বহুল আলোচিত দশ ট্রাক অস্ত্র আটকের ঘটনার বিষয়টি অবগত হওয়ার পরও কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে রহস্যজনক কারণে নীরব ভূমিকা পালন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার পূর্ণাঙ্গ রায়ের পর্যবেক্ষণ থেকে বিষয়টি জানা গেছে। গতকাল চট্টগ্রামের স্পেশাল ট্রাইবুনাল-১-এর বিচারক এস এম মুজিবুর রহমান এ পূর্ণাঙ্গ রায়ে স্বাক্ষর করেন।
একই সঙ্গে আদালত গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীদের দেওয়া জবানবন্দি থেকে উল্লেখ করেন, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর এ ঘটনার সঙ্গে পুরোপুরি জড়িত ছিলেন। সাক্ষীদের জবানবন্দিতে বলা হয়, ঘটনাস্থল থেকে আটক পাঁচ ব্যক্তিকে ছেড়ে দেওয়া, সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে তৎকালীন পুলিশকর্তাদের নিষেধ করা এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন থেকে এনএসআই কর্মকর্তাদের বাদ দেওয়ার নির্দেশও বাবরের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ করে। তবে এই সাক্ষ্যপ্রমাণে আরও পাওয়া গেছে, নিজামী ও বাবর অস্ত্র আটকের বিষয়টি সরকারের উচ্চপর্যায় জানেন বলেও উল্লেখ করেছিলেন।
চোরাচালান ও অস্ত্র আটকের ঘটনায় পৃথক দুটি মামলায় চোরাচালান ২৬০ পৃষ্ঠা এবং অস্ত্র আটক মামলার ২৫৪ পৃষ্ঠার মধ্যে মোট ৫১৪ পৃষ্ঠার রায়ের কপিতে স্বাক্ষর করার কথা জানিয়ে ট্রাইব্যুনালের বেঞ্চ সহকারী মোহাম্মদ ফুয়াদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এখন পূর্ণাঙ্গ রায় সুপ্রিম কোর্টে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। তবে আদালত পৃথকভাবে আট পৃষ্ঠা করে মোট ১৬ পৃষ্ঠার পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন।
চোরাচালানের দায়ে জামায়াতের আমির ও জোট সরকারের শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী, তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বিএনপি নেতা লুৎফুজ্জামান বাবর ও উলফার সামরিক কমান্ডার পরেশ বড়ুয়াসহ ১৪ আসামিকে সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন বিচারক।
তৎকালীন সরকারের মন্ত্রী, সামরিক-বেসামরিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার নেতা পরেশ বড়ুয়ার যাগসাজশে পরিকল্পিতভাবে দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার ঘটনা ঘটান। আলোচিত এ মামলার পূর্ণাঙ্গ রায়ে আদালতের পর্যবেক্ষণে এটি উঠে এসেছে। এতে আদালত আরও বলেন, ন্যক্কারজনক এ ঘটনার সঙ্গে তৎকালীন সরকারের মন্ত্রী, এনএসআই-ডিজিএফআইর মতো গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার ঊধর্্বতন কর্মকর্তারা সরাসরি যুক্ত। পরেশ বড়ুয়ার সঙ্গে সরকারি গোয়েন্দা সংস্থা দুটির উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের গভীর সম্পর্কের বিষয়টি সাক্ষ্যপ্রমাণে প্রতিষ্ঠিত।
পর্যবেক্ষণে বলা হয়, বাবরের নির্দেশেই অস্ত্র আটকের সময় ঘটনাস্থলে থাকা সার্জেন্ট হেলাল ও আলাউদ্দিনকে পরে গ্রেপ্তার ও নির্যাতন করা হয় বলে এ দুজন আদালতে দাবি করেছেন। চাক্ষুষ সাক্ষীদের অমানুষিক নির্যাতনও নজিরবিহীন বলে পর্যালোচনায় উল্লেখ করেন। 'জড়িতদের বিরুদ্ধে নূ্যনতম আইনগত ব্যবস্থা না নিয়ে কৌশলে তাদের আড়াল করার চেষ্টা করেন বাবর।' রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব পালনকালে প্রতিবেশী দেশের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের এ নেতাকে তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে রেখে বড় মাপের অপরাধ করেছেন। এনএসআই-ডিজিএফআইর লোকজন পরেশ বড়ুয়াকে আশ্রয়-প্রশ্রয় না দিলে এত বড় ঘটনা ঘটত না। আন্তর্জাতিক চোরাকারবারিরা দেশের নীতিনির্ধারকসহ সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের লোভ দেখিয়ে সে দেশকেই চোরাচালান বা সন্ত্রাসী কাজের জন্য ব্যবহার করে। উলফা নেতা এবং এ মামলার আসামি পরেশ বড়ুয়াও এ ঘটনার ক্ষেত্রে একই পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, ডিজিএফআই ও এনএসআইর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা পরেশ বড়ুয়ার সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রেখে উলফাকে শক্তিশালী করতে বিশ্বের সর্ববৃহৎ অস্ত্র ও গোলাবারুদের চালান আনার ঘটনায় নিজেদের সম্পৃক্ত করেন।
'নজিরবিহীন ও বড় মাপের' ঘটনা : সরকারি মদদ ছাড়া এত বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ অন্য দেশ থেকে বাংলাদেশে আনা কোনো অবস্থাতেই সম্ভব নয় বলে আদালত মন্তব্য করেন। পর্যবেক্ষণে বলা হয়, সাক্ষ্যপ্রমাণে সাব্যস্ত হয় অস্ত্র চোরাকারবারে জড়িত সব আসামির জ্ঞান ও নিয়ন্ত্রণ ছিল। এ যৌথ জ্ঞান ও নিয়ন্ত্রণকে এগুলোর ওপর তাদের দখল ছিল বলে বিবেচনা করা যায়। আদালত রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেন, দশ ট্রাক অস্ত্র গোলাবারুদ আটকের ঘটনায় মামলা সারা বিশ্বে এর আগে হয়েছে কি না জানা নেই। বাংলাদেশের জলসীমা ও স্থলভাগ ব্যবহার করে অস্ত্র চোরাচালানের ঘটনায় 'নজিরবিহীন ও বড় মাপের' ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এ মামলায় দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তিই একমাত্র প্রাপ্য বলে বিচারক মন্তব্য করেন।
মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়ার ব্যাখ্যা : ১৪ আসামিকে প্রাণদণ্ডাদেশ দেওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে বলা হয়, মামলাটি বাংলাদেশের সাধারণ অস্ত্র মামলার মতো নয়। তাই দশ ট্রাক অস্ত্র মামলায় দোষী প্রমাণিত আসামিদের শাস্তি প্রমাণে অন্য অস্ত্র মামলা বিবেচনায় নেওয়ার সুযোগ নেই। সর্বোচ্চ শাস্তি না হলে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়া অসম্ভব কিছু নয়। এ জন্য দোষী সাব্যস্ত সবাইকে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া হয়েছে বলে পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করা হয়েছে।
তদন্ত কমিটির গাফিলতি : অস্ত্র আটকের ঘটনার পর গঠিত সরকারি তদন্ত কমিটির দেওয়া প্রতিবেদনে ঘটনায় মাত্র তিনজনের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া অবিশ্বাস্য বলে মন্তব্য আদালতের। বিস্ময়করভাবে ঘটনার মূল হোতা পরেশ বড়ুয়া নামটি সেই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়নি। মাত্র তিনজন কয়েক হাজার কোটি টাকা মূল্যের চীন দেশে তৈরি অস্ত্র আন্তর্জাতিক ও বাংলাদেশের জলসীমা ব্যবহার করে আনতে সক্ষম হবেন, এটি বিশ্বাসযোগ্য নয়।
৩০ জানুয়ারি ঘোষিত রায়ে ১৪ জনের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, এনএসআইর সাবেক মহাপরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মে. জে. রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, এনএসআইর সাবেক মহাপরিচালক অবসরপ্রাপ্ত ব্রি. জে. আবদুর রহিম, ডিজিএফআইর সাবেক পরিচালক (নিরাপত্তা) অবসরপ্রাপ্ত উইং কমান্ডার সাহাবুদ্দিন আহমেদ, এনএসআইর সাবেক উপ-পরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মে. লিয়াকত হোসেন, এনএসআইর সাবেক মাঠ কর্মকর্তা আকবর হোসেন খান, রাষ্ট্রায়ত্ত সার-কারখানা চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেডের (সিইউএফএল) সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহসিন উদ্দিন তালুকদার, সিইউএফএলের সাবেক মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) কে এম এনামুল হক, চোরাচালানি হিসেবে অভিযুক্ত হাফিজুর রহমান, অস্ত্র খালাসের জন্য শ্রমিক সরবরাহকারী দীন মোহাম্মদ ও হাজি আবদুস সোবহান।
পলাতক রয়েছেন সাবেক ভারপ্রাপ্ত শিল্পসচিব নুরুল আমিন ও উলফা নেতা পরেশ বড়ুয়া। অস্ত্র চোরাচালান মামলায় ৫২ জনের মধ্যে বাকি ৩৮ আসামি বেকসুর খালাস পেয়েছেন। অস্ত্র আটক মামলায় ৫০ জনের মধ্যে বাকি ৩৬ জন বেকসুর খালাস পান।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।