একটি কঠোর দীর্ঘমেয়াদি অশান্তিপূর্ণ ক্রান্তিকালীন সময় অতিক্রম করছে বাংলাদেশ। অনেক জ্বালাও-পোড়াও, বৃক্ষনিধন, রেললাইন উপড়ানো, পেট্রল ঢেলে মানুষ পোড়ানো, অব্যাহত অবরোধের পরও ৫ জানুয়ারির নির্বাচনটি সরকার করতে পেরেছে। এত ঋণাত্দক পরিস্থিতির পরও সরকার এ জন্য নির্বাচনটি করতে পেরেছে যে, বিরোধী দলের আহ্বানে সাধারণ মানুষ খুব একটা সাড়া দেয়নি কিংবা বলা যায়, তাদের আন্দোলন কার্যত ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু তারপরও এ নির্বাচনটির জন্য এ দেশ ও জাতিকে দিতে হয়েছে চরম মূল্য। কেবল নির্বাচনের দিনই নিহত হয়েছে ২২ জন। কিন্তু কেন ২০১৩ সালে ১০৪৪ ডলার মাথাপিছু আয়ে উত্তীর্ণ হওয়া জাতিটির কপালে এ দুর্যোগ? দেখা যাক এর স্বরূপ সন্ধান!
এ সরকারের আমলে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক প্রচলিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা অবৈধ ঘোষিত হলে সরকার রায়ের আলোকে সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করে সরকার ও বিরোধী দলের সমন্বয়ে সংসদীয় উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করা হয়, যারা রায়ের প্রেক্ষিতে সংবিধান সংশোধনের সুপারিশ করবে। কিন্তু সরকারের আমন্ত্রণ সত্ত্বেও বিএনপি বিরোধী দল হিসেবে ওই কার্যক্রমে অংশগ্রহণ থেকে রহস্যজনকভাবে বিরত থাকে।
তারা অন্য কোনো বিকল্প পন্থা গ্রহণের পরিবর্তে কেবল 'অবৈধ ঘোষিত' তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার পক্ষেই কথা বলতে থাকে। এমনকি সুপ্রিমকোর্টের ফুলবেঞ্চ কর্তৃক ঘোষিত রায়ের পরও আদালতের অবজারভেশনে কথিত 'পরবর্তী দুটি নির্বাচন বাতিল ঘোষিত তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থায় হতে পারে' এ বাক্যের ওপর অনড় থাকে, তথা জনগণের দৃষ্টি ঘোরাতে চায় নিজেদের পক্ষে। পরিস্থিতি হতে থাকে সাংঘর্ষিক ক্রমান্বয়ে! যদিও দেশের সর্বোচ্চ আদালত ওই বাক্যকে ঙনষরমধঃড়ৎু বলেননি, বরং দেশের সংসদের ওপর এর পূর্ণ ভার অর্পণ করেছেন। সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা এ ব্যাপারে কমবেশি সবাই জানে। এ ক্ষেত্রে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে বিএনপির যা করা উচিত ছিল তা হচ্ছে : ক. প্রধান বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি পঞ্চদশ সংশোধনীর বিষয়ে কোর্টের রায় রিভিউর জন্য আবেদন করলে একটি অন্যরকম ফলাফলও হতে পারত; খ. যেহেতু সরকার কোর্টের আংশিক রায়ের ওপর ভিত্তি করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্তির উদ্যোগ নেয়, সেক্ষেত্রে বিএনপির উচিত ছিল পূর্ণাঙ্গ রায় না হওয়া পর্যন্ত এ বিষয়ে সংসদে যাতে কোনো রকম বিল উত্থাপিত না হয়, সে ব্যাপারে স্থগিতাদেশ চেয়ে কোর্টে রিট করা; গ. তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় যে ত্রুটিগুলো ছিল বিএনপি তা সংশোধনের প্রস্তাব করতে পারত এবং তা সব দলের সমঝোতার ভিত্তিতে সমাধান হতে পারত। তাদের এই প্রস্তাব যদি সরকার অগ্রাহ্য করত, তখন তারা দেশব্যাপী প্রচারাভিযান করে জনগণকে অবহিত এবং তাদের পক্ষে জোরালো জনমত সংগঠিত করতে পারত। আমরা বিশ্বাস করি, এতে ভিন্নরকম একটা ফলাফল আসত, আজকের এই সংকট সৃৃষ্টির হয়তো কোনো সুযোগই থাকত না। ঘ. সবার কাম্য একটি গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু শান্তিপূর্ণ নির্বাচন কিন্তু তা সম্পন্ন করার লক্ষ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিকল্প বিএনপি কিছু ভাবেনি বা ভাবতে পারেনি। যা বিএনপির মতো একটি বড় দলের কাছ থেকে আশা করা যায় না। সন্তোষজনক একটি বিকল্প পথ অনেক সময়ই সংকট উত্তরণে সহায়ক ভূমিকা পালন করে এবং আলোর পথ দেখায়। একটি ওষুধই একটি রোগের একমাত্র নিরাময়ক, এটা ভাবা অযৌক্তিক ও অর্থহীন। ঙ. বিএনপির সংসদে বা সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে যাওয়ার সুযোগ ছিল। সেখানে গিয়ে তাদের যৌক্তিক দাবির পক্ষে জোরালো বক্তব্য পেশ করতে পারত কিন্তু তা তারা করেনি। সবশেষে নির্বাচনকালীন সরকারে যোগদানের আমন্ত্রণ, এমনকি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রদানের প্রস্তাবও বিএনপি অগ্রাহ্য করে।
একইভাবে ভয়াবহ সংকট উত্তরণে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যা করতে পারত : ক. যে সময় আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য আন্দোলন করেছে ওই সময় ভোট গ্রহণ পদ্ধতি ছিল অনেক ত্রুটিপূর্ণ, বিশেষত ভোটার আইডি কার্ড ছিল না, স্বচ্ছ ব্যালট বাঙ্ ছিল না, মানুষের কাছে এত মোবাইল ফোন ছিল না, এত শক্তিশালী উন্মুক্ত মিডিয়া ছিল না, এতে ভোট কারচুপিরও সুযোগ ছিল। তদুপরি এক কোটির ওপর ভুয়া ভোটার ছিল এবং একই ব্যক্তির দুই তিন স্থানে ভোটার হওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু এখন দেশে সে অবস্থা নেই, ফলে কারচুপির সুযোগও একেবারে সীমিত হয়ে পড়েছে। এ বাস্তবতাটি আওয়ামী লীগ জনগণকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছে। খ. আওয়ামী লীগ দুই বছরের অধিক সময় পেলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিলুপ্তির পক্ষে জনগণের কাছে ইতিবাচক প্রচার তথা জনসমর্থন অর্জনের পক্ষে কাজ করতে ব্যর্থ হয়েছে। গ. অনেক সাধারণ মানুষই বুঝতে পারেনি যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা মূল সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কেন বা কীভাবে?
নির্বাচন-সংক্রান্ত সংকটের জন্য সরকার কম-বেশি দায়ী হলেও কালের কষ্টিপাথরে অবশ্যই বিরোধী দলকে নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের দায় বহন করতে হবে। বিশেষ করে জামায়াত-শিবির-হেফাজতকে নিয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নামে গাছকাটা, রেললাইন উৎপাটন, রাজপথে পেট্রল ঢেলে মানুষ পোড়ানো, অবরোধের নামে মানুষকে জিম্মি করা ইত্যাদি। এটা কি গণতান্ত্রিক আন্দোলন, তাহলে রাস্তায় লাখ লাখ মানুষের ঢল কই? রাজপথে হঠাৎ করে কিছু সন্ত্রাসী কর্তৃক পেট্রলবোমা মেরে আগুন দেওয়া কিংবা গোপনে রেললাইনের ফিশপ্লেট খুলে ট্রেনকে লাইনচ্যুত করা যদি গণতান্ত্রিক আন্দোলন হয়, তবে এরূপ আন্দোলন করতে বিশাল রাজনৈতিক দল লাগে না, ১০০-২০০ সন্ত্রাসীর একটি গ্রুপই যথেষ্ট নয় কি? আর যারা ইসলামী আন্দোলনের নামে এসব কর্মকাণ্ড করছে তাদের সঙ্গে ইসলামের সম্পর্ক কোথায়? বিরোধী দলে গেলেই সংসদ বর্জন করা এ দেশে নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিরোধী দল সংসদে সরকারি দলকে যুক্তি দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা না করে শুধু মাঠে, ঘাটে ও রাস্তায় আন্দোলন করে। তারা যদি মাঠে ঘাটে ও রাস্তায় আন্দোলন করবেন, তাহলে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন কেন? রাস্তায় আন্দোলন করার জন্য জনগণের মূল্যবান ম্যান্ডেট নেওয়ার প্রয়োজন হয় না। যে কোনো ব্যক্তি, দল বা গোষ্ঠী যে কোনো কারণেই রাস্তায় আন্দোলন করতে পারে। সংসদে গিয়ে আইন প্রণয়নসহ সংসদকে কার্যকর করার জন্যই এমপিদের বেতন-ভাতাসহ নানা সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা হয়। জনগণ রায় দিয়ে যাদের নেতা বানায়, তারা আমাদের জন্য অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব, সমাজের দিশারী, সে নেতারা যদি দায়িত্ব পালন না করে সুযোগ-সুবিধা এবং সম্মানী নেন, তাহলে সাধারণ জনগণ কী শিখবে? অফিসে না গিয়েই বেতন নেব আমরা? কাজ না করেই মজুরি ও সুবিধাদি? এটা একটা বিরাট প্রশ্ন এবং এর উত্তর দেওয়া সংশ্লিষ্ট নেতাদের নৈতিক দায়িত্ব। বিরোধী দলকে বুঝতে হবে একটা বৈধ ট্রেন ছাড়ার সময় হলে তা ছাড়বেই, কেউ তাতে না উঠলে ট্রেন কি বন্ধ থাকবে? সরকার কি বিরোধী দলকে নির্বাচনী ট্রেনে চড়তে বাধা দিয়েছে? বরং যথার্থ আইনি ট্রেন অনটাইমে ছেড়েছে, যাতে উঠতে পারেনি কিংবা ইচ্ছা করে ওঠেনি বিরোধী দল। তারা আহ্বান জানিয়েছে জনগণকে এ নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করতে, সাধারণ মানুষ তাদের নির্দেশ অবজ্ঞা করেছে, যেমন অবজ্ঞা করেছিল খোদ বেগম খালেদা জিয়ার নির্দেশ তার দলীয় নেতা-কর্মীরা, ৫ মে মতিঝিলে হেফাজতের সঙ্গে একাত্দতা ঘোষণায়ও!
তারপরও বাংলাদেশ হাঁটছে এখন উন্নয়নের গতিশীল গ্লোবাল মহাপৃথিবীতে! আমাদের রপ্তানি খাত এখন ঈর্ষণীয় উচ্চতায়! বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রেকর্ড ছাড়িয়েছে কয়েকবার! আমরা একটা ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বে পরিচিতি পেতে চাই না, চাই না বিশ্বের কাছে আমাদের মাথা নত হোক, একতরফা নির্বাচনের তকমা লাগিয়ে। জননেত্রী শেখ হাসিনা গণতান্ত্রিক সংগ্রামের প্রতীক! তাকে অবশ্যই উদ্যোগ নিতে হবে ১১তম সংসদ নির্বাচনের জন্য বিশ্বস্বীকৃত তথা বিতর্কমুক্ত পদ্ধতির। বাঙালি জাতির হারানো মর্যাদা তাকেই প্রতিষ্ঠা করতে হবে বিশ্বের মানুষের সামনে। যদিও একটি বৃহৎ দল হিসেবে বিএনপিকে (এখন আর প্রধান বিরোধী দল নয়) অবশ্যই একগুঁয়েমি ত্যাগ করতে হবে, সঙ্গ ত্যাগ করতে হবে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত-শিবির এবং নারী আর প্রগতির বিপক্ষে দাঁড়ানো হেফাজতের। না হলে গাছকাটা, ট্রেনলাইন উপড়ানো, পেট্রলে মানুষ পোড়ানো তথাকথিত ইসলামী দল নিয়ে বিএনপি যদি তাদের ঋণাত্দক রাজনীতি চালাতেই থাকে, তবে তাদের বিলুপ্তি হতে বেশি সময় লাগবে না, কারণ মুসলিম লীগও এদেশে এক সময় বৃহত্তর রাজনৈতিক দল ছিল। যাকে খুঁজতে এখন হয়রান হতে হয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকদেরও!
লেখক : সাবেক জাতীয় সংসদ সদস্য।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।