তাহমিদুর রহমান
ঘটনা ১
আজ কলেজ থেকে ফিরেই চিত্রা জানতে পারল আজ ওকে দেখতে আসবে। বাসায় সেজন্যে খুশির আমেজ। ড্রয়িং রুমে ঢুকেই দেখে খাটের চাদরটা পাল্টানো হয়েছে এবং খুব সুন্দর পরিপাটি। সাধারণত ড্রয়িং রুমের বিছানার চাদর এরকম থাকে না। সব সময় কোঁচকানো থাকে কারণ কেউ না কেউ এর উপর বসে সকালবেলা থেকে টিভি থাকে।
টিভিটাও খুব সুন্দর কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। তার উপরেই একটি ফুলদানির ভেতর কিছু রজনীগন্ধা শোভা পাচ্ছে। চিত্রা আশ্চর্য হয় কারণ তাদের বাসায় ফুলদানি ছিল না। সোফার কাপড়গুলোও পাল্টিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওর জানা মতে সোফার দুই সেট কাপড় আছে।
একটা সব সময় দিয়ে রাখে মা। আর আরেক সেট বিশেষ দিনে দিয়ে থাকে। আজ কি বিশেষ দিন? ঘরে ঢুকতেই ছোট বোন আঁচল দৌড়ে আসে।
-জানিস, আজ তোকে দেখতে আসবে?
-শুনলাম।
-খুব ভাল ভাল রান্না হচ্ছে।
-হুম।
ওর গুরুগম্ভীর চেহারা দেখে আঁচল রান্না ঘরে গিয়ে মাকে ফিসফিস করে কি যেন বলে। কিছুক্ষনের জন্যে তাকেই রান্নার ভার দিয়ে চিত্রার ঘরে আসে মা।
-কিরে তুই মুখ গম্ভীর করে রেখেছিস কেন?
-এমনি।
-এমনি কেন? তোর কি কেউ পছন্দের আছে?
-মানে?
-না আঁচলটা বলছিল...
-তোমার ধিংগি মেয়েটার মাথায় আর কিছু ঢুকে না নাকি?
-না মানে আমি বলছিলাম যে, তোর যদি কোন......
-আমার কেউ পছন্দের নেই মা।
-তাহলে?
-তাহলে কি?
-মুখ গম্ভীর করে রেখেছিস কেন?
-মা এভাবে লোকজনের সামনে সেজেগুজে যেতে ভাল লাগে না।
মা কিছু বললেন না আর। মনটা তারও খারাপ হল কিছুটা। এই নিয়ে নবম বারের মত কোন ছেলে দেখতে আসছে তাকে। সবার উত্তর ছিল এক।
সন্ধ্যার কিছু পরেই মেহমানরা চলে এল। নামাজ শেষে আতর মেখে চিত্রার বাবা জাফর সাহেব ঘোরাঘুরি করছিলেন বারান্দায় ঠিক এ সময় এল তারা। খুব কাছে থেকে বুঝলে বোঝা যায় জাফর সাহেব কিছুক্ষন আগে কাঁদছিলেন। সেটা যে নামাজে দাড়িয়ে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানাচ্ছিলেন তা বোঝার অপেক্ষা রাখে না।
-আরে বেয়াই সাহেব, আমাদের জন্যেই অপেক্ষা করছেন নাকি?
জাফর সাহেব লজ্জা পেলেন।
তাকে এভাবে কেউ বেয়াই ডাকিনি আগে। এবার চিত্রার সম্বন্ধটা মনেহয় হয়েই গেল।
ড্রয়িং রুমে সবার বসার পর ছেলের মামা বললেন,
-কই মেয়েকে আনুন।
চিত্রা বরাবরের মত চায়ের ট্রে হাতে ঘরে ঢুকল। এ যেন রীতি।
চায়ের ট্রে হাতেই ঢুকতে হবে। এরপর কিছুক্ষন সবাই মিলে তাকে জেরা করা হলো। কিন্তু তার চেহারা দেখেই ফিসফিস শুরু হয়ে যাওয়ার পরই সে বুঝতে পারে কি বলবে ওরা? অনেকক্ষন নীরব থাকার পর ছেলের বাবা বললেন,
-দেখেন ভাই? আমরা বাসায় গিয়েই আপনাদেরকে সিন্ধান্ত জানিয়ে দিব...
জাফর সাহেবের ভেতরে কেঁদে উঠল। তিনি জানেন এর পর কি উত্তর আসবে। আগেও ঠিক একই রকম হয়েছে।
তিনি সবাইকে একটু আসছি বলে ভিতরে চলে গেলেন। ছেলের বাবা চিত্রার মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,
-সরি আপা।
চিত্রার মা দীর্ঘনিঃশ্বাস গোপন করে বললেন,
আপনার এত কষ্ট করে এসেছেন যখন অবশ্যই খেয়ে যাবেন।
ঘটনা ২
উথাই প্রুর এখন যেখানে থাকে সেটা একটা শহর, বাংলাদেশের একটা বিভাগ। শহরটা খুব ভাল লাগে, রাস্তাগুলো বেশ সুন্দর।
মাত্র দুই মাস আগে এখানে এসেছে সে। বাংলাদেশের মানচিত্রের একেবারে শেষে লামা থেকে এখানে এসেছে সে শহটার নামকরা মেডিকেল কলেজে পড়ার জন্যে। সে যখন এখানে চান্স পায়, তার বিশ্বাসই হচ্ছিল না যে এরকম একটা সুযোগ পেতে পারে। সেই পরিচিত গ্রাম, পাহাড়, মা-বাবা, ভাই-বোন ছেড়ে আসতে খুব কষ্ট হয়েছিল তার। অনেকে বলেছিল যদি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ট্রান্সফার হওয়া যায়? কিন্তু সে সেরকম কোন চেষ্টাই করেনি।
এখানে আসার পর যেটা সবচেয়ে বেশি অনুভব করেছে যে নিজের ভাষায় কথা বলা যাচ্ছে না। আর দূর থেকে মানুষ কিভাবে জানি তাকায়। এইসব ভাবতে ভাবতে ক্লাসের দিকে যেতে থাকে।
-কিরে চাকমা? খবর কি?
উথাই প্রুর কষ্ট লাগে। সে অনেকবার এদের বুঝিয়েছে যে সে জাতিতে চাকমা না, মগ।
-আরে আরিফ, ও তো চাকমা না, মগ। চায়ের মগ, পানির মগ।
এই বলে তিনজনের দলটা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। উথাই প্রু দাঁত শক্ত করে সামনের দিকে চলে যায়।
দুপুরে ক্লাস শেষে সে বইখাতা রেখে ডাইনিং খেতে যায় প্রতিদিন।
আজকে মনটা খারাপ তাই ভাবছিল খাবে না কিন্তু অভ্যাসই তাকে ডেকে নিয়ে গেল। এক টুকরো মাছ, সবজি আর ভাত নিয়ে সে একেবারে ডাইনিং এর কোনায় রাখা টেবিলে গিয়ে বসে। কিছুক্ষন পরেই সে শুনতে পায়...
-ঐ চাকমা না না মগ, কি করিস? তেলাপোকা খাস? তাইতো বলি, ডাইনিং-এ কি করে তেলাপোকা কমে গেল।
আশেপাশে সবাই সমস্বরে সম্মতি জানায়।
উথাই প্রু আর খেতে পারে না।
জানালার দিকে তাকিয়ে থাকে। যেটুকু খেয়েছে সবই উঠে আসতে চায়।
ঘটনা ৩
পূজার ছুটিতে অনিমেষ বাড়ি যাচ্ছে। এ নিয়ে বেশ রোমাঞ্চ হচ্ছে তার। সে এবার সবার জন্যে কাপড় কিনে নিয়ে যাচ্ছে।
টিউশনির টাকা জমিয়ে সে সবার জন্যে একটি করে কাপড় কিনেছে। জীবনে অন্যের জন্যে কেনাকাটা এটাই প্রথম। মায়ের জন্যে কিনেছে একটা চাদর। মা নিশ্চয় খুব খুশি হবে।
-অ্যারে অনিমেষ তুই?
অনিমেষ উপরে তাকায়।
হাবিবকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে সে অস্বস্তিবোধ করে। হাবিব আবার বলে,
-কিরে বাড়ি যাচ্ছিস?
-হুম।
-পূজার ছুটিতে?
-হুম।
-এরকম করে হুম হুম করছিস কেন?
-এমনি।
-ও আচ্ছা।
গতবার পূজোয় যা মজা হয়েছিল না।
-হুম।
-আবার হুম। আচ্ছা বল মূর্তিগুলোতে কি কাপড় পড়ানো হয়ে গেছে?
-দেখ হাবিব প্রথম কথা ঐগুলো মূর্তি না দ্বিতীয় কথা ওদেরকে নিয়ে এরকম কথা বলতে নেই।
হাবিব শব্দ করে বিচ্ছিরি হাসি দেয়।
-তাহলে বল। ওদেরকে লাথি মেরে আবার ঢুবিয়ে দিস কেন?
-লাথি মেরে ঢুবিয়ে দেওয়া হয় না। মা আমাদের দেখে বিদায় নেয় আবার আসবে বলে।
হাবিব আবারও শব্দ করে বিচ্ছিরি একখানা হাসি দেয়।
-গতবারের মত এবারও দু একখানা ভাঙব দেখিস।
-তো তো তোরা......
-হুম।
হাবিব একটা গর্বের হাসি দেয়। অনিমেষের ইচ্ছে করে হাবিবকে লাথি মেরে জানালা দিয়ে ফেলে দেয়।
ঘটনা ৪
চারজনের মধ্যে কথাবার্তা চলছে। তাদের কথা হচ্ছে অনুষ্ঠানে কি কি আয়োজন থাকবে তা নিয়ে।
-কোরওয়ান তেলাওয়াতটা কে করবে?
-কেন ফোরকার?
-ওকে বলেছিস।
-নাহ বলিনি। তবে আমাদের ক্লাসে সে ছাড়া তো মৌলবি আর নেই।
-ওকে আজই বলিস। সবকিছু ফাইনাল করা দরকার আজই।
চারজনের মধ্যে যার নাম আন্দালিব তারই দায়িত্ব পড়ে ফোরকানকে বলার জন্যে। সে তার হলের রুমের দিকে হাঁটা দেয়। রুমে যাওয়ার দরকার হয় না, হলের নিচেই তাকে পেয়ে যায় আন্দালিব। মাথায় টুপি, মুখে সুন্দর দাঁড়ি আর পরনে পায়জামা-পাঞ্জাবী।
-কিরে লাদেন কই যাস?
ফোরকার একটু নম্র স্বভাবের।
সে সহজে কাউকে কিছু বলে না।
-এইতো নামাজ পড়তে।
-দাঁড়া তোর সাথে আমার কথা আছে।
-পরে কথা বলব। নামাজে দেরি হয়ে যাচ্ছে।
-ওরে আমার নামাজী রে।
ফোরকান চলে যেতে ধরে,
-আরে বাংলা ভাই এক মিনিট টাইম দে।
এবারও কিছু বলে না ফোরকান।
-তোকে আমাদের অনুষ্ঠানে কোরওয়ান তেলাওয়াত করতে হবে।
-আমি পারব না।
-কেন?
-আমি লাদেন নই, বাংলা ভাইও নই। আমি ফোরকান, তোদের ফোরকান।
ফোরকান মসজিদের দিকে চলে যায়। আন্দালিব ফ্যাল ফ্যাল করে সেদিকে তাকিয়ে থাকে।
ঘটনা ৫
তুহিনের মনটা খারাপ।
আজও স্যারের হাতে মার খেতে হয়েছে। তাদের পঞ্চম শ্রেণীর ক্লাসে সেই একমাত্র ছেলে যে প্রতিদিন মার খায়। সে মাকে অনেকদিন বলেছে নতুন ড্রেস কিনে দেওয়ার কথা। কিন্তু মা যে কেন কিনে দেয় না? সে কাল থেকে আর স্কুলেই আসবে না বলে সংকল্প করে। তারপরেই ভাবে, স্কুল ছাড়া কোথায় যাবে সে? স্কুলে আসতেই বরং ভাল লাগে।
ক্লাস থেকে সায়েন্স টিচার আবুল হাসান তুহিনকে ডাক দেয়,
-অনেক হয়েছে হারামজাদা, এবার ক্লাসে এসে বস।
-জ্বী স্যার।
ক্লাসে এসে নিজের সিটে বসতেই লিটু ফিসফিস করে বলে,
-কিরে প্রতিদিন মার খেতে ভাল লাগে?
তুহিন লিটুর দিকে তাকায়। ওর জুতাগুলো নতুন, জ্যাম্প কেডস, চক চক করছে। স্কুলের ড্রেসটাও ধবধবে সাদা যেন এইমাত্র কিনে এনেছে।
আর ওর প্লাস্টিকের জুতা দিয়ে বুড়ো আংগুল বের হয়ে গেছে। জামার সোল্ডারটা ছেঁড়া, প্যান্টের পকেট কিছুদূর ছিড়ে নেমে পড়েছে আর কয়েক জায়গায় মা রিপু করে দিয়েছে। মা প্রতিদিন তুহিনকেই দোষারোপ করে যে, তার ড্রেসই কেন ছিঁড়ে। লিটু আবার কথা বলে উঠে,
-এ্যাই শুন। তুই এখানে বসেছিস জানলে আমি বসতামই না।
স্যার যাওয়ার পরেই উঠে যাবি। এ সময় আবুল হাসান স্যার হুংকার ছাড়লেন,
-একে তো ছেঁড়া কাপড় পড়ে আসিস তার উপর আবার কথাও বলিস ক্লাসে। তবে রে...
স্যার এগিয়ে এসে তুহিনের পিঠে বেত দিয়ে কয়েকটা বাড়ি দিয়ে দিলেন। তুহিন টু শব্দ করল না কিন্তু তার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগল।
-এ্যাই শোন তোদের জন্যে একটা সুখবর আছে।
সেটা হচ্ছে এবার সায়েন্স কম্পিটিশনে পঞ্চম শ্রেণী থেকে একজন যাবে।
সবাই হাত তালি দিতে শুরু করে।
-এই থামা।
সবাই চুপ হয়ে যায়।
-লিটুর বাবা এই উপজেলার শিক্ষা অফিসার।
তিনিই সিদ্ধান্তটি নিয়েছেন। কম্পিটিশনে যাবে লিটু।
তুহিন কান্নাজড়িতে কণ্ঠেই বলে উঠে,
-কিন্তু স্যার আমি ফার্স্ট।
-চুপ কর হারামজাদা। সেখানে যাওয়ার ক্ষমতা আছে নাকি তোর?
তুহিন চুপ করে যায়।
আসলেই তো ওর ক্ষমতা নেই। এই এগার বছর বয়সেই বুঝেছে যে, লিটুদের চেয়ে সে আলাদা। লিটুর ভাগ্য নিয়ে সে হিংসা করে না। তার বুকে বাষ্প জমে থাকে।
ঘটনা ৬
লেবু থেকে রস বের করে দিলে লেবুর যে অবস্থা হয় আজ অফিসের কাজের চাপে সাইফের ঠিক সেই অবস্থা হয়েছে।
এই ধকল সামলে রাস্তায় বাসে ঝুলতে ঝুলতে যখন এমবিএ ক্লাসের জন্যে ইউনিভার্সিটিতে এসে পৌছালো তখন ছয়টা বেজে পঁচিশ মিনিট। ঠিক সাড়ে ছয়টায় ক্লাস কিন্তু পেটে কিছু না দিয়ে ক্লাসে ঢুকলে নিশ্চিত মারা যাবে সে। তাই দৌড়ে ক্যান্টিনে গিয়ে ঢুকল।
-দুটো ভেজিটেবল রোল।
-মামা টাকাটা...
-হ্যাঁ আমি ক্যাশে দিচ্ছি, তুমি গরম কর।
ক্যান্টিন বয় হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে।
ভেজিটেবল রোলগুলো দাঁত দিয়ে ছিঁড়তে ছিঁড়তে সে ভাবতে থাকে, এত চাপ আর সহ্য করতে পারছি না। কি যে করি? ঠিক এসময় তার মোবাইল ফোনটা বেজে উঠে। এই মিউজিকটা শুধু একটা নাম্বারেই দেওয়া আছে। তার খুব পছন্দের রিংটোন।
পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখে হ্যাঁ ঠিক। সৈকতের ছোট বোন অথৈ ফোন করেছে। আকাশ থেকে মানুষ যেভাবে পড়ে ঠিক সেইভাবে ভেজিটেবল রোলের একটি টুকরো মাটিতে ফেলে দিল। সে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। অথৈকে সে মনে মনে ভালবাসে কিন্তু কখনো জানানো হয়নি।
-হ্যালো ভাইয়া।
অথৈ এর কণ্ঠস্বর কান্নাভেজা। চিন্তিত হয়ে উঠে সাইফ।
-কি হইছে অথৈ?
-ভাইয়াকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে।
-মানে?
-হ্যাঁ।
ভাইয়া সকালে যখন অফিসে যায় তখন হরতালের মধ্যে......
-আজ সেভাবে তো হরতাল পালন হয়নি।
-জানিনা ভাইয়া। কিছুই বুঝতে পারছি না। ভাইয়ার কাছে অফিসের আইডি কার্ডও ছিল।
-ও কি বাইক নিয়ে বের হয়েছিল?
-হ্যাঁ।
-এই সৈকতটার বুদ্ধি শুদ্ধি হল না। হরতালের মধ্যে কেউ......
-ভাইয়া প্লিজ কিছু একটা করেন...আমি আর আম্মা কি করব বুঝছি না। বাসায় খুব খারাপ অবস্থা। আম্মাকেই সামলাতে পারছি না।
-আচ্ছা আচ্ছা চিন্তা করো না।
আমি দেখছি। কোন থানায় আছে সে?
অথৈ যে জায়গার নাম বলল সেটা সাইফ যেখানে আছে সেখানকার পাশের থানা। উত্তরে সে বলল,
-ও তাহলে তো কাছেই। আমি যাচ্ছি এখুনি।
সৈকতের বাবা নেই।
চাকরি করে একটি ছোট্ট এ্যাড ফার্মে। তাকে কেন পুলিশ ধরবে বুঝতে পারে না সাইফ। রাস্তার ঐপার গিয়ে রিক্সায় চেপে বসে। থানায় এসে সরাসরি ওসির রুমে ঢুকতে গিয়েই বাধা পেল।
-কোথায় যাচ্ছেন?
-না মানে?
-আন্দাজি স্যারের রুমে ঢুকেন কেন?
-আমার এক বন্ধুকে...
-ধরে এনেছে?
-হ্যাঁ।
-যাদেরকে ধরে আনা হয়েছে তাদেরকে কোর্টে চালান করা হবে। শুক্র, শনি দুইদিন ছুটি; তারপর কোর্টে পাঠানো হবে?
-মানে?
-মানে যাদেরকে ছাড়ার তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এখন সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে, সন্ধ্যার পর আমরা আসামি ছাড়ি না।
-কিন্তু ওর তো কোন দোষ থাকার কথা না। ও তো কোন পার্টি করে না।
-কারণ নিশ্চয় আছে তা নাহলে আমরা এমনি এমনি ধরি না।
পুলিশটি কোন পদে আছে সাইফ জানে না। পুলিশের পদ বলতে সে ওসি, ইনেস্পেক্টর এইসব বুঝে। তবে এই লোকটা মনে হয় এসবের মধ্যে পড়ে না। কারণ আর যাইহোক ওসি, ইনেস্পেক্টর দাড়িয়ে দাঁড়িয়ে থানা পাহারা দেওয়ার কথা না।
-আপনাদের ওসি সাহেবের সাথে দেখা করা যাবে?
-না স্যার ব্যাস্ত।
থানার সামনে কংক্রিটের উপর সাদা রঙ দিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলার কোর্ট কাটা হয়েছে। সেখানে হৈ হুল্লোড় করে কিছু পুলিশ কর্মকর্তা ব্যাডমিন্টন খেলছে। লোকগুলোকে দেখে তার উচ্চপদস্থ লোকজনই মনে হচ্ছে কিন্তু কারো সাথে কথা বলতে তার সাহস হল না। হঠাৎ তার হাসিবের কথা মনে পড়ল।
তাদের মধ্যে হাসিবই সরকারী চাকুরী করে, দুই বছরের মধ্যে ঢাকাতে পোস্টিংও নিয়ে ফেলেছে। সাইফকে হাসিব ফোন দিয়ে সংক্ষেপে জানালো। হাসিব জানালো ঐ থানার ওসি তার পরিচিত এবং সে কিছুক্ষনের মাঝেই থানায় আসবে বলে জানালো।
থানার পাশেই দোকানে গিয়ে দুটো সিংগারা, দুই কাপ চা আর তিনটে বেনসন শেষ করার পর হাসিব গাড়িতে করে এল।
-কিরে কেমন আছিস? অনেকদিন পর দেখা হল।
-হ্যাঁ ভাল। তুই কেমন আছিস হাসিব?
-এই চলে যাচ্ছে?
-ভাবী কেমন আছে?
-তোর ভাবী ভালই আছে। সারাদিন কেনাকাটা নিয়ে ব্যস্ত।
এই বলে হাসিব সুখের হাসি হাসে। হাসিবের হাত ধরে থানার ভিতরে যাওয়ার জন্যে তাগিদ দেয় সাইফ।
থানার ওসি ব্যাডমিন্টন খেলা শেষে ঘর্মাক্ত শরীরে যখন দাঁড়িয়েছে তখনই ওরা থানার ভিতরে ঢুকল। হাসিব লোকটির সাথে হ্যান্ডশেক করে পরিচয় দিতেই অবাক হল সাইফ। সৈকতের ব্যাপারে ওসিকে বলতেই অফিসের দিকে হাঁটা দিল। ওসিকে সাইফ আর হাসিব পিছু পিছু অনুসরণ করে অফিসে ঢুকলো।
-মুশকিলে ফেলে দিলেন।
সন্ধ্যার পর আমরা কাউকে ছাড়ি না।
হাসিব বলল,
-দেখেন, কিছু করা যায় কিনা?
-এখন কিছুই করা যাবে না। আপনার জন্যে এটুকু করতে পারি কাল সকাল নয়টায় ছেড়ে দিতে পারি। কিন্তু একটা কথা। উনি কে আপনার বন্ধু?
-আমার বন্ধু না।
আমার বন্ধুর বন্ধু।
-ও আচ্ছা। আমার যে অফিসারটা উনাকে ধরেছে সে উনার বিরুদ্ধে খারাপ ব্যবহারের অভিযোগ এনেছেন। আপনারা রাস্তা ঘাটে ঘুড়েন, আপনারা যদি পুলিশের সাথা ঝগড়া করেন তাহলে কে চলে?
সাইফ এতক্ষন চুপ করে সব শুনছিল।
-সৈকত খারাপ ব্যবহার করার ছেলে না।
ও...
-আপনি কে?
-আমার বন্ধু।
হাসিব বলল।
-ও আচ্ছা। শুনেন আমরা সাধারণত বেয়াদবি না করলে ধরি না।
সাইফ কিছু একটা বলতে চাচ্ছিল হাসিব তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
-আচ্ছা কাল নয়টাতেই ছাড়েন।
সমস্যা নেই। এখন একটু ওর সাথে দেখা করা যাবে।
-তা যাবে।
বেল বাজাতেই বাইরে দাঁড়িয়ে লোকটি স্যালুট দিয়ে এসে দাঁড়ালো।
-উনাদেরকে পাশের হাজতে নিয়ে যাও।
-জ্বী স্যার।
হাসিব ওসির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সাইফের সাথে বাইরে এল।
-শুন এখন যেটা করতে হবে দৌড়ে গিয়ে হোটেল থেকে কিছু খাবার নিয়ে আয়।
-মানে আজকে রাত্রে...
-হুম থাকা লাগবে। সকাল ছাড়া ছাড়বে না।
-তুই আরেকটু দ্যাখ না?
-কিছু হবে এখন। মন্ত্রীর পিএসকে ফোন দিয়েও লাভ নেই। বলবে, এই সামন্য কারণে ফোন দিছেন কেন?
সাইফ আর কিছু বলে না।
-তুই দেরি করিস না। জলদি খাবার কিনে আন।
তারপর তোর বন্ধুর সাথে দেখা করে যা।
সাইফ খাবার আনতে চলে যায়। সে ভাবছে অথৈকে কি বলবে? খাবার নিয়ে এসে সৈকতের সাথে দেখা করতে গেল সে। হাজতটাতে কোন ফ্যান নেই। মেঝেতে পানির মত কি যেন পড়ে আছে।
দূর থেকে দুর্গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। সৈকতের সাথে আরো তিনজন আছে সেখানে। ওদেরকে দেখেই বোঝা যায় এরা রাস্তায় রাস্তায় কিছু একটা বিক্রি করে খায়। সাইফকে দেখেই সৈকত দৌড়ে আসে।
-দোস্ত আমাকে জোর করে এমনি এমনি......
বলতে বলতেই কেঁদে ফেলে সে।
-কাঁদিস না। সকালে ছেড়ে দিবে। তোর জন্যে খাবার এনেছি।
-মানে? রাত্রে...
-হ্যাঁ থাকতে হবে।
সৈকতের চেহারা দেখে কষ্ট হতে থাকে সাইফের।
সে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। খাবারগুলো দিয়েই বাইরে বের হয়ে আসল। হাসিবকে বিদায় জানিয়ে সে যখন বাসায় যাবে বলে মনস্থির করল তখন থানার সামনে দাড়িয়ে থাকা লোকটি সামনে এগিয়ে আসল।
-শুনেন ভাই, লোক ধরলে বড় লোক ধরবেন। বুঝলেন?
-মানে?
-মানে বড় লোক ধরলে আজই ছাইড়া দিত।
-ও।
-বুঝেনইতো।
সাইফ হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়িয়ে থানা থেকে বের হয়ে আসে। ঠিক এসময় তার পছন্দের রিংটোনটি বেজে উঠে।
-----------------------------------------------------
উপরের সবকটি ঘটনায় কি আমাদের সমাজে ঘটছে না? আমাদের সমাজ কি এসব ক্ষমতা থেকে কি বের হতে পেরেছে? পারেনি।
তাহলে আমরা কি বর্ণবাদকে লালন করছি না? আমরা কি বর্ণবাদী নই? হ্যাঁ, সত্যি কথা বলতে কি আমরা খুব কমজনই আছি যাদের চরিত্রগুলোকে এই ঘটনা গুলোর বাইরে রাখা যাবে।
-----------------------------
আমার সাইট
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।