দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চলছে রাজনৈতিক ব্যানারে নিয়োগ পাওয়া এবং কম মেধাবী শিক্ষকদের রামরাজত্ব। ছাত্ররাজনীতির নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে কমিটি গঠনের দায়িত্বও এখন তাদের হাতে। এক সময়ে শিক্ষকদের পাঠদান, জ্ঞান চর্চা আর গবেষণায় ব্যস্ত থাকতে দেখা গেলেও এখন একশ্রেণীর শিক্ষককে নিয়মিত দেখা যায় মন্ত্রী-নেতাদের ড্রয়িং রুমে আর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস কেন্দ্রিক রাজনৈতিক গণসংযোগে। দেশের প্রখ্যাত শিক্ষাবিদরা বলছেন , এই চর্চা তৈরি হয়েছে অনিয়মের মাধ্যমে রাজনৈতিক কর্মীদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার কারণে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে এই ধরনের চর্চা চলতে থাকলে বংলাদেশের উচ্চশিক্ষার ভবিষ্যৎ শেষ হয়ে যাবে। ইদানীং পাবলিক
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মেধাবী শিক্ষকের চেয়ে বাড়ানো হচ্ছে রাজনৈতিক লাঠিয়াল ও ভোটার সংখ্যা। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, দলীয় আনুগত্যে শিক্ষক নিয়োগ খুবই দুঃখজনক। একজন শিক্ষক ৩০ বছর শিক্ষকতা করবেন। দলমতের ঊধের্্ব উঠে তাদের কাজ করতে হবে। কিন্তু এখন যারা শিক্ষক হলেন তাদের প্রয়োজনীয় মেধা যদি না থাকে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে কী পড়াবেন। শিক্ষকের রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকতে পারে। তবে দলীয় আনুগত্য তাদের পরিহার করা উচিত। আরেক শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, আমাদের দেশে জনগণের মঙ্গলের জন্য রাজনীতির চর্চা হয় না। এখন সর্বক্ষেত্রে রাজনীতি। বিশ্ববিদ্যালয় মেধা লালনের জায়গা। এই জায়গাটিও এখন মেধাশূন্য হয়ে উঠছে। প্রকৃত মেধাবীদের শিক্ষক হিসেবে না নিয়ে দলীয় লেজুর বৃত্তির লোক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। অন্তত শিক্ষক নিয়োগ এই ধরনের চর্চা আমাদের জন্য অমঙ্গলজনক। তবে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, যে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগে এবং পরিচালনায় অনিয়মের খবর পেয়েছি তাৎক্ষণিক চিঠি ইস্যু করেছি এবং ব্যবস্থা নিয়েছি। ফলে দুর্নীতি ও অনিয়মের সুযোগ দেওয়া হয়নি। জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) শর্ত উপেক্ষা করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান রয়েছে নিয়োগ প্রক্রিয়া। নিয়োগ দুর্নীতির প্রতিবাদে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় মাসের পর মাস অচল থাকলেও দুর্নীতি বন্ধ হয়নি। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসির মেয়ে, ছেলে, ভাই, ভাইয়ের মেয়ে নিয়োগ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে একাধিক অভিযোগ জমা হয়েছে। আর দলীয় নিয়োগেও নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে বর্তমান সরকারের আমলে। মহাজোট সরকারের পুরো সময়টাতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ৩ হাজার ৩০০ শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। এ সংখ্যা বিগত বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জামায়াত-বিএনপি জোটের চেয়েও প্রায় দ্বিগুণ। এসব নিয়োগের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রয়েছে দলীয়করণ, আত্দীয়করণ ও অর্থলেনদেনের অভিযোগ। শিক্ষক নিয়োগের প্রতিবাদে হাইকোর্টে রিট পর্যন্ত করা হয়েছে। তারপরও বন্ধ হয়নি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএনপি-জামায়াত জোটের আমলে ২৫৬ জন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। যাদের অধিকাংশই শিবিরের ক্যাডার। সেই ধারাবাহিকতা রক্ষা করে গত মহাজোট সরকারের সময়ে মোট ১৪৩ জন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যায়ে। এ নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে খোদ ভিসি অধ্যাপক আনোয়ারুল আজিম আরিফের বিরুদ্ধে। দলীয় বিবেচনা আর সুসম্পর্কের কারণে যোগ্যতা নেই- এমন অনেককে নতুন পদ সৃষ্টি করে শিক্ষক করা হয়েছে। ভিসির দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই অধ্যাপক আনোয়ারুল আজিম আরিফ শিক্ষাজীবনের সর্বস্তরে সিজিপিএ-৩ অর্থাৎ ২য় শ্রেণী পাওয়াদের শিক্ষক পদে আবেদনের সুযোগ রেখে নতুন নিয়ম তৈরি করেছিলেন। কিন্তু আন্দোলনের মুখে মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সে সিদ্ধান্ত বাতিল করলেও থেমে নেই নিয়োগে অনিয়ম। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪টি সিন্ডিকেটে ৫৯টি বিজ্ঞাপিত পদের বিপরীতে ৯২ জনকে শিক্ষক করা হয়েছে। সম্প্রতি সাংবাদিকতা বিভাগে ২টি বিজ্ঞাপিত পদের বিপরীতে ৭ জন আর নৃবিজ্ঞান বিভাগে ৪টি পদের বিপরীতে ৭ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়, যার ৬ জনই ২য় শ্রেণী পাওয়া। তা ছাড়াও ২৭ পদের বিজ্ঞাপন দিয়ে ৪৩ শিক্ষক নিয়োগে 'বিশেষ সংশোধনী'র আড়ালে নজিরবিহীন অনিয়মের জন্ম দিয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ২৭টি পদের বিজ্ঞাপন দিয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ৪৩ জনকে। যোগ্য একাধিক প্রার্থী থাকা সত্ত্বেও তাদের বাদ দিয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে স্নাতকোত্তর পর্বে ৩২ জনের মধ্যে ২৭তম ব্যক্তিকেও। গত মহাজোট সরকারের আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ৫১৭ জন শিক্ষক। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে মহাজোট সরকার বিজয়ী হয়ে সরকার গঠনের পর ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৩ সালের মার্চ পর্যন্ত ৩২টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩ হাজার ২২৪ জন শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছেন। আর বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের ৫ বছরে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল ১ হাজার ৯৪৯ জন শিক্ষক। এ ছাড়া ড. ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ৬৭৫ জন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। বিভিন্ন তথ্য ও প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০১ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৩৭৫ জন। ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় এসে ২৩০ জন শিক্ষক নিয়োগ দেয়। ২০০৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সংখ্যা দাঁড়ায় ১ হাজার ৬৬৪ জন। মহাজোট আমলে ঢাবিতে ৫১৭ জন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়।
২০০১ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক সংখ্যা ছিল ৩৭৩ জন। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে জবিতে মোট ৮৪ জন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০০৯ সালে জাবিতে নিয়োগ দেওয়া হয় ১২০ জন। ২০১০ সালে শিক্ষক সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ৫৮৭ জনে। ২০১১ সালে ৫১ জন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০১২ সালের ১ জুলাই থেকে বর্তমান সরকারের জুন পর্যন্ত জবিতে ৬৫ জন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। মহাজোট সরকারের পুরো সময় জুড়ে জবিতে মোট ২৩৬ জন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬৬ জনকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। মহাজোট ক্ষমতায় এসে ২০০৯ সালে বুয়েটে ২৫ জন, ২০১০ সালে ৭১ জন শিক্ষক নিয়োগ পায়। ২০১২ সালের ৭ জুলাই থেকে গত বছরের মার্চ ২৭ জন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। মহাজোট সরকারের সময়ে এই প্রতিষ্ঠানে মোট ১২৩ জন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিকভাবে নিয়োগ পান ৩০৯ জন শিক্ষক। ২০০৯ সালে ৩৩ জন, ২০১০ সালে ১১৩ জন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০১০ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট শিক্ষক সংখ্যা ছিল ১ হাজার ১৭৮ জন। ২০১১ সালের শেষ থেকে ২০১৩ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত রাবিতে নিয়োগ দেওয়া হয় আরও ১৮৪ জন শিক্ষককে। মহাজোট সরকারের আমলে রাবিতে নিয়োগ পান ৩৩০ জন শিক্ষক। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে চারদলীয় জোট সরকারের আমলে মোট ১০৯ জন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০১১ সালে ৩৯ জন, ২০১২ সাল ও চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ২৬ জনসহ সরকারের শেষ সময় পর্যন্ত প্রায় ৬৫ শিক্ষককে নিয়োগ দেওয়া হয়।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে জোট সরকারের আমলে নিয়োগ দেওয়া হয় ৮১ জন শিক্ষক। মহাজোট সরকারের আমলে ইবিতে নিয়োগ পায় ৬৪ জন শিক্ষক। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ৯৮ জন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। মহাজোট সরকারের আমলে নিয়োগ পায় ৬১ জন শিক্ষক। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারদলীয় জোট সরকারের আমলে খুবিতে ১১৩ জন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। মহাজোট সরকারের সময়ে মোট ৮৮ জন শিক্ষক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে মহাজোট সরকারের সময়ে মোট ৭৬ জন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদালয়ে মহাজোট সরকারের সময়ে ৭৯ জন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দেওয়া হয় ১১৪ জন শিক্ষক। পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭২ জন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে মহাজোট সরকারের আমলে নিয়োগ দেওয়া হয় ৮০ জন শিক্ষক। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে মহাজোট সরকারের সময়ে নিয়োগ পান ১৫৯ জন শিক্ষক। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে মহাজোট সরকারের সময়ে মোট ৭৯ জন শিক্ষক নিয়োগ পায়। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে মহাজোট সরকারের সময়ে ৯৯ জন শিক্ষক নিয়োগ পায়। যাদের অধিকাংশ জামায়াত-বিএনপির সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।