেই বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উদ্দিন আহমদও (সাবেক) নিজের ক্ষমতা চর্চার সবচেয়ে নিরাপদ সময়ে মুজিবকে জাতির পিতা হিসেবে স্বীকার করেছেন। সেনাপ্রধানের এই স্বীকৃতি মিলল ২০০৭ সালের ২৭ মার্চ। আর গত নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার মুজিবের খুনী বলে আদালতে দোষী সাব্যস্ত সেনা সদস্যদের যেভাবে নির্বিবাদে মৃত্যুদণ্ড দিতে সফল হয়েছে, তাতে করে বোঝা যায় সেনা বাহিনীর সর্বস্তরে মুজিবের প্রতি আনুগত্য ও শ্রদ্ধা তৈরি হয়েছে।
সবমিলিয়ে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে যারা নিবিড় নজর রাখছেন, তাদের স্বীকার করতেই হবে যে মৃত্যুর প্রায় তিন দশক পরে মুজিব ফিরে এসেছেন। এমন ভাবে ফিরে এসেছেন, তিনি এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে উজ্জ্বলতম নায়ক।
এই নায়ককে এখন শেখ মুজিব বা মুজিব বলে ডাকার উপায় নাই। এই ডাকাডাকির জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তি শুধু মুজিবকে অশ্রদ্ধা করার জন্যই দায়ী হন না, তাকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির দোসর বা অনুসারী হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার ঝুকির মধ্যে পড়তে হয়। মৃত্যুর এত এত দিন পর মুজিবকে আজ বাংলাদেশের জনসমাজ বিনা বাক্য ব্যয়ে বঙ্গবন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছে। এই গ্রহণের মধ্যেই রয়েছে শেখ মুজিবের নয়া উত্থানের শর্ত। ( লেখাটা সংগ্রীহ) ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।