আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিজ্ঞানে বাঙালীদের অবদান - ২ : মেঘনাদ সাহা

ক্ষুদ্র পরিসরের এই জীবনটাকে আমি ইচ্ছেমত উপভোগ করব। নিষিদ্ধ গলিতে প্রবেশ করে আমি শুদ্ধ হয়ে বের হব। ।

বাঙালী গণিতবিদ ও বিজ্ঞানীদের সাথে পরিচিত হবার ইচ্ছে থেকে ইন্টারনেটে কিছুটা সার্ফিং। ভাবনার আকাশে উকি দিল ধারাবাহিকভাবে এই গুনীজনদের সাথে আমার সময়টা কেমন কাটছে তা একটু শেয়ার করি।

তারই ফলাফল ধারাবাহিক এই লেখার দ্বিতীয় পর্বটি। আজ আমাদের সাথে থাকবেন মেঘনাদ সাহা

মেঘনাদ সাহা
FRS (Fellow of the Royal Socity)
ভারতীয় জ্যোতির্পদার্থবিদ
পদার্থবিজ্ঞানে থার্মাল আয়নাইজেসন তত্ত্বের প্রতিষ্ঠাতা



নরওয়ের জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী সেভিন রোজল্যান্ড অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত তাঁর “থিওরেটিক্যাল এস্ট্রোফিজিক্স” বইতে মেঘনাদ সাহাকে অভিযু্ক্ত করেছেন ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত জ্যোতির্পদার্থবিদ্যার সবগুলো গবেষনা প্রভাবিত করার অপরাধে, যা তিনি করেছেন ১৯২০ সালে তার থার্মাল আয়োনাইজেশন থিওরী প্রকাশের মাধ্যমে।

উপমহাদেশে প্রথম সাইক্লট্রন (এই যন্ত্রের সাহায্যে বিবিন্ন পার্টিকেলের উপস্থিতি প্রমান করা যায়, বর্তমানে এটি বিগ ব্যং থিওরি প্রমানের কাজেও ব্যবহৃত হচ্ছে) স্থাপিত হয় তার প্রচেষ্টায়।

মেঘনাদ সাহা নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনিত হন চারবার।

ধারনা করা হয় জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল দেওয়া চালু না হওয়ায় তিনি নোবেল পাননি।

Dr. M.N. Shaha has won an honoured name in the whole scientific world
-মেঘনাদ সাহা সম্পর্কে আলবার্ট আইনস্টাইন

সংক্ষিপ্ত জীবনী
১৮৯৩ সালের ৬ অক্টোবর ঢাকা থেকে ৪৫ কি.মি. দুরে বংশাই নদীর তীরে শ্যওড়াতলী গ্রামে খুবই দরিদ্র পরিবারে তার জন্ম। ভীষণ ঝড়বৃষ্টির মধ্যে জন্মেছিলেন বলে দাদী নাম রেখেছিলেন মেঘনাথ। স্কুলে গিয়ে নামটি পরিবর্তিত হয়ে দাড়ায় মেঘনাদ বাবা জগন্নাথ সাহা ছিলেন মুদি। অর্থাভাবে বহুপ্রতিকুলতা সত্বেও ঢাকা মিডল স্কুলে প্রথম স্থান অর্জন করেন।

স্কুলটি ছিল তার বাড়ী থেকে প্রায় ১০ কি.মি. দুরে। এতদুর গিয়ে লেখাপড়া করা খুবই কষ্টকর হবে এটা বুঝতে পেরে মেঘনাাদ সাহার বড় ভাই জয়নাথ শিমুলিয়ার ডাক্তার অনন্ত কুমার দাসের বাড়ী একটি কাজের ব্যবস্থা করে দেন। তাকে গোয়াল পরিষ্কার করতে রাখতে হবে, ঘাষ কাটতে হবে,গরুর দেখাশোনা করতে হবে আর বাকী সময়টা লেখাপড়ার জন্য। মাইনর পরীক্ষায় তিনি ঢাকা জেলায় প্রথম হন এবং মাসে চার টাকা করে বৃত্তিও পান। ১৯০৫ সালে তিনি ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হনে।

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে জড়িত হবার অপরাধে তাকে কলেজিয়েট স্কুল ছাড়তে হয়। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন চলাকালে একদিন স্কুল পরিদর্শনে এসেছিলেন তৎকালীন বাংলার গভর্নর বামফিল্ড ফুলার, এবং সেদিন অন্যান্য অনেকের মত মেঘনাদ সাহা এর প্রতিবাদে স্কুলে গেছিলেন খালি পায়ে। এটিই তাকে কলেজিয়েট স্কুল ছাড়তে বাধ্য করার কারন। এমনকি তার বৃত্তিও বন্ধ করে দেয়া হয়। ঐসময় বহিস্কৃতদের মধ্যে আরো ছিলেন নিখিলরঞ্জন সেন।

এ সময় তিনি একটি খ্রিস্টান মিশনের (ব্যাপটিস্ট মিশন) রচনা প্রতিযোগিতায় বয়োজ্যেষ্ঠ্য ডিগ্রি ক্লাসের ছাত্রদের পরাজিত করে ১০০ টাকা পুরস্কার লাভ করেন। এরপর তিনি ১৯০৯ সালে তিনি কিশোরীলাল জুবিলী স্কুলে ভর্তি হন। একই বছর তিনি এনট্রেন্স পরীক্ষায় বাংলা সংস্কৃত, ইংরেজি, ও গণিতে সর্বোচ্চ নম্বর অর্জন করেন। একই পরীক্ষায় তিনি পূর্ব বাংলায় প্রথম ও সমগ্র বাংলায় তৃতীয় হন।

এরপর তিনি ১৯১১ সালে ঢাকা কলেজে থেকে আইএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ন হন।

এরপরে তিনি কোলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াশুনা করেন। প্রেসিডেন্সি কলেজে তিনি সত্যেন্দ্রনাথ বসুপ্রশান্ত চন্দ্র মহালনবিশকে সহপাঠী এবং আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুআচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়কে পান শিক্ষক হিসেবে। গণিতে নিজের আগ্রহের কারনে তিনি স্যর প্রফুল্লের প্রিয় ছাত্রদের খাতায় নাম লিখিয়ে ফেলেন। তিনি প্রথম শ্রেনীতে দ্বিতীয় হয়ে গণিতে সম্মান শেষ করেন।

১৯১৬ সালে স্যর আশুতোষ মুখার্জি তাকে কোলকাতায় নতুন প্রতিষ্ঠিত College of Science এ Physics and Mixed Mathematics বিভাগে লেকচারার পদে নিয়োগ দেন।

তিনি আলবর্ট আইনস্টাইনের থিওরি অব রিলেটিভিটির ছাত্র ছিলেন এই তত্বটি প্রথিষ্ঠিত হবার অনেক আগে থেকেই। ১৯১৭ সালে ফিলজফিক্যল ম্যগাজিনে ম্যক্সওয়েল স্ট্রেসের উপর তার প্রথম প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। ১৯১৯ সালে তিনি তার ডক্টরেটট সম্পন্ন করেন এবং একই বছর তিনি Premchand Roychand Studentship পান 'Selective Radiation Pressure and its Application to the Problems of Astrophysics' শিরোনামের থিসিসের জন্য। পরের বছর ‘Origin of lines in steller spectra’ বিষয়ে তিনি গ্রিফিথ পুরস্কার লাভ করেন। যদুনাথ সরকারআসুতোষ মুখার্জীও Premchand Roychand Studentship প্রাপ্ত ব্যক্তিত্ব।

মেঘনাদ সাহার এই থিসিসটিই তার জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানের আগমনের বার্তা।

Premchand Roychand Studentship এবং গুরুপ্রসন্ন স্কলারশিপ তাকে ১৯২০ সালে ইউরোপের দুয়ার পর্যন্ত যেতে সাহায্যা করে। এখানে তিনি কিছুসময় ইম্পেরিয়াল কলেজে কাজ করেন এবং তার বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানে থার্মাল আয়নাইজেসন তত্ত্ব প্রকাশনার কাজ করতে থাকেন। তাঁর এই তত্ত্ব পদার্থবিজ্ঞানের নতুন দিগন্ত হিসেবে হাজির হয়। এই তত্ত্বের সাহায্যে সূর্যের বর্ণালীতে সিজিয়াম বা রুবিডিয়াম থাকবে না তার ব্যখ্যা দিলেন মেঘনাদ সাহা এবং তিনি ভবিষ্যদ্বানী করেন, যদি সূর্যের দেহের অপেক্ষাকৃত কম তাপ বিশিষ্ট অংশের বর্ণালী নেওয়া যায় তবে সেখানে মৌলগুলির উপস্থিতি দেখা যাবে।

এটি তারকার রাসায়নিক ও ভৌত অবস্থা আরো পরিস্কার করে। এই তত্বটি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় অবজার্ভেটরিতে স্যর লকায়ের ও প্রফেসর পিকারিংয়ের দুই লক্ষ তারকার স্পেক্ট্রা পর্যবেক্ষন ও সুনির্দিষ্টকরন নিয়ে পরিষ্কার ধারনা প্রদান করে। গবেষণার সাহায্যে তিনি যে তত্ত্ব আবিষ্কার করলেন সেটি ল্যাবরেটরিতে ব্যবহারিক প্রয়োগের মাধ্যমে প্রদর্শনের জন্য আমন্ত্রণ পেলেন লন্ডন ও বার্লিন থেকে। ১৯২১ সালে তিনি বার্লিনের উদ্দেশ্য পাড়ি জমান সেখানে ল্যবরেটরিতে স্যর নার্নস্ট এর সাথে তার তত্বটি প্রতিষ্ঠা করার কাজ করার জন্য। ঐসময় তিনি মিউনিখে পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে কথা বলার জন্য প্রফেসর সমারফিল্ড তাকে আমন্ত্রন জানান।

তিনি মে মাসের কাছাকাছি সময়ে তত্বটি প্রমান করতে সক্ষম হন এবং তা Zeitschrift fur Physik Vol 6 এ বার্লিনে প্রকাশিতও হয়। বার্লিনে থাকাকালীন সময়ে তিনি আইনস্টাইনের ঘনিষ্ঠ হন।

কলকাতা ফিরে মেঘনাদ সাহা কলকাতাবিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ল্যবরেটরি প্রতিষ্ঠার কাজে আত্মনিয়োগ করেন, তার ইচ্ছে ছিল তিনি এমন একটি ল্যবরেটরি প্রতিষ্ঠা করবেন যেখানে তিনি তার থিওরি নিয়ে আরো গবেষণা করতে পারবেন। এরকম সময়ে তিনি তার এক বন্ধুর সহযোগিতায় আল্লহাবাদে পদার্থবিজ্ঞানের প্রফেসর হিসেবে যোগদান করেন। এমনসময়ই আয়নাইজেসন তত্ত্ব নতুন কিছু বন্ধু পেয়ে যায়।



তিনি অনেকদিন থেকেই নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞান ভারতে চালু করার জন্য একটি সিলেবাস প্রনয়নের ককাজ করে যাচ্ছিলেন। ১৯৩৪ সালে তিনি Indian Science Academy(যা পরবর্তীতে Indian National Science Academy নামধারন করে এবং কোলকাতা থেকে দিল্লীতে স্থানান্তরিত হয়) গঠনের একটি প্রস্তাবনা সামনে আনেন যেটি Indian Science Congress Association এর স্থান দখল করবে। তার এই উদ্যোগই পরবর্তীতে National Institute of Sciences in India ১৯৩৩ সালে Indian Physical Society এবং ১৯৩৫ সালে Indian Science News Association প্রতিষ্ঠার পিছনেও তার অবদান আছে। এই সংবাদ সংস্থাটি মধ্য ত্রিশের দশকে Science and Culture নামে জার্নাল বের করে যেটি রাজনৈতিক বক্তার বেশে জাতী পুনর্গঠনের পরিকল্পনায় বিতার্কিকের ভুমিকা পালন করে। পুনর্গঠনে বিজ্ঞানের অংশগ্রহন নিয়ে মেঘনাদ সাহা তার ধারনা সুবাষ চন্দ্র বোসের সাথে আলোচনা করেন।

১৯৩৮ সালে তিনি জওহরলাল নেহেরু'র জাতীয় পরিল্পনা কমিটিতে গুরুত্বপূর্ন সদস্য হিসেবে ছিলেন। ১৯৪৮ সালে সরকার Atomic Energy Commission প্রতিষ্ঠা নিয়ে তার মতামত জানতে চায়। ঐসময় ভারতের প্রযোজনীয় মানবসম্পদ নেই এই যুক্তিতে এর বিরোধিতা করেন। ১৯৫১ সালে তার রাজনীতিতে হাতেখড়ি। একজন সতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে তিনি লোকসভার সদস্য নির্বাচিত হন।



১৯৪৫ সালে ২য় বিশ্বযুদ্ধে পারমানবিক বোমার ব্যবহার দেখে তিনি পারমানবিক শক্তি বোমার পরিবর্তে জ্বালানীর কাজে লাগানোর কথা চিন্তা করলেন এবং প্রতিষ্ঠা করলেন Institute of Nuclear Physics (যা পরবর্তীতে Saha Institute of Nuclear Physics নামধারন করে) প্রতিষ্ঠার চাবিকাঠি হয়ে দাড়ায়। ডা. বি সি লাহা সহ আরো অনেকের আর্থিক সহযোগিতায় কানাডা থেকে রেডিয়াম, ইলেকট্রনিক মাইক্রোস্কোপ ইত্যাদি যন্ত্রপাতি যোগাড় করা হয়। এই সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ও বেশ সহযোগী ছিল। ১৯৫০ সালের ১১ জানুয়ারি ইনস্টিটিউটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন রেডিয়াম আবিষ্কারক মাদাম কুরীর কন্যা নোবেল বিজয়ী আইরিন জোলিও কুরী সহ ফ্রেডারিক জোলিও, রবার্ট রবিনসন, জে. ডি. বার্নাল প্রমুখ বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী।

ভারতে বর্তমানে যেই ক্যলেন্ডার বা পঞ্জিকা প্রচলিত তা তৈরিতে মেঘনাদ সাহার অবদান রয়েছে।

এলাকাভেদে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পার্থক্যের কারনে প্রায় অর্ধশতাধিক পঞ্জিকা ভারতে প্রচলিত ছিল। Calender Reform Committee'র চেয়ারম্যন ছিলেন মেঘনাদ সাহা। এই পঞ্জিকা তৈরিতে সূর্যের অয়নগতি মাথায় রাখা হয়। এমনকি ১৯৫৪ সালে ইউনেস্কোর জেনেবভা সম্মেলনে তিনি World Calender Reform নিয়ে একটি প্রস্তাবনাও দিয়েছিলেন।

১৯৫৬ সালে ১৬ ফেব্রুয়ারি স্বরস্বতি পুজার দিন তিনি অজানার উদ্দেশ্যাে যাত্রা করেন।



রচিত গ্রন্থাবলী
1. The Principle of Relativity
2. Treatise on Heat (পদার্থবিজ্ঞানে বহুল ব্যবহৃত)
3. Treatise on Modern Physics
4. Junior Textbook of Heat with Metereology

বাঙালী এই বিজ্ঞানী এখন সারা দুনিয়াতেই পরিচিত জ্যোতির্পদার্থবিদ হিসেবে। সবচেয়ে মজার বিষয়টা হল ইনি পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্রই না। পড়াশুনাটা শুরু করেছিলেন মিশ্র গণিতে। তিনি কি জানতেন এর শেষটা হবে তারা গুনতে গুনতে।

তথ্যসুত্র
উইকিপিডিয়া

bdbiography.com

প্রদীপ দেব, আইনস্টাইনের কাল. ২০০৬, ঢাকা: মীরা প্রকাশন

studyhelpline.net

ছবি গুগল


শেষ কথা
কাউকে বিজ্ঞান শেখানো এই সিরিজটির পিছনে উদ্দেশ্য হিসেবে ছিল না।

বিজ্ঞান সম্পর্কে কেউ যদি কিছুটা আগ্রহী হয়ে উঠেন তাহলেই আমার লেখাটা স্বার্থাক বলে মনে করব। লেখাটার পিছনে আরেকটা কারন হল বাংলা শুধুমাত্র কবিতা আর সাহিত্যের না। বাংলায় কথা বলা এরকম অনেকেই বিজ্ঞানকেও বুঝেছেন মাতৃভাষার মতই। আমরাও বিজ্ঞানকে আলিঙ্গন করব মেঘনাদ সাহার মতই গভীর মমতায়, এই কামনায়।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.