আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নেতৃস্থানীয় দুটি দলের মধ্যেই রয়েছে 'নিষ্ঠার দাম্ভিকতা'। না তারা কেউ মনে করে যে নিজেদের কোনো ভুল হতে পারে, না মনে করে প্রতিপক্ষের এ বিষয়ে সমালোচনার অধিকার রয়েছে। তাই তারা কখনোই নিজের ভুল স্বীকার কিংবা প্রতিপক্ষের ভালো কাজের প্রশংসা করে না। বিষয়টি এমন যে, ভালোর সবটুকুই তাদের এবং মন্দ ছাড়া কিছুই করতে পারে না প্রতিপক্ষ।
আর এই রাজনৈতিক সংস্কৃতির সবচেয়ে দুঃখজনক অভিব্যক্তি হলো, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বা নিজ দলের ক্যাডারদের হাতে বিরোধী দলের নেতা-কর্মী 'খুন', 'নির্যাতন' ও 'গুম'-এর যে অভিযোগ, তা ক্ষমতাসীন দল সব সময়ই অভ্যাসগতভাবে মোকাবিলা করে থাকে। তবে এটাও সত্যি যে, আমাদের বিরোধী দলও হতবুদ্ধিকর অভিযোগ করে থাকে এবং যথেষ্ট বিস্তারিত তথ্য দিতে পারে না, যাতে এটি একটি বিশ্বাসযোগ্য বিষয় বলে মনে হতে পারে। সারকথা হলো, তাদের পারস্পরিক দোষারোপের ফলে বহু তাজা প্রাণ হারিয়ে যায় এবং এই মৃত্যুগুলো জায়গা করে নেয় সমাধিস্থলে। অনুতাপের বিষয় এই যে, বর্তমান সময়ে ঠিক এ ধরনের খেলাই চলছে। মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে কিছু গুরুতর অপরাধ ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ তুললেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। প্রথমেই তিনি উল্লেখ করলেন, আওয়ামী লীগ সরকার ২০১৩ সালের ২৬ ডিসেম্বর থেকে গত ২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত এক মাসে হত্যা করেছে ২৪২ জনকে এবং গুম করেছে আরও অন্তত ৬০ জন। দ্বিতীয়ত বিএনপি নেত্রী অভিযোগ করে বলেন, শেখ হাসিনার অধীন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা রূপ নিয়েছে 'কিলিং ফোর্স'-এ, যাকে তিনি আখ্যায়িত করেছেন 'রাজনৈতিকীকরণ' বলে, এর অর্থ এই যে, শুধু 'আনুগত্যের' কারণে দলীয় লোকজনকে নিয়োগ, পদোন্নতি ও পছন্দমতো পোস্টিং দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে যেমনটি ভাবা গিয়েছিল সেভাবেই প্রতিপক্ষের অভিযোগ খণ্ডন করে প্রধানমন্ত্রী সংসদের প্রশ্নোত্তর পর্বে বললেন, আলোচিত দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার যে রায় সোমবার ঘোষিত হলো, এতে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া এবং তার ছেলে তারেকের ভূমিকা ও সম্পৃক্ততা নিয়ে তদন্ত হবে। আমরা বিএনপি নেত্রীর অভিযোগগুলো গুরুত্ব সহকারে নিতে চাই। তিনি দুবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী, দুবার সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা এবং এখনো দেশের শীর্ষ দুই দলের একটির প্রধান বলেই তার অভিযোগ সর্বোচ্চ ও বিশেষ বিবেচনার দাবি রাখে। তার অভিযোগে খুন ও গুমের যে সংখ্যাটি উল্লেখ করা হয়েছে তা মূলত বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে আসা। আর এই যে ২৪২ জনের খুন হওয়ার যে সংখ্যাটির কথা বলেছেন, এর মধ্যে তিনি নাম উল্লেখ করেছেন মাত্র দুজনের। তারা হলেন মেহেরপুর জামায়াতের স্থানীয় আমির তারেক মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ ও নোয়াখালীর উপজেলা বিএনপি নেতা তৌহিদুল ইসলাম। আর গুম হওয়াদের মধ্যে নাম বলতে পেরেছেন মাত্র তিনজনের। তিনি জেলাভিত্তিক খুন ও গুম হওয়া ব্যক্তিদের তালিকা উপস্থাপন করেছেন, যেখানে কারও নাম বা বিস্তারিত তথ্য নেই। খালেদা জিয়ার তালিকা অনুযায়ী সর্বোচ্চ মৃত্যু হয়েছে এমন আট জেলার মধ্যে রয়েছে_সাতক্ষীরায় ২৭ জন, চাঁদপুরে ২৩, লক্ষ্মীপুরে ২০, কঙ্বাজারে ১৭, চট্টগ্রামে ১৫, সিরাজগঞ্জে ১৪ চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১৩ ও জয়পুরহাটে ১২ জন। এই আট জেলার হিসাবের দিকে তাকালে দেখা যায়, গত এক মাসে এসব স্থানে খুন হয়েছেন ১৪১ জন। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে, আমরা এ অভিযোগের সত্যতা জানতে তদন্ত করি, যেন আইন অনুসরণ করে এর সঠিকতা নিরূপণ করা যায়। (ডেইলি স্টার ইতিমধ্যে তদন্ত ও অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য জেলা প্রতিনিধিদের বলেছে)। এই খুন-গুম কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় এবং এর সঙ্গে জড়িতদের জবাবদিহির আওতায় নিয়ে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এর আগে ২২ জানুয়ারি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, বিগত তিন মাসে খুন ও গুম হয়েছেন ৪৮১ জন। এর মধ্যে খুন ২৯৪ ও গুম ১৮৭। অবশ্য পরে বিবিসিকে তিনি বলেন, খুন-গুমের মোট সংখ্যা ২৯৪ জন। তিনি আগের সংখ্যা থেকে নিজেই ১৮৭ জন কমিয়ে এনেছেন। খবরটির শিরোনাম হয়েছে 'সংখ্যা নিয়ে ফখরুলের ডিগবাজি'। এখন তার নেত্রী দাবি করছেন এক মাসে ২৪২ জন খুন হয়েছেন, যেখানে ফখরুল উল্লেখ করলেন তিন মাসে খুন-গুম মিলিয়ে ২৯৪ জনের কথা। এটিই প্রমাণ করে আমাদের রাজনীতিটা কীভাবে চক্রাকারে ঘুরছে এবং সততার ক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতি নেই। আমরা যদি ২০০১-এর দিকে তাকাই তাহলে দেখব, বিএনপি দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়লাভ করেছিল। ওই সময় আওয়ামী লীগ কর্মী ও হিন্দু ভোটারদের উপর সমন্বিত ও পরিকল্পিত হামলা করে খুন করা হয়েছিল অনেককে আর জখম করা হয়েছিল শত শত। তখনও সুষ্ঠু তদন্ত ও জড়িতদের শাস্তির দাবি উঠেছিল। কিন্তু বিএনপি সরকার বর্তমান ক্ষমতাসীনদের মতোই মানুষের নিষ্পেষণের অভিযোগের প্রতি কান না দিয়ে বরং বিএনপির ওপর আওয়ামী লীগের সহিংসতার অভিযোগ তুলেছিল। (ওই সময় আমরা এই খবরগুলো তুলে ধরে বিএনপি সরকারের সমালোচনা করেছিলাম)।
এটি প্রতিষ্ঠিত যে, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো অত্যন্ত অনুভূতিশূন্য কিংবা ঠাণ্ডা মাথায় ভুল সংখ্যা উল্লেখ করছে। তারা মনে করে যে, স্তম্ভিত করার মতো সংখ্যাটি নির্ভরযোগ্য সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য। স্বাধীন গণমাধ্যম ও রাজনীতিবোদ্ধাদের চেয়ে সরল মানুষকে বোঝানোটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। একইভাবে আমরা দেখেছি, ২০১৩ সালের ৬ মে বিএনপি দাবি করেছিল হেফাজতের সমাবেশে আগত হাজার হাজার কর্মী নিহত হয়েছেন, এবং ৫ তারিখ রাতে 'গণহত্যা' চালানো হয়েছিল, যদিও খোদ হেফাজতও এমনটা দাবি করেনি। এসবের ভাবী দৃশ্য হচ্ছে, আগামীতে বিএনপি নেত্রীর কোনো অভিযোগেরই তদন্ত শেখ হাসিনা সরকার করবে না এবং একসময় এটি পরিণত হবে ক্ষমতাসীন দলের পোষা গুণ্ডাদের বিদ্বেষপূর্ণ আক্রমণের বিষয়ে। বিপরীতে আমরা হয়তো দেখতে পাব, বিএনপি নেত্রী ও তার ছেলের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। আমরা ফিরে যেতে পারি ২০০৪ সালে ২১ আগস্ট, যেদিন শেখ হাসিনার ওপর আক্রমণ করা হয়েছিল আর এতে নিহত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের ২৪ নেতা-কর্মী। এরপর হত্যা করা হয় সাবেক অর্থমন্ত্রী এসএএমএস কিবরিয়া, আওয়ামী লীগ নেতা আহসানউল্লাহ মাস্টার, অ্যাডভোকেট মঞ্জুরুল ইসলাম, সাবেক এমপি মুমতাজউদ্দিন এবং আরও অনেককে, কখনোই যাদের মৃত্যুর কোনো তদন্ত করেনি বিএনপি সরকার এবং শাস্তি পায়নি প্রকৃত অপরাধীরা। প্রশ্ন হচ্ছে, আওয়ামী লীগ কি ভবিষ্যতেও বিচারকাজে ব্যর্থতার এমন নজির সৃষ্টি করবে, যা আমরা এই দুই নেত্রীর অধীনে দুই দশক ধরে দেখে আসছি?
এটি গুরুত্বের সঙ্গে ভেবে দেখার বিষয় যে, এভাবে চলতে পারে কি না। বছরের পর বছর ধরে, অর্থাৎ প্রায় ২১ বছর টানা দেশ শাসন করেছেন শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া। তারা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আইন-সংশ্লিষ্টদের আনুগত্যশীল করার মাধ্যমে আইনের প্রতি জনগণের বিশ্বাসকে ধ্বংস করা হয়েছে। যখন দেশের মানুষ আইন ও আইনি প্রক্রিয়ার ওপর আস্থা হারিয়েছে, ঠিক এ সময় আমরা মৌলিক অস্থিরতা নিয়ে কথা বলছি, যা সমাজের টিকে থাকাকেই হুমকির মুখে ফেলছে।
উপসংহারে বলা যায়, আমরা দৃঢ়ভাবে বলতে চাই, বিরোধী জোটের অতিশয়োক্তি হোক বা যা-ই হোক, আসলেই রাজনৈতিক সহিংসতায় ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর হাতে অনেক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। শুধু বিএনপি-জামায়াত কর্মীদের ছোড়া পেট্রল বোমা প্রাণহানি ঘটিয়েছে অনেক নিরীহ মানুষের (এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি-প্রধান লজ্জাকর নীরবতায় ছিলেন)। একইভাবে অনেকে নিহত হয়েছেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে। এই দুটি নিদর্শনেরই তদন্ত হওয়া প্রয়োজন ও উচিত। আর এটি হলেই কেবল বাংলাদেশকে আরও বেশি বাসযোগ্য একটি দেশে গড়ে তোলা যাবে। আমরা শেখ হাসিনা সরকারকে বলব, অতীত থেকে তারা গুরুত্বের সঙ্গে সরে আসবে এবং প্রতিটি অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত করে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ও যথোপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। আর এটি করা গেলেই কেবল আইনি প্রক্রিয়া ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর ওপর জনসাধারণের আস্থা ফিরে আসবে, যা এখন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ : মুজাহিদুল হক ও তানভীর আহমেদ
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।