এই মহাবিশ্ব কী দিয়ে তৈরি? এর শুরুটা কেমন ছিল? এমন প্রশ্ন বেশ পুরোনো হলেও জটিল জটিল সব যন্ত্রপাতি দিয়ে তার উত্তর খোঁজার কাজ করছে পরমাণুবিষয়ক ইউরোপীয় গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সার্ন।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও জটিলতম এ গবেষণাকাজের লক্ষ্য ও সহযোগিতার বিষয়টি এবার আরও বিস্তৃতভাবে জানিয়ে গেলেন প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক রালফ ডিটার হয়্যার। ৬ এপ্রিল তিন দিনের সফরে প্রথমবারের মতো ঢাকায় আসেন জার্মান এই পদার্থবিজ্ঞানী। বক্তা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে।
গত মঙ্গলবার রাজধানীর একটি হোটেলে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন রালফ ডিটার।
আলাপচারিতায় সার্নের কর্মকাণ্ডের সূত্র ধরে উঠে আসে বাঙালি পদার্থবিদ সত্যেন্দ্রনাথ বসুর কথা। বললেন, সত্যেন্দ্রনাথ বসুর মতো মৌলিক গবেষণাই পারে দেশকে বদলে দিতে।
এমন গবেষণামনস্কতার কাজটির শুরু যে শৈশবেই গড়ে তোলা দরকার, তারও তাগিদ দিলেন রালফ। তাঁর মতে, শৈশবই হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। আর সেখানেই থাকে বিজ্ঞানশিক্ষায় মনোযোগের ঘাটতি।
এমন বৈপরীত্য থাকলে দেশের উন্নতি হবে না।
সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নামটি জড়িয়ে আছে হিগস বোসন বা ঈশ্বর-কণার নামের সঙ্গে। কয়েক বছর ধরে সার্নের গবেষণাগারে এ কণার অস্তিত্বের সন্ধান নিয়ে সারা বিশ্বে আলোচনা। কারণ, কণাটি ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি-রহস্যসহ অনেক প্রশ্নের জবাব দিতে পারে। তবে ঈশ্বর-কণা নামটি ভুলভাবে প্রচার পেলেও রালফ ঠিকই শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নাম।
হিগস-বোসন, যা না থাকলে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়বে পদার্থবিজ্ঞানীদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব। কিন্তু বাস্তবে কণাটি ধরা ছিল কঠিন কাজ। ত্যক্ত-বিরক্ত বিজ্ঞানীরা তখন একে ‘গডড্যাম’ পার্টিকল নামে ডাকতে শুরু করলেন। এই গডড্যাম কণা হিগস-বোসনকে নিয়ে জনপ্রিয় বিজ্ঞান লেখক লিওন লেডারম্যান একটি বই লেখেন, যার শিরোণাম ছিল, দ্য গডড্যাম পার্টিকল: ইফ ইউনিভার্স ইজ দি আনসার, হোয়াট ইজ দ্য কোয়েশ্চেন? পরে বইটির কাটতি বাড়ানোর লক্ষ্যে গডড্যামের বদলে গড বসিয়ে দেওয়া হয়। এতে কণাটির নাম হয়ে যায় গড পার্টিকল বা ঈশ্বর কণা।
ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী পিটার হিগস ১৯৬৪ সালে প্রথম ওই কণার অস্তিত্ব কল্পনা করেছিলেন বলে নামটির মধ্যে রয়েছে হিগস। আর কণাটা যে বিশেষ জাতের, তার কথা প্রথম সত্যেন্দ্রনাথ বসু বলেছিলেন। সে কারণে ওটা বোসন। তবে ইংরেজিতে এই কণাটির বানান লেখার ক্ষেত্রে নিজের আপত্তির কথা জানিয়ে রালফ বললেন, ‘আমি প্রায়ই হিগস বোসন লিখতে গিয়ে দুটি শব্দের শুরুতেই বড় অক্ষর দিয়ে লিখি। সত্যেন্দ্রনাথ বসুর কথা মাথায় রেখেই বোসন লিখতে গিয়ে ইচ্ছা করেই বড় হাতের অক্ষরে শুরু করি।
কারণ এটা সত্যেন্দ্রনাথ বসুর প্রাপ্য। ’
রালফ ডিটার হয়্যার সব সময় বলেন, বিজ্ঞানশিক্ষার উন্নতি ছাড়া কোনো দেশের অগ্রগতি সম্ভব নয়। তাই বিজ্ঞানকে প্রাত্যহিক জীবনাচারের অংশে পরিণত করতে হবে। আগ্রহটা তৈরি করতে হবে শিশু-কিশোরদের মাঝে। এর কারণও জানালেন।
বললেন, ‘একটা নির্দিষ্ট বয়সের পর শিক্ষার্থী পড়াশোনার বিষয়বস্তু বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। শিশুদের মাঝে বিজ্ঞানশিক্ষায় আগ্রহ তৈরির অংশ হিসেবে সার্ন সদর দপ্তরের আশপাশের স্কুলের শিক্ষার্থীদের সংস্থায় আনার কর্মসূচি রয়েছে। সার্ন ঘুরে দেখার পর তাদের মত নেওয়া হয়। এমন তিন শ শিশু-কিশোরের সঙ্গে কথা বলার পর তাদের আগ্রহ আমাকে মুগ্ধ করেছে। ’
বাংলাদেশের বিজ্ঞানশিক্ষায় অগ্রগতির জন্য করণীয় কী? রালফ বললেন, ‘সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে শিক্ষকের ভূমিকা।
পদার্থবিদ্যার প্রথম শিক্ষক হিসেবে যাঁকে পেয়েছিলাম, তাঁর অনুপ্রেরণা না থাকলে আজ আমার এতটা পথ পাড়ি দেওয়া হতো না। অনুপ্রেরণাদায়ক শিক্ষকের পাশাপাশি পুরো শিক্ষাব্যবস্থায় তরুণদের বিজ্ঞানশিক্ষায় উৎসাহিত করার ব্যবস্থা থাকতে হবে। জটিল কোনো প্রশ্নেরও যে সমাধান হয়, এমন বিষয় তাদের উৎসাহিত করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ অভিযানের পর থেকেই বিপুলসংখ্যক তরুণের মাঝে প্রকৌশল বিদ্যা পড়ার হিড়িক শুরু হয়। হিগস বোসন নিয়ে আমাদের গবেষণার দুই বছর পরও আমরা কী করছি, তা সারা বিশ্ব কৌতূহলের সঙ্গে লক্ষ রাখছে।
এমন আগ্রহ নিঃসন্দেহে প্রেরণাদায়ক। ’
রালফ ডিটার হয়্যার জানান, পদার্থবিদ্যার বড় গবেষণাগার হিসেবে পরিচিত সার্নের সঙ্গে এ বছরের মাঝামাঝিতে বাংলাদেশের একটি সহযোগিতামূলক সমঝোতা স্মারক সই হতে যাচ্ছে। এর আওতায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ ও যৌথ গবেষণা পরিচালনার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত থাকবে। বিজ্ঞানশিক্ষকদের প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে এ বছরের শেষ দিকে ঢাকায় একটি কর্মশালারও আয়োজন করবে সার্ন।
সার্নের মহাপরিচালক বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীসহ বিভিন্ন জনের সঙ্গে আলোচনায় বলেছি, রাতারাতি দুই পক্ষের মধ্যে সহযোগিতা প্রতিষ্ঠার কোনো পরিকল্পনা করাটা সমীচীন হবে না।
আমাদের এগোতে হবে ধাপে ধাপে। প্রথম ধাপটা হবে শিক্ষা। মানে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষক, খুব শিগগিরই তাদের জন্য আমরা একটি কর্মশালা করতে চাই। তাদের আধুনিক পদার্থবিদ্যার বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে চাই। পরে প্রশিক্ষিত এসব শিক্ষকই অন্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেবে, এর মাধ্যমে একটি নেটওয়ার্ক গড়ে উঠবে।
’
রালফ ডিটার হয়্যার জানান, সার্নের দুই মাসের গ্রীষ্মকালীন কর্মসূচির অংশ হিসেবে বাংলাদেশ থেকে শিক্ষার্থী নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। সারা বিশ্ব থেকে এ কর্মসূচিতে তিন শ শিক্ষার্থীকে নেওয়া হয়। বাংলাদেশের একজন শিক্ষার্থী (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের) আগামী গ্রীষ্মের কর্মসূচিতে এ সুযোগ পাবেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।