কি সরকারি, কি বেসরকারি, কোথাও গিয়ে সুচিকিৎসা পাচ্ছে না রোগীরা। অসচ্ছল রোগীরা সরকারি হাসপাতালে এসে যেমন 'ইউজার ফি'র নামে অতিরিক্ত অর্থ দিতে বাধ্য হচ্ছে, তেমনি বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ করেও অদক্ষ ও ভুয়া চিকিৎসকের ভুল চিকিৎসায় রোগীরা পারছে না মৃত্যুকে ঠেকাতে। এ অবস্থায় দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার ওপর থেকে আস্থা হারাচ্ছে মানুষ। উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা হয়ে পড়ছে বিদেশমুখী। আর বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবার কথা ভুলতে বসেছে নিম্নবিত্তরা।
রাজধানীর সরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালগুলোর মধ্যে রয়েছে ঢাকা মেডিকেল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট,জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল, জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ, মিটফোর্ড, জাতীয় কিডনি রোগ ইনস্টিটিউট ও বক্ষব্যাধি হাসপাতাল। অভিযোগ আছে, এগুলোয় চলছে বেআইনিভাবে বাসা দখল ও হাসপাতালের জায়গায় অবৈধ স্থাপনা তৈরি। এ ছাড়া হাসপাতালের কাছেই নামে-বেনামে তৈরি করা হচ্ছে ক্লিনিক। পাশাপাশি রয়েছে শয্যা, চিকিৎসক ও নার্স-স্বল্পতা। আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাব। এমনকি হাসপাতালগুলোর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিয়েও অভিযোগ আছে রোগীদের। আছে নিম্নমানের খাবার নিয়ে নালিশ। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ইউজার ফি'র নামে সরকারি হাসপাতালগুলোতে চলছে রোগীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায়। আর এ অর্থ কিছু চিকিৎসক ও তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী ভাগাভাগি করে নিচ্ছেন নিজেদের মধ্যে। অন্যদিকে সরকারি হাসপাতালগুলোতে জটিল ও দীর্ঘস্থায়ী রোগের বিনামূল্যের চিকিৎসা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। সরেজমিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল (ডিএমসি) ঘুরে দেখা যায়, খাবারের নিম্নমান নিয়ে রোগীরা চরম বিরক্ত। এ ছাড়া এখানে শয্যা পাওয়া যেন ঈদের চাঁদ হাতে পাওয়া। এমনকি ডিএমসির প্রসূতি ও গাইনি চিকিৎসাসেবার অবস্থাও বেশ নাজুক। হাসপাতালের ১৫, ১৭ ও ১৮ নম্বর ওয়ার্ডে রয়েছে ধারণক্ষমতার বহুগুণ বেশি রোগী ও ভয়াবহ শয্যাসংকট। এখানে চিকিৎসক ও নার্স খুবই কম। যারা আছেন তারাও ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করছেন না। এদের নিয়েই চলছে দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই সরকারি হাসপাতাল ঢাকা মেডিকেলের প্রসূতিসেবা বিভাগ। রোগীদের অভিযোগ, শীতে বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও তারা কর্তৃপক্ষের কাছে কম্বল চেয়ে পাচ্ছেন না। সরকারি হাসপাতাল হওয়ায় স্বল্পমূল্যে চিকিৎসা নিতে আসেন নিম্নবিত্ত শ্রেণীর প্রসূতিরা। এরপরও হাসপাতালের একশ্রেণীর দালাল, ট্রলিবাহক, ওয়ার্ডমাস্টার ও ওয়ার্ড সরদারদের কাছে জিম্মি হতে হয় রোগীদের। রোগী ও তার পরিবারকে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে নিতে হয় হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা। এ ছাড়া নার্স সংকট রয়েছে ডিএমসির সব বিভাগেই। গত কয়েক বছরে হাসপাতালে চিকিৎসক বেড়েছে। তৈরি হয়েছে নতুন ওয়ার্ড ও ইউনিট। কিন্তু আনুপাতিক হারে বাড়েনি নার্সের সংখ্যা। ডিপ্লোমা নার্সেস অ্যাসোসিয়েশনের নেতা আনিছুর রহমান বলেন, হাসপাতালে চিকিৎসাসেবার মান ও শয্যাসংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও নার্সদের পদসংখ্যা বাড়েনি। তিনি জানান, রোগীরা হাসপাতাল থেকে যে চিকিৎসাসেবা পাচ্ছে তা আন্তর্জাতিক মানের নয়। অন্যদিকে গুরুতর অভিযোগের মধ্যে একটি হচ্ছে, দেশের সবচেয়ে বড় এ সরকারি হাসপাতালটিতে বেশ কয়েকবার ঘটেছে নবজাতক চুরির ঘটনা। এ ছাড়া ডিএমসির রেডিওলজি ও ইমেজিং বিভাগে প্রতিদিন আসছেন অসংখ্য রোগী। মূলত সিটিস্ক্যান, আলট্রাসনোগ্রাম ও এঙ্রের মতো জটিল সব স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো হয় মেডিকেলের রেডিওলজি ও ইমেজিং বিভাগে। কিন্তু বহুদিন ধরে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির অভাব থাকায় এ বিভাগে আসা রোগীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষায় ব্যাঘাত ঘটছে। রোগীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় সিরিয়াল দিতে হয়। ফলে গুরুতর অসুস্থরা তাৎক্ষণিকভাবে তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে পারছেন না। কেউ কেউ বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দালালের পাল্লায় পড়ে হচ্ছেন সর্বস্বান্ত। চিকিৎসকরাও বিভিন্ন কোম্পানির ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন রোগীদের। বিনিময়ে দালালরা তাদের দিচ্ছে নির্দিষ্ট অঙ্কের কমিশন। অন্যদিকে দালাল ও বহিরাগত অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস ব্যবসায়ীদের দাপটে বেহাল হয়ে পড়েছে ডিএমসির নিজস্ব অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস ব্যবস্থা। পর্যাপ্ত রোগী বহন না করতে পারায় ক্রমেই এ হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসটি অলাভজনক খাতে পরিণত হচ্ছে। অন্যদিকে দালাল চক্রের ফাঁদে পড়ে গন্তব্যে পেঁৗছাতে অসহায় রোগীদেরও গুনতে হচ্ছে নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি। জানতে চাইলে ডিএমসির পরিচালক ব্রি. জে. ডা. মোস্তাফিজুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নানা সমস্যা থাকার পরও হাসপাতালের মান ভালো করার আপ্রাণ চেষ্টা চলছে। নতুন বিভাগ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে যেহেতু সরকারি হাসপাতাল তাই কিছুটা সময় লাগছেই। অন্যদিকে জনবল ও ওষুধ সংকট, শয্যা-স্বল্পতা ও রাজস্ব খাতে স্থানান্তরিত হওয়াসহ বহুবিধ সমস্যার পাহাড় মাথায় নিয়ে চলছে সরকারিভাবে পরিচালিত দেশের প্রথম 'বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট'। ডিএমসিতে অবস্থিত এ বিভাগে কাঠামোগতভাবে ১০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালের উল্লেখ থাকলেও বর্তমানে এখানে রয়েছে মাত্র ৫০টি শয্যা। প্রকল্পের আওতায় পরিচালিত হওয়ায় হাসপাতালের ওষুধ সরবরাহ অত্যন্ত কম। ফলে দরিদ্র রোগীদের ওষুধ সংগ্রহে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের সমন্বয়ক ডা. সামন্তলাল সেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অর্থ, স্বাস্থ্য ও সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের যৌথ প্রচেষ্টায় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটকে রাজস্ব খাতে স্থানান্তরের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। রাজস্ব খাতে স্থানান্তর হলেই এর সব সমস্যা সমাধান হবে।
বেসরকারি চিকিৎসাসেবা : দেশে বেসরকারি মেডিকেল কলেজের সংখ্যা বাড়লেও রোগীরা পাচ্ছেন না পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা। বেসরকারি খাতের চিকিৎসাসেবার নামে চলছে বড় ধরনের বাণিজ্য। এতে সেবার মান নিয়েও প্রশ্ন আছে। নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো চালাচ্ছেন এর মালিকরা। আর ১৯৮২ সালের বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা আইনের কার্যকারিতা না থাকায় সংশ্লিষ্টরাও সুবিধা নিচ্ছেন বেসরকারি হাসপাতালগুলো থেকে। এ জন্য সরকার বেসরকারি চিকিৎসাসেবা আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিলেও তা এখনো কার্যকর হয়নি। অনুসন্ধানে জানা যায়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের পদস্থ কর্মকর্তা, চিকিৎসক নেতা, নামকরা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও করপোরেট ব্যবসায়ীরা রাজধানীতে অনেক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের মালিক। আর এ প্রভাবশালীদের কারণে এসব হাসপাতালের তদারকিতেও রয়েছে ছাড়। এ প্রভাবশালীদের কারণেই বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা আইন আশার আলো দেখছে না। অথচ এ হাসপাতালগুলো নিয়ম মেনে চলছে কি-না তা তদারকিতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের কোনো কর্মসূচি নেই। সরেজমিন রাজধানীর বেশকয়েকটি বেসরকারি ক্লিনিক ঘুরে দেখা যায়, আবাসিক বাড়িতে ঘরভাড়া নিয়ে তৈরি করা হয়েছে ঘুপচি চিকিৎসাকেন্দ্র। ক্লিনিকগুলোর বাইরে সাইনবোর্ডে বিভিন্ন ডিগ্রিধারী চিকিৎসকদের সেবা দেওয়ার উল্লেখ থাকলেও এদের অধিকাংশই উপস্থিত থাকেন না। র্যাবের নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, কিছু হাসপাতালে চিকিৎসকের সহযোগীরা নিজেকে ডিগ্রিধারী চিকিৎসক হিসেবে পরিচয় দিয়ে রোগীর চিকিৎসা করাচ্ছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন পরীক্ষার জন্য এসব হাসপাতালে সরকারি হাসপাতালের চেয়ে তিন-চার গুণ বেশি ফি আদায় করা হচ্ছে।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।