বিরোধীদলীয় সাংসদের নির্বাচনী এলাকায় অবস্থিত খুলনার দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরি, তাই তার ভাগ্য খুলছে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশের পরও বন্ধ এই মিলটি এখনো চালু হয়নি। অথচ দলীয় সাংসদ ও শ্রম প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ানের নির্বাচনী এলাকায় অবস্থিত একাধিক বন্ধ সরকারি পাটকল চালু হয়েছে।
যদিও বন্ধ পাটকলসহ দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরি পুনরায় চালুর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নিজেই। সেই আশায় বুক বেঁধেছিলেন এই মিলের শ্রমিকেরা।
কিন্তু মিলটি চালু না হওয়ায় এসব শ্রমিক ও তাঁদের পরিবারের মধ্যে চরম হতাশা বিরাজ করছে।
ফ্যাক্টরিটি চালু না হওয়ার পেছনে রাজনৈতিক ও ভোটের হিসাব থাকতে পারে বলে মনে করেন বিএনপির স্থানীয় সাংসদ নজরুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, শুধু দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরি নয়, উন্নয়নের নানা ক্ষেত্রে আমার নির্বাচনী এলাকা বঞ্চনার শিকার হয়েছে।
সাংসদ জানান, দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরিকে ঘিরে ওই এলাকায় প্রায় আট থেকে ১০ হাজার লোকের বসতি। এসব মানুষ নানাভাবে এই প্রতিষ্ঠানটির ওপর নির্ভরশীল ছিলেন।
মিলটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাঁরা এখন মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
সরেজমিনে সম্প্রতি দাদা ম্যাচ কারখানায় গিয়ে ও শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাঁরা এখনো আশায় আছেন মিলটি আবারও চালু হবে।
মিলের শ্রমিকেরা জানান, ১০ মাসের বেতন বকেয়া রেখেই ২০১০ সালের আগস্ট মাসে মিলটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।
শ্রমিকদের সংগঠন ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সভাপতি দেলোয়ার হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক এইচ এম সাহাদাত এ প্রতিবেদককে বলেন, বেতন ও অন্যান্য পাওনা মিলিয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে শ্রমিকদের প্রায় ছয় কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। যদি মিলটি চালু হয় তাহলে শ্রমিকেরা তাঁদের পাওনা দাবির কিছু কিছু ছাড় দিতেও প্রস্তুত রয়েছেন।
শ্রমিক নেতারা বলেন, সরকার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী খুলনার বন্ধ পাটকলগুলো চালু করেছে। পাটকল চালু করতে সরকার মোটা অঙ্কের ভর্তুকিও দিয়েছে। তার পরও সেগুলো পরিপূর্ণ লাভজনকভাবে চলছে না। অথচ দাদা ম্যাচ কারখানাটি বরাবরই লাভজনক ছিল। বেসরকারি মালিকানায় হস্তান্তরের পর মালিকের নানামুখী ষড়যন্ত্রে এটিকে লোকসানি প্রতিষ্ঠান দেখানো হয়।
উল্লেখ্য, চলতি বছরের ২৪ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খুলনার খালিশপুরে অবস্থিত দৌলতপুর পাটকলটি পুনরায় চালু করেন। নির্বাচনী আসনের হিসাবে পাটকলগুলোর বেশির ভাগের অবস্থান মন্নুজান সুফিয়ানের সংসদীয় এলাকায়।
দাদা ম্যাচের শ্রমিক নেতারা বলছেন, আগামী নির্বাচনের ভোটের হিসাবে কারখানাটি চালু না হওয়ার বিষয়টি ইস্যু হিসেবে কাজ করবে।
দেলোয়ার হোসেন তথ্য-উপাত্ত দিয়ে জানান, খুলনা সিটি করপোরেশনের ৩০ নম্বর ওয়ার্ডভুক্ত রুপসা শিল্পাঞ্চলে মোট ভোটার সংখ্যা ২৯ হাজারের কিছু বেশি। যার প্রায় ১০ হাজার ভোটার এই মিলটির সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে সম্পৃক্ত।
তাই এই এলাকার ভোটের ক্ষেত্রে মিলটি চালুর বিষয়টি প্রভাব ফেলবে।
মিলটি চালু করতে না পারলেও নানাভাবে শ্রমিকদের পাশে রয়েছেন স্থানীয় সাংসদ। ভোটব্যাংক হিসেবে শ্রমিকদের নিজের পক্ষে রাখতে তিনি নানা সাহায্য-সহযোগিতাও অব্যাহত রেখেছেন বলে জানা গেল।
ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সভাপতি আরও জানান, ইউনিয়নের পক্ষ থেকে তাঁরা শিল্প মন্ত্রণালয়কে মিলটি লাভজনক করার লিখিত অঙ্গীকারও করেছেন। শ্রমিকেরা ঘোষণা দিয়েছেন, মিলটি চালু হওয়ার তিন মাসের মধ্যে যদি সেটি লাভের মুখ দেখতে না পারে তাহলে শ্রমিকেরা তাঁদের পাওনা অর্থের দাবি ছেড়ে দেবেন।
খুলনা নগরের রূপসা নদীর তীরে ১৯৫৫ সালে ১৮ একর জমির ওপর কারখানাটি যাত্রা শুরু করে। ১৯৯৩ সালের শেষের দিকে কারখানাটি ব্যক্তি খাতে ইজারা দেওয়া হয়। মিলটি নেয় ভাইয়া গ্রুপ। ২০১০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ভাইয়া গ্রুপ দাদা ম্যাচের উৎপাদন ও ১৮ আগস্ট কারখানাটি বন্ধের ঘোষণা দিয়ে সব শ্রমিক-কর্মচারীদের ছাঁটাই (টারমিনেশন) করে। এরপর থেকে শ্রমিক-কর্মচারীরা মিলটি বাংলাদেশ রসায়ন শিল্প সংস্থার (বিসিআইসি) নিয়ন্ত্রণে নিয়ে চালু ও শ্রমিকদের বকেয়া পাওনা পরিশোধের জন্য আন্দোলন শুরু করে।
এ রকম এক পরিস্থিতিতে ২০১১ সালে খালিশপুরের এক জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কারখানাটি চালুর ঘোষণা দেন। ওই বছরের ২৩ মার্চ শিল্প মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে খুলনা জেলা প্রশাসক কারখানাটির স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বুঝে নেন।
এদিকে বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর খুলনায় বন্ধ দৌলতপুর ও খালিশপুর পাটকল দুটি পুনরায় চালু করে।
বেসরকারীকরণ কমিশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বন্ধ দাদা ম্যাচ কারখানার সম্পদের মূল্য ১৫৬ কোটি টাকা। তার বিপরীতে দায়দেনা রয়েছে ২৬৩ কোটি টাকা।
প্রতিষ্ঠানটি বিক্রি করলে পূর্ণাঙ্গ দায়দেনা পরিশোধ সম্ভব হবে না বলে কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়।
তবে প্রতিষ্ঠানটির আজকের পরিণতির জন্য শ্রমিকেরা ভাইয়া গ্রুপকে দায়ী করেছেন। তাঁরা বলছেন, ভাইয়া গ্রুপের নানা কারসাজির কারণে লাভজনক এই প্রতিষ্ঠানটিকে লোকসানি প্রতিষ্ঠান দেখানো হয়েছে। এ কারণে শ্রমিকেরা এই কারখানাটিকে পুনরায় বেসরকারীকরণের পুরোপুরি বিপক্ষে। শ্রমিকদের দাবি, সরকারের উদ্যোগেই এটি চালু করতে হবে।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।