দেশের বহুল আলোচিত-সমালোচিত ও বিতর্কিত কক্সবাজার-৪ আসনের সরকারদলীয় এমপি আবদুর রহমান বদির সমর্থিত প্রার্থী এক উপজেলায় বিজয়ী হলেও অপরটিতে বিশাল ব্যবধানে পরাজিত হয়েছেন। বিগত পাঁচ বছরে ক্ষমতার দাপট, উপজেলার নিরীহ লোকজনকে মারধর ও বিভিন্ন মামলায় জড়িয়ে হয়রানি করা তার পরাজয়ের অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন এখানকার সচেতন অধিবাসীরা। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এমপি আবদুর রহমান বদি গত পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকাকালে কারও কারও গায়ে হাত তুলতে দ্বিধা করেননি। তার হাত থেকে রেহাই পাননি শিক্ষক, মুক্তিযোদ্ধা, আইনজীবী, সরকারি কর্মকর্তাসহ সংস্কৃতি কর্মীরাও। পাঁচ বছরে চারজন শিক্ষককে পিটিয়েছেন তিনি।
উপজেলা নির্বাচনে জয়-পরাজয়েরে ঘটনায় আবারও অলোচনায় উঠে আসে বদির অতীত ও চলমান কর্মকাণ্ড। গত পাঁচ বছরে তিনি বহুজনকে পেটানোর ঘটনা ঘটিয়েছেন। এর আগে তার হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন কক্সবাজারের সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল হাকিম, উখিয়ার সাবেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা গোলামুর রহমান, কক্সবাজার সদরের সহকারী কমিশনার (ভূমি) আবদুর রহমান, টেকনাফের মুক্তিযোদ্ধা হাজি মোস্তফা, কক্সবাজার আইনজীবী সমিতির সদস্য ও বিশিষ্ট সংস্কৃতি কর্মী অ্যাডভোকেট রাখাল মিত্র, বনবিট কর্মকর্তা মুজিবুর রহমান প্রমুখ। প্রহৃত শিক্ষকরা হলেন টেকনাফের আবদুল জলিল, পুলিন দে এবং সাবরাং হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক মুফিজ উদ্দিন। টেকনাফের সাবেক সংসদ সদস্য মো. আলীর অভিযোগ, সদ্য সমাপ্ত উপজেলা নির্বাচনে টেকনাফের অসংখ্য ভোটকেন্দ্রে বদির ক্যাডাররা প্রভাব খাটিয়ে প্রকাশ্যে ব্যালট পেপার ছিঁড়ে নিয়ে বদি মনোনীত প্রার্থী জাফর আলমকে বিজয়ী করলেও উখিয়াতে ঘটেছে বিপর্যয়।
উখিয়াতে বৌদ্ধ মন্দিরে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনায় অসংখ্য নিরীহ মানুষকে হয়রানি করতে মামলায় জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেন জাতীয় সংসদের সাবেক হুইপ শাহাজাহান চৌধুরী। এসব ঘটনায় ক্ষোভ দানা বেঁধেছিল উখিয়ার সাধারণ মানুষের মাঝে। আর সে জমানো ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে ৩১ মার্চ অনুষ্ঠিত উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে। এ উপজেলায় সংসদ সদস্য বদির মনোনীত প্রার্থী হুমায়ুন কবির চৌধুরী প্রায় ১৫ হাজার ভোটের ব্যবধানে হেরেছেন বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী সরওয়ার জাহান চৌধুরীর কাছে। নব নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান সরওয়ার জাহান চৌধুরী জানান, এমপি বদি পরাজয় মেনে নিতে না পেরে দলীয় ক্যাডারদের দিয়ে উখিয়ায় ত্রাসের রাজত্ব চালাছেন।
১ এপ্রিল উখিয়া উপজেলা বিএনপি কার্যালয় ভাঙচুর, কোটবাজার ও উখিয়া স্টেশনে বিএনপি সমর্থিত ভোটারের দোকান ও ঘরবাড়িতে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করেছে। বর্তমানে বদির ক্যাডারদের ভয়ে উখিয়া টেকনাফে বিএনপির তিন হাজার নেতা-কর্মী বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াছেন। কক্সবাজারের একাধিক থানায় বদির বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা আছে বলে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সূত্রে জানা গেছে। বিতর্কিত এ এমপির বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত মোট ৯০টি মামলার খোঁজ পেয়েছে দুদক। এগুলোর মধ্যে শিশু ও নারী নির্যাতন থেকে শুরু করে ভয়ঙ্কর অপরাধের মামলাও রয়েছে বলে জানা গেছে।
নির্বাচনের আগে হলফনামায় দেওয়া তথ্য অনুযায়ী কঙ্বাজার-৪ (উখিয়া-টেকনাফ) আসনের এ সংসদ সদস্যের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানে মাঠে নামলেও এখন থমকে গেছে বলে দুদক- এ অভিযোগ করেছেন কক্সবাজারের একাধিক সচেতন ব্যক্তি। এদিকে নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, এমপি বদির ভাই ও আত্দীয়স্বজন নিয়ন্ত্রণ করে ইয়াবা ব্যবসা। ক্ষমতার কাছে থাকায় ইয়াবা ব্যবসার গডফাদাররা সব সময়ই থাকে প্রশাসনের ধরাছোঁয়ার বাইরে। বারবার বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা, পুলিশ প্রশাসন, বিজিবি, কোস্টগার্ড, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায় নাম এলেও তারা প্রকাশ্যেই ইয়াবার রাজ্যে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। ইয়াবা ব্যবসায়ীরা এতটাই প্রভাবশালী যে, জেলা আইনশৃঙ্খলা বৈঠকে বিষয়টি তোলার কেউ সাহস করেন না।
কেউ বিষয়টি তুললেও এমপি বদি রেগে ফেটে পড়েন। অভিযোগ রয়েছে, বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক ইয়াবার চালানও ছাড়িয়ে নিয়ে যান এমপি বদি। ইয়াবা পাচারে কখনো কখনো বদির গাড়িও ব্যবহার করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। ইয়াবার গডফাদারদের তালিকায় এ ব্যবসার পৃষ্ঠপোষক হিসেবে বারবারই এসেছে টেকনাফের 'বিতর্কিত' এই সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির নাম। সম্প্রতি অপ্রতিরোধ্য ইয়াবা শিরোনামে দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনে সংবাদ প্রকাশিত হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাঠে নেমে বদির অন্যতম সহযোগী নুর মোহাম্মদকে (৩৫) গত ২০ মার্চ বিপুল পরিমাণ ইয়াবাসহ আটক করে এবং সে ক্রসফায়ারে পড়ে।
৫ জানুয়ারি তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর ক্ষমতার দাপটে তটস্থ হয়ে পড়েছে স্থানীয় প্রশাসন থেকে সীমান্ত বাণিজ্যের ব্যবসায়ীরা। মিয়ানমার থেকে যেসব পণ্য দেশে আসছে এর প্রতিটিতে এমপি ট্যাক্স নামের বিশাল একটি অংক প্রতিদিন তাকে পৌঁছে দিতে হয় বলে ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন। তার গাড়ি থেকে ইয়াবা উদ্ধারের ঘটনাও ঘটেছে একাধিকবার। সর্বশেষ গত বছর আগস্ট মাসে কুমিল্লায় বদির উপস্থিতিতেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তার গাড়ি থেকে বিপুল পরিমাণ ইয়াবা উদ্ধার করে। কিন্তু বিতর্কিত এ সংসদ সদস্য প্রভাব খাটিয়ে পুরো ইয়াবার চালান নিয়েই ঢাকায় আসেন।
এমপি বদির ইয়াবা বাণিজ্যের সঙ্গে টেকনাফে দায়িত্ব পালন করা সাবেক এক বিজিবি কর্মকর্তা, চট্টগ্রাম রেঞ্জের পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, চট্টগ্রাম বিভাগের এক প্রভাবশালী মন্ত্রী, রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের তিন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জড়িত থাকার অভিযোগ আছে। সরকারি ও বিরোধী দলের একাধিক শীর্ষ নেতাও জড়িত রয়েছেন ইয়াবা ব্যবসায়। অন্যদিকে ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত আছে বাংলাদেশি দুটি শক্তিশালী ইয়াবা নেটওয়ার্ক। আর মিয়ানমারে আছে ১৭ সদস্যের একটি আন্তর্জাতিক মাফিয়া চক্র। টেকনাফভিত্তিক নেটওয়ার্কের একটির নিয়ন্ত্রণ করে এমপি বদির তিন আপন ভাই, দুই সৎ ভাই, আপন ভাগিনা, দুই বেয়াই ও ব্যক্তিগত সহকারী।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।