প্রেমের করুণ পরিণতির গল্প নার্সিসাস ও ইকোর প্রণয়। এই দুই গ্রিক মিথলজির নর-নারীর প্রেমকাহিনী অশ্রুসজল করে তোলে পাঠককে।
নার্সিসাস ছিল নদীর দেবতা সিফিসাসের ছেলে। তার মা ছিলেন লিরিউপি। লিরিউপি আসলে একজন পরী ছিল।
তাদের ঘর আলো করে জন্ম নেয় নার্সিসাস। খুব স্বাভাবিক কারণেই বাবা দেব পুরুষ এবং মা অনিন্দ্যসুন্দরী পরী হওয়ায় নার্সিসাস ছিল আকর্ষণীয় পুরুষ। নার্সিসাসের মা তার ছেলের ভবিষ্যৎ আগে থেকেই জেনে নিতে ছুটে গিয়েছিলেন এক অন্ধ জ্যোতিষীর কাছে। অন্ধ জ্যোতিষীর নাম ছিল টাইরেসিয়াস। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এর আগে টাইরেসিয়াসকে অন্ধ করে দিয়েছিলেন দেবতা জিউসের স্ত্রী হেরা।
সে কারণেই টাইরেসিয়াসের অন্ধত্বের ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেবতা জিউস তাকে ভবিষ্যৎ বলার ক্ষমতা দিয়েছিলেন। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে, নার্সিসাসের মা লিরিউপি তাকে নিয়ে এই অন্ধ টাইরেসিয়াসের কাছে তার পুত্রের আয়ুষ্কাল জানতে গিয়েছিলেন। টাইরেসিয়াস ভবিষ্যৎ যাচাই করে বলল, 'এই ছেলেটির আয়ুষ্কাল হবে দীর্ঘ, তবে একটি শর্ত রয়েছে। সে যদি নিজেকে কখনো না দেখে, তবে দীর্ঘায়ু পাবে। '
নার্সিসাসকে ছোটবেলা থেকেই তাই আয়নার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হতো।
সে কখনো নিজেকে দেখেনি। এদিকে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নার্সিসাস হয়ে উঠতে লাগল সে সময়ের সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষ। পরীরা তার প্রেমে মত্ত ছিল। তাকে একনজর দেখার জন্য দিনের পর দিন, রাতের পর রাত জলপরী, বনপরী, ঝরনাপরীরা তার অপেক্ষায় থাকত। নার্সিসাসের পৌরুষে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে থাকত সবাই।
অন্য সবার মতোই নার্সিসাসের প্রেমে পড়েছিল এক বনপরী। তার নাম ইকো। ইকো নামের মানে হলো প্রতিধ্বনি। ইকো একটা সময় দেবতা জিউসের সঙ্গে প্রণয়ে লিপ্ত ছিল। এ কথা জানতে পেরে ভীষণ ক্ষুব্ধ হলো জিউসের স্ত্রী হেরা এবং ইকোর মুখের কথা চিরতরে বন্ধ করে দেয় অভিশাপে।
তাই অভিশাপের কারণেই ইকো শুধু অন্যের কথার প্রতিধ্বনি করতে পারত। সে যাই হোক, কথা বলতে না পারার যন্ত্রণা নিয়েই ইকো বনে বিচরণ করত। একদিন নার্সিসাস বনে শিকার করতে এলো। বনে সুদর্শন সুপুরুষ নার্সিসাসকে প্রথম দেখাতেই মন দিয়ে বসে ইকো। কিন্তু সে তো কথা বলতে পারে না, মনের কথা বলবে কীভাবে? এ কারণেই সে নিজে থেকেই দূরে সরে থাকত।
কিন্তু প্রেমিকার মন যে আর মানে না। এত কাছে পেয়েও প্রেমিককে মনের কথা বলতে না পারার দুঃখে সে আচ্ছন্ন থাকত সারাক্ষণ। নার্সিসাস যতবারই বনে শিকার করতে আসত বনপরী ইকোও তার পিছু নিত। সে আড়াল থেকে নার্সিসাসের পিছু নিত আর মনে মনে ভাবত, আজ হয়তো একবারের জন্য হলেও তার মনের মানুষ নার্সিসাস তার দিকে তাকাবে। কিন্তু নার্সিসাস তার দিকে ফিরেও তাকায় না।
অপেক্ষায় দিন কাটতে থাকে ইকোর। এমনই একদিন নার্সিসাস যখন বনের মধ্যে শিকারের পিছু নিয়ে ঘুরছিল তখন কারও পায়ের আওয়াজ শুনতে পেয়ে সে জিজ্ঞাসা করল, কে ওখানে? প্রেমিক পুরুষ ডাকলেও নিজের মনের কথা বলার শক্তি যে নেই ইকোর। সে বড় জোড় অন্যের কথার প্রতিউত্তর সৃষ্টি করতে পারে। তাই ইকো উত্তর করল, ওখানে...। এমন উত্তরে বেশ কৌতূহল জাগল নার্সিসাসের।
সে ইকোকে বলল, সামনে এসো। ইকো প্রতিউত্তর করল, সামনে এসো...।
কৌতূহল যেন ক্রমেই বাড়ল নার্সিসাসের। সে ইকোর সঙ্গে দেখা করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠল। অন্যদিকে ইকোর মনে হতে লাগল এ যেন সত্যি নয় স্বপ্ন।
সুদর্শন পুরুষ নার্সিসাসের সামনে আসার আহ্বানে সে আনন্দে আত্দহারা হয়ে গেল। ইকোর বুক ভরা আশা সে তার মনের কথা, ভালোবাসার সব কথা খুলে বলবে নার্সিসাসকে। কিন্তু পরক্ষণে তার বিষাদে সব সুখ মিলিয়ে গেল। সে যে নিজে কথা বলতে পারে না। কোনো উত্তর না করে সে ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল নার্সিসাসকে।
কিন্তু নার্সিসাস তো ইকোর মনের কথা জানে না! তাকে অনেক পরীই ভালোবাসে, আত্দগৌরবে-অহঙ্কারে সে ছুড়ে দিল ইকোকে। নার্সিসাস খুব রেগে গেল। ইকো মাটিতে আছড়ে পড়ল। প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে হু হু করে কাঁদতে লাগল ইকো। সে অবশেষে বনের এক প্রান্তে উঁচু পর্বতে গিয়ে কাঁদতে থাকল।
কত দিন, কত রাত পেরিয়ে গেল নার্সিসাসের দেওয়া অপমান ভুলতে পারল না সে। কাঁদতে কাঁদতে একসময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল সে। পবর্তের কোলে শুয়ে কাঁদছিল ইকো। তার মরদেহ হয়ে গেল পাথরের মতোই। মৃত্যুর আগে প্রতিটি মূহূর্ত সে শুধু নার্সিসাসের দেওয়া লজ্জা, অপমান ও হৃদয় ভাঙার শোকে বিলাপ করত।
তার বিলাপ কেউ শুনত না। এদিকে নার্সিসাস সব ভুলে গেছে ততদিনে। সুন্দরী, পরীদের কাছ থেকে ভালোবাসার কথা শুনতে শুনতে বিরক্ত। ভালোবাসার বিনিময়ে সবাই তার কাছ থেকে পেত অপমান। একসময় মন ভাঙা পরীরা প্রতিশোধের দেবী নেমেসিসের কাছে প্রার্থনা করল, হে দেবী, নার্সিসাস যদি কখনো প্রেমে পড়েও, সে যেন ভালোবাসা না পায়।
' নেমেসিস তাদের প্রার্থনা শুনেছিলেন।
একদিন নার্সিসাস এক জলাশয়ে পানি খেতে গিয়ে জীবনে প্রথমবারের মতো নিজেকে দেখল। অপূর্ব, সুদর্শন পুরুষ। কিন্তু নার্সিসাস তো জানত না পানিতে তারই প্রতিবিম্ব পড়েছে। সে প্রতিবিম্বকে ছুঁয়ে দেখতে গেল কিন্তু জলে হাত দেওয়া মাত্র ঢেউয়ে প্রতিবিম্ব মিলিয়ে গেল।
জীবনে প্রথমবারের মতো কাউকে ছুঁয়ে দেখতে চেয়ে অস্থির হয়ে উঠল সে। আবার হাত বাড়াল নার্সিসাস। জলদেবতাও ঢেউ তুলে প্রতিবিম্ব মুছে দিল। এতে নার্সিসাস খুব ভয় পেয়ে আর জলের দিকে হাত বাড়াল না। একদৃষ্টিতে প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে থাকতে লাগল সে।
হতাশায় নার্সিসাস শুধু কাঁদত। প্রতিবিম্ব প্রেমিকের শোকে তার শরীর শুকিয়ে সৌন্দর্য ম্লান হতে থাকল। যত পরী তাকে ভালোবাসত তারা বারবার নার্সিসাসকে বলল, ফিরে এসো। কিন্তু সে জলাধারের কাছে অবাক বিস্ময়ে বসে রইল দিনের পর দিন। জীবনের প্রথম ভালোলাগাকে ছুঁয়ে দেখতে না পারার ভীষণ বেদনায় একসময় ইকোর মতো নার্সিসাসও মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।